শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

পদ্মা সেতু খুলে দেবে অর্থনীতির দুয়ার

আলতাব হোসেন
  ০৩ মে ২০২১, ০০:০০
নির্মাণাধীন পদ্মা সেতু -ফাইল ছবি

মাওয়া প্রান্তে শনিবার সর্বশেষ গার্ডার স্থাপনের মধ্য দিয়ে পদ্মা সেতুর পুরো স্ট্রাকচারের কাজ শেষ হয়েছে। এ নিয়ে এখন পর্যন্ত মূলসেতু নির্মাণের অগ্রগতি শতকরা ৯৩ দশমিক ২৫ শতাংশ বলে জানিয়েছেন সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।

এর ফলে পদ্মা সেতু এখন আর স্বপ্ন নয়, দৃশ্যমান বাস্তবতা। আগামীতে দেশের অর্থনীতির দুয়ার খুলে দেবে পদ্মা সেতু। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কৃষিতে আনবে নতুন বিপস্নব, বাড়বে কর্মসংস্থান। পদ্মা সেতু ঘিরে ইতোমধ্যে বাড়ছে পর্যটন সম্ভাবনা। দুই পাড়ে সিঙ্গাপুর ও চীনের সাংহাই নগরের আদলে গড়ে উঠবে পর্যটন শহর। পদ্মা সেতু দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে যোগাযোগ ও বাণিজ্য বাড়াবে। পায়রা ও মোংলা সমুদ্রবন্দর এবং বেনাপোল স্থলবন্দরের সঙ্গে রাজধানী এবং বন্দর নগরী চট্টগ্রামের মধ্যে যোগাযোগ তৈরি করবে এ সেতু। এতে দেশের মোট জিডিপি প্রবৃদ্ধি পাঁচ শতাংশ বৃদ্ধির আশা দেখছেন অর্থনীতিবিদরা।

পদ্মা সেতুতে শেষ স্প্যানটি বসানোর পর থেকেই আশপাশের এলাকায় বিনিয়োগ বাড়তে শুরু করেছে। শিল্প প্রতিষ্ঠান নির্মাণের কাজ চলছে দ্রম্নত গতিতে। কৃষি-শিল্প-অর্থনীতি-শিক্ষা-বাণিজ্য সব ক্ষেত্রেই পদ্মা সেতু বিশাল ভূমিকা রাখবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে পদ্মা সেতু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

এছাড়া পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে নদীর পাশেই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট সিটি, হাইটেক পার্ক, অলিম্পিক ভিলেজ, কয়লাভিত্তিক বিদু্যৎ কেন্দ্র নৌবন্দর, অভ্যন্তরীণ কনটেইনার টার্মিনাল, বিশেষ অর্থনৈতিক জোন, ইকোনমিক করিডোর, আধুনিক রেল, সড়ক ও নৌ-এই ত্রিমুখী যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। পদ্মা সেতুসংলগ্ন জাজিরার নাওডোবা এলাকায় প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে শেখ হাসিনা তাঁতপলস্নী গড়ে তোলা হচ্ছে। সেখানে আধুনিক আবাসন, শিক্ষা-চিকিৎসাসহ আধুনিক সব সুযোগ-সুবিধা রাখা হবে। এ প্রকল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণসহ বেশকিছু কাজ এগিয়েছে। পদ্মা সেতু বদলে দেবে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার মানুষের জীবনমান। জলবায়ুর প্রভাবে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের লাখ লাখ মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে ঢাকাসহ বড় শহরে কাজের জন্য আসছেন। পদ্মা সেতু চালু হলে ওই অঞ্চলের কৃষি-মৎস্য উৎপাদন ও কর্মসংস্থান বাড়বে। জলবায়ু উদ্বাস্তুরা সেখানে কাজের সুযোগ পাবেন।

পদ্মা সেতুর বহুমুখী সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে একটি সমন্বিত গবেষণা কার্যক্রম চলছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, স্থানীয় সরকার, সেতু বিভাগ এবং বাংলাদেশ ব্যাংক যৌথভাবে এই গবেষণা পরিচালনা করছে। গবেষণার খসড়া প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পদ্মা সেতুকে ঘিরে দুই পাড়ে প্রায় ৩০ শতাংশ নির্মাণকাজ বাড়বে, সাড়ে নয় শতাংশ কৃষিকাজের প্রবৃদ্ধি হবে, আট শতাংশ বাড়বে উৎপাদন ও পরিবহণ খাতের কাজ। পদ্মা সেতু খুলে দিলে সার্বিকভাবে ২০৩০ সালের মধ্যে পাঁচ কোটি মানুষের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে দারিদ্র্র্যের হার কমবে এক শতাংশ।

ইতোমধ্যে পদ্মা সেতুকে ঘিরে দুই পাড়ে জমির মূল্য বেড়ে গেছে। বিভিন্ন শিল্প কলকারখানা ও অত্যাধুনিক আবাসিক এলাকা স্থাপন হচ্ছে। প্রতিদিনই নির্মাণাধীন সেতুটি দেখতে ভিড় করছেন মানুষ। পদ্মা সেতুকেন্দ্রিক পর্যটন শিল্প বিকাশের পরিকল্পনা নিয়েছে সেতু বিভাগ।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বু্যরোর (বিবিএস) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পদ্মা সেতু চালু হলে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশে উন্নীত হতে পারে। বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলোর রিপোর্টে বলা হয়েছে, পদ্মা সেতু চালু হলে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাড়বে এক শতাংশ হারে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) মতে, এ সেতুর ফলে দেশের জিডিপি এক দশমিক দুই ও আঞ্চলিক জিডিপি তিন দশমিক পাঁচ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। বিবিএস এসব তথ্য বিশ্লেষণ করে বলছে, এই পরিমাণ জিডিপি বাড়লে পদ্মা সেতু দেশের অর্থনীতিতে বছরে ৩৫ হাজার কোটি টাকার জোগান বাড়াবে। পদ্মা সেতু প্রতি বছর বাংলাদেশের জিডিপিতে প্রায় ১.২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নিয়ে আসবে বলে মনে করছে চীন।

পদ্মা সেতুর নদী শাসন প্রকল্পে যুক্ত ছিলেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত। তিনি যায়যায়দিনকে বলেন, পদ্মা সেতুর সড়ক ও রেললাইন দক্ষিণাঞ্চলের যশোর পর্যন্ত যাবে। এশীয় হাইওয়ের সঙ্গে যুক্ত হবে এই সেতুর যোগাযোগ। প্রতিবেশী দেশ ভারত, নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে বাণিজ্যিক যোগাযোগ গড়ে উঠবে। দক্ষিণাঞ্চলে অর্থনৈতিক অঞ্চল ও শিল্পকারখানা গড়ে উঠবে। এতে ওই অঞ্চলের মানুষের কর্মসংস্থান ও সারা দেশের সঙ্গে যোগাযোগ সহজ হবে।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সিনিয়র গবেষক এম আসাদুজ্জামান যাযাদিকে বলেন, কৃষকের উৎপাদিত পণ্য দ্রম্নত ভোক্তাদের কাছে কম খরচে পৌঁছাবে। বদলে যাবে কৃষিতে উন্নত দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের জীবনমান। সেতুটি দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোতে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। পদ্মা সেতুর মাধ্যমে আঞ্চলিক বাণিজ্য সমৃদ্ধ হবে, কমবে মানুষ ও পণ্য পরিবহণের সময় ও অর্থ। এ সেতুর মাধ্যমে শিল্পায়ন ও বাণিজ্যিক কর্মকান্ড প্রসারের লক্ষ্যে পুঁজির জোগান বাড়বে।

এফবিসিসিআই সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট মুনতাকিম আশরাফ যাযাদিকে বলেন, পদ্মা সেতুতে বদলে যাবে দেশের অর্থনীতি। অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে যুক্ত হবে বহুমুখী খাত। সেতুর মাওয়া অংশ থেকে ঢাকা, মানিকগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জের সঙ্গে যুক্ত হয়ে অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াবে পদ্মা সেতু। দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ চিকিৎসা, শিক্ষাসহ অন্যান্য সুবিধা নিতে সরাসরি ঢাকায় আসতে পারবেন। এই যোগাযোগের ফলে পুরো দক্ষিণাঞ্চলের চেহারাই পাল্টে যাবে। পুরো দেশের অর্থনীতিতে এর প্রভাব পড়বে। আঞ্চলিক, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক যোগাযোগ বেড়ে যাবে। মৃতপ্রায় মোংলা বন্দর ঘুরে দাঁড়াবে। বিদেশি বিনিয়োগ বাড়বে। গড়ে উঠবে পর্যটন শিল্প। খুলনা-মোংলা রেললাইন স্থাপনসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে রেলের উন্নয়ন চলছে। বেনাপোল থেকে যশোর, নড়াইল ও ভাটিয়াপাড়া ছুঁয়ে এশিয়ান হাইওয়ের সঙ্গে যুক্ত হবে।

পদ্মা সেতুর ফলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১টি জেলা- যশোর, খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, ঝিনাইদহ, নড়াইল, মাগুরা, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারীপুর, বরিশাল, পিরোজপুর, ভোলা, পটুয়াখালী, বরগুনা, ঝালকাঠি শরীয়তপুর ও রাজবাড়ী এলাকার তিন কোটি মানুষের ভাগ্যের চাকা ঘুরবে দ্রম্নত। এ ছাড়াও পদ্মা সেতুর উত্তরে মুন্সীগঞ্জের মাওয়া, দক্ষিণে শরীয়তপুর ও মাদারীপুরের জাজিরা এলাকার মানুষ ব্যাপক লাভবান হবেন।

পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান যায়যায়দিনকে বলেন, বাংলাদেশের উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রায় পদ্মা সেতুর সংযোজন শেখ হাসিনা সরকারের এক অবিস্মরণীয় অবদান। দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও সক্ষমতা ইতিহাস হয়ে থাকবে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের গ্রামীণ অর্থনীতির ভিত্তি যেমন শক্তিশালী হবে, তেমনি জাতীয় অর্থনীতির চাকাও গতিশীল হবে। দেশি বিনিয়োগের চেয়ে বিদেশি বিনিয়োগ এ অঞ্চলে বেশি আসবে। কৃষি-শিল্প-অর্থনীতি-শিক্ষা-বাণিজ্য সব ক্ষেত্রেই পদ্মা সেতুর বিশাল ভূমিকা থাকবে। পদ্মার দুই পারে অর্থনৈতিক জোন গড়ে উঠবে। মোংলা বন্দরে বেশ কয়েকটি সিমেন্ট ফ্যাক্টরি গড়ে উঠেছে। গার্মেন্টসহ রপ্তানিমুখী নানা ধরনের শিল্প-কারখানাগুলো স্থাপনের পরিকল্পনা করা হচ্ছে।

প্রসঙ্গত, ছয় দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এই বহুমুখী সেতুর মূল আকৃতি দোতলা। কংক্রিট ও স্টিল দিয়ে নির্মিত পদ্মা সেতু। সেতুর ওপরের অংশে যানবাহন ও নিচ দিয়ে চলবে ট্রেন। মূল সেতু নির্মাণের জন্য কাজ করছে চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেড (এমবিইসি) ও নদী শাসনের কাজ করছে দেশটির আরেকটি প্রতিষ্ঠান সিনো হাইড্রো করপোরেশন।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে