বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের নিরাপত্তা নিয়ে নানা প্রশ্ন

চট্টগ্রাম প্রতিনিধি
  ০৯ মার্চ ২০২১, ০০:০০
চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার

অমিত মুহুরী হত্যাকান্ড, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠনের বোর্ড মিটিং, বন্দি নির্যাতনের অভিযোগ থেকে সাম্প্রতিক সময়ে নানা প্রশ্ন দেখা দেয় চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের নিরাপত্তা নিয়ে। এর মধ্যে ৬ মার্চ শনিবার ভোরে ফরহাদ হোসেন রুবেল নামে এক হাজতি উধাওয়ের ঘটনা-সেই প্রশ্ন আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।

তবে এই ঘটনা তদন্তে কারা অধিদপ্তর ও চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের পৃথক তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার শফিকুল ইসলাম খান।

তিনি বলেন, 'খুলনা বিভাগীয় উপ-কারাপরিদর্শক ছগির মিয়াকে প্রধান করে কারা অধিদপ্তরের তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিতে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা কারাগারের জেল সুপার ইকবাল হোসেন ও বান্দরবান জেলা কারাগারের জেলার ফোরকান ওয়াহিদকে সদস্য করা হয়েছে। আগামী ৭ কর্মদিবসের মধ্যে তাদের তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে। ৮ মার্চ সোমবার বিকাল থেকে তদন্ত কমিটি কাজ শুরু করেছেন।

এর মধ্যে তদন্ত কমিটির প্রধান ছগির মিয়া বলেন, 'আমরা প্রথমে কারাগারের নিরাপত্তার দিকটি দেখব। এরপর নিখোঁজ বন্দির সর্বশেষ অবস্থান কোথায় ছিল, কখন সে আদালতে হাজিরা দিতে গিয়েছে। পালিয়ে থাকলে কারাগারের কঠোর নিরাপত্তাবেষ্টনী ভেদ করে সে কীভাবে, কার বা কাদের সহযোগিতায় পালাতে সক্ষম হয়েছে। দায়িত্ব পালনে মূলত কার গাফিলতি ছিল-এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজা হবে।'

এদিকে রোববার বিকাল চারটার দিকে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার পরিদর্শনে যান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. শহিদুজ্জামান। এ সময় তিনি চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করার কথা জানান।

কমিটিতে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক সুমনি আক্তারকে আহ্বায়ক, এডিসি (ট্রাফিক-উত্তর) মোহাম্মদ রাশেদুল ইসলাম ও চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের ডেপুটি জেলার মো. মাজহারুল ইসলামকে সদস্য করা হয়। জানতে চাইলে কমিটির আহ্বায়ক সুমনি আক্তারও কারাগারের নিরাপত্তা নিয়ে খতিয়ে দেখার কথা জানান।

গত কয়েকদিন আগে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে হাজতি রূপম কান্তি নাথের ওপর নির্যাতনের অভিযোগে তার পরিবার কারাগারের জেল সুপারসহ ৪ জনের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা দায়ের করেন। আদালত মামলাটি তদন্তের জন্য পুলিশ বু্যরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) নির্দেশ দিয়েছেন।

মামলার এজাহারে রূপম কান্তি নাথের স্ত্রী ঝর্ণা নাথ অভিযোগ আনেন, 'রূপম কান্তি নাথ যে মামলায় আসামি হয়ে চট্টগ্রাম কারাগারে গেছেন, সেই মামলার বাদী রতন ভট্টাচার্যের যোগসাজশে রূপমকে স্থায়ীভাবে মানসিক ভারসাম্যহীন করার জন্য বৈদু্যতিক শক দিয়ে ১

শারীরিক নির্যাতন করার পাশাপাশি বিষাক্ত নেশাজাতীয় দ্রব্য তার শরীরে পুশ করেছে।'

নির্যাতনের খবর পেয়ে গত ২৫ ফেব্রম্নয়ারি বন্দি রূপমের পরিবার তার চিকিৎসার আবেদন করলে আদালত তা মঞ্জুর করেন। রূপম কান্তি নাথ বর্তমানে কারা কর্তৃপক্ষের হেফাজতে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।

এর আগে ২০১৯ সালের ২৯ মে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে রিপন নামে এক কয়েদির ইটের আঘাতে খুন হন পুলিশের তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী অমিত মুহুরী। অমিত ছিলেন ১৭ মামলার আসামি। তিনি চট্টগ্রাম কারাগারের ৩২ নম্বর সেলের ৬ নম্বর কক্ষে থাকতেন।

এ ঘটনার পর অমিতের বাবা অরুণ মুহুরী অভিযোগ করেন, চট্টগ্রামের এক যুবলীগ নেতা টাকার বিনিময়ে পরিকল্পিতভাবে তার ছেলেকে কারাগারে খুন করিয়েছেন। তার প্রশ্ন, 'কারাগারের সেলের মতো সুরক্ষিত জায়গায় কীভাবে ইট এল? ঘটনার আগে রিপন এনেছিলেন নাকি কেউ তাকে দিয়ে গেছেন? দিয়ে গেলে ওই ব্যক্তি কে বা কারা? নাকি কোনো কারারক্ষী দিয়ে গেছেন? বন্দি রিপন নাথের সঙ্গে আর কেউ ছিলেন কি না, কারও ইন্ধনে এই ঘটনা কি না?' এসব প্রশ্নের উত্তর আজও মেলেনি।

অমীমাংসিত থেকে গেছে আরও দুটো বিষয়। অমিত মুহুরীর মতো শীর্ষ সন্ত্রাসীকে রিপনের মতো একজন গার্মেন্টকর্মী খুন করার সামর্থ্য রাখেন কি না? নগর গোয়েন্দা পুলিশ যখন কারাগারের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করেছিল, তখন ঘটনার আগে বিকাল ৪টা ৫৭ মিনিট থেকে ৫টা ৭ মিনিট পর্যন্ত ১০ মিনিট ক্যামেরায় কালো স্ক্রিন ও ঝিরঝির শব্দ দেখা যায়। এই ১০ মিনিটে কাদের উপস্থিতি ছিল? সেটিও থেকে গেছে অজানা।

কারাগারের নিয়ম অনুযায়ী, সেলের তালা বন্ধ করার আগে সিআইডি কারারক্ষী, সিআইডি প্রধানরক্ষী এবং সুবেদার প্রত্যেক ওয়ার্ড ও সেলে নিষিদ্ধ এবং ক্ষতিকর কোনো বস্তু রয়েছে কি না তা পরীক্ষা করেন। পরীক্ষার পর কারাগারের রেজিস্টার বইয়ে তা লিখতে হয়।

ঘটনার দিন সিআইডি কারারক্ষী হাবিবুল বাশার, সিআইডি রক্ষী লুৎফর কবির এবং সুবেদার সালামত উলস্নাহ ৩২ নম্বর সেলের দায়িত্ব পালন করেন। ওই দিন ওয়ার্ড ও সেল তালাবদ্ধ করার আগে অন্যান্য দিনের মতো পরিদর্শন শেষে সেলে ক্ষতিকর ও নিষিদ্ধ কোনো বস্তু নেই বলে কারা রেজিস্টারে উলেস্নখ করা হয়।

একইভাবে ১৯৯৮ সালে এই কারাগারে শীর্ষ সন্ত্রাসী আলমকে গলায় বেস্নড চালিয়ে খুন করেন আরেক বন্দি। ভারতীয় নাগরিক জিবরান তায়েবী হত্যা মামলার আসামি ওসমানকে ২০০০ সালে ছুরিকাঘাতে খুন করেন অপর এক বন্দি।

এছাড়া কারাগারে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের বোর্ড মিটিং করার অভিযোগও উঠেছে কারা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। গত বছরের ২৫ নভেম্বর চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে চাঞ্চল্যকর তথ্য নিয়ে হাজির হন চট্টগ্রাম বন্দরের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোয়াজ্জেম হোসেন খান।

তার অভিযোগ, জেলবন্দি অবস্থায় কারাগারের ভেতরেই কেডিএস গ্রম্নপের প্রতিষ্ঠান কেওয়াই স্টিলের ব্যবসায়িক নীতিনির্ধারণী সভা অনুষ্ঠিত হতো। ২০১৮ সালের ১১ এপ্রিল বিকালে এমন এক সভা চলাকালে প্রতিষ্ঠানের সাবেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা মনির হোসেন খানকে কারাগারের ভেতরে মারধর করা হয়।

মোয়াজ্জেম হোসেন খানের তথ্যমতে, ঘটনাটি ঘটে জেলসুপারের কক্ষের পাশে কনফারেন্স রুমে। কেডিএসের অ্যাকাউন্টস ইনচার্জ ইমরান হাসান ও জিএম আব্দুল কালামও তখন সেখানে উপস্থিত ছিলেন। কাগজে-কলমে পদ-পদবি না থাকলেও বাবার প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার ইয়াছিন রহমান টিটু। ভারতীয় নাগরিক ও পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের উচ্চপদস্থ এক কর্মকর্তার সন্তান জিবরান তায়েবী হত্যা মামলায় দন্ডিত হয়ে চট্টগ্রাম কারাগারে কারাভোগ করছেন তিনি।

এসব অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের জেল সুপার শফিকুল ইসলাম বলেন, 'চট্টগ্রাম কারাগারে বন্দি নিখোঁজের ঘটনা তদন্তাধীন ও বন্দি নির্যাতনের অভিযোগে দায়েরকৃত মামলাও আদালত পিবিআইকে তদন্তের আদেশ দিয়েছেন। তাই এ বিষয়ে এখন কিছু বলছি না। আর আগের ঘটনাগুলো যখন ঘটেছে তখন আমি ছিলাম না। তাই কিছুই বলতে পারছি না।'

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে