রক্তে কেনা আমার স্বাধীনতা

সীমানাপ্রাচীর না থাকায় অরক্ষিত গণকবর

প্রকাশ | ০৭ মার্চ ২০২১, ০০:০০

ইউসুফ আলী সুমন
গণকবরের জায়গা দেখাচ্ছেন বীরমুক্তিযোদ্ধা সেরাতুন নবী
স্বাধীনতার প্রায় ৫০ বছরেও নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের গণকবরগুলো সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। পায়নি সরকারি স্বীকৃতিও। বধ্যভূমিগুলো অযত্ন-অবহেলায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে। নতুন প্রজন্মের কেউ জানতেই পারছেন না সে বধ্যভূমিগুলোতে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন মুক্তিকামী বীর বাঙালির দামাল সন্তানরা। সরকারিভাবে এসব বধ্যভূমি সম্পর্কে তেমন কোন তথ্যাদি সংরক্ষণ করা হয়নি। ফলে এসব বধ্যভূমির উন্নয়ন, সংস্কার বা অন্য কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা যায়নি। তথ্যানুসন্ধ্যানে জানা যায়, উপজেলার আত্রাই নদীসংলগ্ন রাবেয়া পলস্নীতে, আখেড়া গ্রামে, সিদ্দিকপুর গ্রামে, চেরাগপুর ইউনিয়নের বাজিতপুর গ্রামে, চকদৌলত গ্রামে, খাজুর ইউনিয়নের দেবীপুর মোড়ে, হাতুড় ইউনিয়নের মহিষবাথান গ্রামের বামনদহ বিল এলাকায় পৃথক গণকবর রয়েছে। এগুলোর মধ্যে শুধু বাজিতপুর গ্রামে অবস্থিত গণকবরে প্রায় পাঁচ বছর আগে নওগাঁ জেলা পরিষদের উদ্যোগে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়। তবে সেখানে সীমানাপ্রাচীর না থাকায় এখনো অরক্ষিত রয়েছে। সরেজমিনে মহিষবাথান গ্রামের বামনদহ বিল এলাকায় গিয়ে গণকবরের খোঁজ করলে গ্রামবাসীরা জানান, গণকবর স্থানটি এখন নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। এটি কোথায় ছিল তা গ্রামের কেউ আর বলতে পারে না। স্থানীয় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের খোঁজ করে মহিষবাথান বাজারে পাওয়া গেল বয়সের ভারে নু্যব্জ প্রবীণ বীর মুক্তিযোদ্ধা সেরাতুন নবীর। তিনি এই প্রতিবেদককে নিয়ে গেলেন সেখানে। পায়ে হেঁটে কলাবাগান ও ফসলের মাঠের ভিতর দিয়ে এক কিলোমিটারের বেশি পথ পাড়ি দিয়ে বামনদহ বিলে। তিনি বিলের একটি পুকুরের পশ্চিম-দক্ষিণ পার্শ্বে শিম ক্ষেতের মাচা দেখিয়ে বললেন সেইখানেই পুঁতে রাখা হয় ৩০ জন মুক্তিকামী বাঙালির নিথর দেহ। আবেগঘন কণ্ঠে তিনি জানান, সেখানে একটি ক্যানেলের পাড়ে ছিল বিশাল পাকুড় গাছ। বর্বর পাক হানাদার বাহিনী একাত্তরের ২৬ এপ্রিল সোমবার বেলা ১০টায় তিন দিক থেকে মহিষবাথান গ্রামে আক্রমণ চালায়। তিন দিক থেকে একসঙ্গে পা হানাদাররা মহিষবাথান হাটে ঢুকে অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর, লুটতরাজ ও স্থানীয় ৩৫ জনকে আটক করে। পরে তাদের বামনদহ বিলের পশ্চিমের দীঘিরপাড়ে নিয়ে হাত বেঁধে সারি করে দাঁড় করিয়ে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে জখম করে। পরে ব্রাশফায়ারে তাদের হত্যা করা হয়। ভাগ্যক্রমে মারাত্মক জখম নিয়ে বেঁচে যান ৫ থেকে ৭ জন। বাকিদের বিলসংলগ্ন পাকুড় গাছের তলায় একসঙ্গে মাটিচাপা দেওয়া হয়। স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত এটির আর খোঁজ নেয়নি কেউ। যারা বেঁচে গিয়েছিলেন তাদের মধ্যে ২ জন ছিলেন বামনদহ গ্রামের। কয়েক বছর আগে তারাও মারা গেছেন। মহাদেবপুর-পোরশা সড়কের খাজুর ইউনিয়নের দেবীপুর মোড় এলাকায় খোঁজ পাওয়া গেল আরও একটি গণকবরের। একইদিন এই রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় বর্বর পাকবাহিনী এলাকার ১৩ জন মুক্তিকামী বাঙালিকে ধরে এনে গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করে। কাছেই পাওয়া গেল অমূল্য চন্দ্র বর্মণ নামে ৭০ বছরের এক বৃদ্ধকে। তার পিতা গোপাল চন্দ্র বর্মণকে হত্যা করা হয়েছিল এখানে। তিনি জানন, এই গণকবরের জায়গায় এখন ধানের আবাদ করা হয়েছে। কবরের চিহ্নটিও নেই। কেউ এই জায়গাটি সংরক্ষণের উদ্যোগও নেয়নি। উপজেলার চেরাগপুর ইউনিয়নের বাজিতপুর গ্রামে গিয়ে দেখা গেল একটি স্মৃতিস্তম্ভ। প্রায় পাঁচ বছর আগে নওগাঁ জেলা পরিষদ এটি নির্মাণ করে। যুদ্ধ চলাকালে পাক হানাদার বাহিনী এখানে ঢুকে অগ্নিসংযোগ করে বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়ে নিরীহ গ্রামবাসীর ওপর অকাতরে হত্যাযজ্ঞ চালায়। ওই স্মৃতিস্তম্ভে পাকবাহিনীর গুলিতে নিহত ৬ জন মুক্তিকামী শহীদের নাম খোদাই করা আছে। তারা হলেন- জাহান আলী সরদার, জফি উদ্দিন সরদার, শফিউদ্দিন, আব্দুল জলিল মন্ডল, তায়েজ উদ্দিন মন্ডল ও হোসেন উদ্দিন। এইগ্রামের পাশে চকদৌলত গ্রামে রয়েছে আরও একটি গণকবর। এখনে তিনজনকে নির্মমভাবে হত্যা করে পাকবাহিনী। মহাদেবপুর উপজেলা প্রকৌশলী সুমন মাহমুদ জানান, উপজেলার ৮টি গণকবরের তালিকা করা হয়েছে। এসব স্থানে প্রয়োজনীয় স্থাপনা নির্মাণ করা হবে বলেও তিনি জানান। উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের সাবেক কমান্ডার বদিউজ্জামান বদি গণকবরগুলো চিহ্নিত করে সেগুলো সংরক্ষণ ও সংস্কারের উদ্যোগ না নেওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন। উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ভারপ্রাপ্ত কমান্ডার ইউএনও মো. মিজানুর রহমান মিলন জানান, উপজেলার ১০টি ইউনিয়নের ১১৩ জন বীরমুক্তিযোদ্ধার কবর বাঁধাই করার জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে। প্রথম পর্যায়ে অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া ১৩ বীর মুক্তিযোদ্ধার বাড়ি নির্মাণ করে দেওয়া হবে বলেও জানান তিনি। মহাদেবপুর উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আরিফ প্রামাণিক জানান, মুজিব জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে উপজেলার ১০টি ইউনিয়নের প্রত্যেকটিতে একটি করে রাস্তা সেখানকার বীর মুক্তিযোদ্ধার নামে নামকরণ করার প্রক্রিয়া চলছে। তিনি জানান, এখানে মোট ২১৬ জন তালিকাভুক্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন। তারা সবাই সরকারি ভাতা পান।