বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

এক বিবর্ণ বইমেলার সমাপ্তি

পাঠক দর্শনার্থীশূন্য এমন বিরান মেলা প্রাঙ্গণ ছিল নজিরবিহীন। এমনকি মেলার শেষ দিনে অনেক স্টলে বিক্রি হয়নি একটিও বই। ফলে পাহাড় সমান লোকসান মাথায় নিয়েই বইমেলা ছেড়েছে অধিকাংশ প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান
যাযাদি রিপোর্ট
  ১৩ এপ্রিল ২০২১, ০০:০০
অমর একুশে বইমেলার শেষ দিন সোমবারও কিছু দর্শনার্থী বই কিনতে ও দেখতে আসেন। ছবিটি রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে তোলা -যাযাদি

শুরুটা হয়েছিল নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটিয়ে। তবুও এবারের বইমেলাকে বলা হয়েছে নিয়ম রক্ষার বইমেলা। প্রতিবার ১ ফেব্রম্নয়ারি শুরু হতো অমর একুশে বইমেলা। এবারই প্রথম করোনার কারণে ১৮ মার্চ থেকে শুরু হয়েছে বাঙালির এই প্রাণের মেলা। এরপর টানা ২৬ দিন অপেক্ষায় ছিলেন প্রকাশকরা। কখন ক্রেতা আসবেন, পছন্দের বইটি কিনবেন। কিন্তু করোনা যেন সবকিছু উলটপালট করে দিল। এ অবস্থায় সোমবার শেষ হলো বিবর্ণ এক বইমেলার আয়োজন। অনেকটা নীরবেই বিদায় নিলো অমর একুশে বইমেলা ২০২১। দেশে করোনাভাইরাসে প্রতিদিন মৃতু্যর রেকর্ড, লকডাউন আর চৈত্রের প্রখর উত্তাপ সামনে দাঁড়াতেই দেয়নি বাঙালির প্রাণের এই উৎসবকে। পাঠক দর্শনার্থীশূন্য এমন বিরান মেলা প্রাঙ্গণ ছিল নজিরবিহীন। এমনকি মেলার শেষ দিনে অনেক স্টলে বিক্রি হয়নি একটিও বই। ফলে পাহাড় সমান লোকসান মাথায় নিয়েই বইমেলা ছেড়েছেন প্রায় অধিকাংশ প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান।

প্রকাশনা সংশ্লিষ্টদের মতে, ফাগুনের মেলা চৈত্রে আয়োজনে শুরুতেই খানিকটা রং হারিয়েছে বইমেলা। আর বাকিটা কেড়ে নিয়েছে করোনা পরিস্থিতির হঠাৎ অবনতি, লকডাউন ও মেলার সীমিত সময়সূচি।

বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশনা সমিতির তথ্যমতে এবারের মেলা প্রাঙ্গণ ও অনলাইন মিলিয়ে বই বিক্রি হয়েছে মাত্র ৮ থেকে ১০ কোটি টাকা। গতবার যা ছিল প্রায় ৮৫ কোটি টাকা। যদিও এবারের মেলার স্থায়ীকাল ছিল ২৬ দিন। এবারের মেলায় প্রায় সাড়ে ৬শ' প্রতিষ্ঠান অংশগ্রহণ করলে শেষ পযর্ন্ত টিকে থাকতে পরেনি অনেকেই। আর্থিক ক্ষতি কমিয়ে আনতে মাঝপথেই মেলা থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছে এসব প্রতিষ্ঠান।

এসব প্রকাশক বলছেন, 'গতবার যেখানে প্রতিদিন ৩০ থেকে ৫০ হাজার টাকার বই কেনাবেচা হতো সেখানে এখন দিনে সর্বোচ্চ হলে ১০টি বই বিক্রি করেছেন। এমনও অনেক দিন ছিল যেদিন অনেক স্টলে বই বিক্রি ছিল একেবারে শূন্যের কোঠায়। বড় অঙ্কের ব্যাংক ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে ফিরেতে হচ্ছে শূন্য হাতে। তাই কোনো মতে কর্মীদের বেতন দিয়ে লকডাউনের আগেই মেলা ছেড়েছেন তারা।'

একেবারে খালি হাতে না ফিরলেও বিনিয়োগের ২০ ভাগ তুলতেই ব্যর্থ হয়েছে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠিত প্রকাশনা ও বড় প্যাভিলিয়নগুলো। গড়ে প্রায় ৪ থেকে ৫ লাখ টাকা ব্যয় করে প্যাভিলিয়নের সাজসজ্জা এবং স্টল কর্মীদের বেতনের সমান বইও বিক্রি করতে পারেনি অনেক প্রকাশনা।

সংশ্লিষ্টজনরা বলছেন, 'করোনার কারণে এমনিতেই মেলা শুরুতে তেমন জমে ওঠেনি। তবে যখন মেলা জমার পথে তখনই মেলার সময় সীমিত করে দেওয়ায় তার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এছাড়া চৈত্রের বৈরী প্রকৃতিও বাদ সেধেছে বইমেলায়। সর্বশেষ সরকার ঘোষিত লকডাউনে তা নিয়ম রক্ষার বইমেলায় রূপ নেয়।'

সাধারণত মেলার প্রথম ২০ দিনের তুলনায় শেষ সপ্তাহে বই বিক্রির পরিমাণ বাড়ে। এমন আশা নিয়ে অনেক প্রকাশক অপেক্ষা করেছিল বলে জানান প্রকাশক নেতা ফরিদ আহমেদ। নইলে অনেকইে নির্ধারিত সমেয়ের আগেই মেলা ছেড়ে চলে যেতেন। তবে করোনার হানায় তা আর হয়ে ওঠেনি। শেষ দশ দিনে বিক্রি প্রথম দশ দিনের অর্ধেকও হয়নি বলে জানায় সময় প্রকাশনার এই প্রকাশক। তিনি বলেন, সৃজনশীল প্রকাশনা শিল্প মূলত এই মেলাকে কেন্দ্র করেই পরিচালিত হয়। বছরজুড়েই মেলাকে ঘিরে চলে সব প্রস্তুতি। কিন্তু এবারকার পরিস্তিতি হয়ত অনেককেই ভিন্নভাবে ভাবতে বাধ্য করবে। গত বছর করেনার প্রকোপে বেশ কিছু প্রকাশনা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এবারে মেলা পরিস্তিতি এই চিত্র আরও ভয়াবহ হতে পারে।

তবে করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে ১৪ তারিখের লকডাউনের আগেই মেলা বন্ধের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে প্রকাশকরা। তারা বলেন সবার আগে মানুষের জীবন, সেখানে মেলা গুরুত্বপূর্ণ নয়। অন্বেষার প্রকাশক সাহাদাৎ হোসেন জানান, 'যা হওয়ার হয়ে গেছে, এখন কীভাবে প্রকাশরা ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পার তা নিয়ে কাজ করতে হবে। যদি সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো বইমেলায় অংশ নেওয়া বিভিন্ন প্রকাশনা থেকে বই সংগ্রহ করে তাহলে ক্ষতি অনেকটাই কমে আসবে। এক্ষেত্রে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে আবেদন করা হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ প্রতিষ্ঠান এবং বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যেন সরাসরি প্রকাশনা থেকে বই সংগ্রহ করেন তার অনুরোধ জানান এই প্রকাশক।'

এ বছর প্রথমা, অন্বেষা বা সময়ের মতো প্রতিষ্ঠিত প্রকাশনীগুলো গড়ে মাত্র ৩০ থেকে ৩৫টা নতুন বই এনেছে। সেখানে কালি কলম কিংবা দাড়ি কমার মতো ছোট প্রকাশনাগুলো গড়ে ২০ থেকে ২৫টি নতুন বই এনেছে। ঝুঁকি নিয়ে এ ছোট প্রতিষ্ঠানগুলো মেলায় বড় অঙ্কের অর্থ বিনিয়োগ করে এখন তাদের পথে বসার পালা। আর তাই গত এক সপ্তাহ ধরে মেলা বাদ দিয়ে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের দ্বারস্থ হচ্ছেন বই সংগ্রহের অনুরোধ নিয়ে। এছাড়া দেশর বিভিন্ন জেলায় বই পাঠানোসহ অনলাইন পস্ন্যাটফর্মগুলোর কাছেও বই জমা দিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন।

বাঙালি ও বাংলা সাহিত্যে অমর একুশে বইমেলার গুরুত্ব অনেক। নতুন লেখক সৃষ্টি ও পাঠক তৈরির মধ্য দিয়ে বইমেলা সাহিত্য কর্মের ধারা অক্ষুণ্ন রেখেছে। আর একুশে বইমেলা মানেই নতুন বই। নতুন সব গল্প, উপন্যাস, আর কবিতার যত জয়গান। লেখক পাঠকের সমাবেশ আর সাহিত্যের আড্ডা। তবে এবারের বইমেলায় নতুন বইয়ের সংখ্যা নেমে এসছে অর্ধেকে। শুধু তাই নয়, করোনার পরিস্থিতি বিবেচনায় এবার নতুন লেখকের বই ছাপানোর ঝুঁকি নেয়নি অনেকেই। প্রতিবার যেখান বিভিন্ন প্রকাশনার নতুন বইয়ের ১০ শতাংশ থাকে নতুন লেখকের সেখানে তা এবার শূন্যের কোঠায়। আর যারা ছাপিয়েছেন তাদের দিতে হয়েছে চড়া অঙ্কের অর্থ।

নতুন বই নেই এমন অনেক প্রকাশনা রয়েছে। এছাড়া শিশু একাডেমির মতো সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো এবার নতুন বইশূন্য। মেলার শেষ দিনে নতুন বই এসছে ৬৪টি। গতবার সর্বমোট প্রায় ৫ হাজার নতুন বই এলেও এবার এসেছে ২৬৪০টি। এর মধ্যে গল্প ৩৩৯, উপন্যাস ৪০৫, প্রবন্ধ ১৫৮, কবিতা ৮৯৮, গবেষণা ৪৯, ছড়া ৫০, শিশুসাহিত্য ৪১, জীবনী ৮৩, রচনাবলি ১৭, মুক্তিযুদ্ধ ৮১, নাটক ১৩, বিজ্ঞান ৪২, ভ্রমণ ৩৬, ইতিহাস ৬১, রাজনীতি ১৬ চি:/স্বাস্থ্য-১২, বঙ্গবন্ধু ৫১, রম্য/ধাঁধা ১৪, ধর্মীয় ৩৫, অনুবাদ ৩০, সায়েন্স ফিকশন ২১ ও অন্যান্য ১৮৩টি বই।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে