টসটসে রঙিন হলেও ওগুলো পাকা নয়

প্রকাশ | ০৫ মে ২০২১, ০০:০০

আলতাব হোসেন
কৃত্রিম রং মেশানো অপরিপক্ব আম -ফাইল ছবি
আম খেতে ভালোবাসেন না, এমন বাঙালি পাওয়া কঠিন। আমের নাম শুনলে শুধু জিভে জল নয়, পুরো মুখেই রসের সঞ্চার হয়। সাধারণত মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহে আম পাকতে শুরু করে। অথচ এখনই ফলের রাজা আমের রসালো ঘ্রাণ ছড়াতে শুরু করেছে। ঢাকাসহ সারাদেশে ফলের দোকানে শোভা পাচ্ছে পাকা, টসটসে আম। রাজধানীর অভিজাত এলাকাগুলোতে আম বিক্রি হচ্ছে ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা কেজি দরে। চড়া দামে এসব আম কিনে প্রতারিত হচ্ছেন ক্রেতারা। বাজারে যে আম পাওয়া যাচ্ছে, তা স্বাভাবিকভাবে পাকা নয়। অপরিপক্ব কাঁচা আম কার্বাইড দিয়ে পাকিয়ে বিক্রি হচ্ছে। এসব আমের পচন ঠেকাতে ব্যবহার করা হচ্ছে ফরমালিন। ক্রেতার কাছে আকর্ষণীয় করতে মেশানো হচ্ছে কৃত্রিম রং। পাকা আমের মতো দেখতে হলেও এতে নেই পাকা আমের স্বাদ। রমজানে বেশি মুনাফার লোভে রাসায়নিক দিয়ে কৃত্রিমভাবে পাকানো আম মানবস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। মধু মাস জ্যৈষ্ঠ আসতে এখনো প্রায় সপ্তাহ দুয়েক বাকি। এর মধ্যেই রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন বাজার ও অলিগলিতে প্রতিকেজি আম বিক্রি হচ্ছে ২০০ থেকে ২৫০ টাকায়। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সাতক্ষীরা, রাজশাহীসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে এক অসাধু ব্যবসায়ীরা অপরিপক্ব আম কিনে বেশি লাভের আশায় বিভিন্ন ক্ষতিকর রাসায়নিক দিয়ে পাকিয়ে আগাম বাজারে তুলছেন। ঢাকার পাইকারি বাজার থেকে এসব আম ছড়িয়ে পড়ছে খুচরা বাজারে। রমজানে এমনিতেই বিভিন্ন ফলের চাহিদা বেড়ে যায় বাজারে। পাকা আম দেখে লোভ সামলাতে পারেন না অনেকেই। রাসায়নিক দিয়ে পাকানো আম হাতের কাছে পেয়ে চড়া দামেও কিনছেন ক্রেতারা। আকর্ষণীয় রঙের আম ফলের দোকানে থরে থরে সাজানো। জিভে জল আসার মতো এসব আম দেখে যারা ফাঁদে পড়বেন, তারাই ফাঁসবেন। আম বা অন্য ফল পাকাতে রাসায়নিক দ্রব্য মেশানোর অভিযোগ বেশ পুরনো। খাদ্যবিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আম পাকাতে পর্যায়ক্রমে মেশানো হয় হাইড্রোজেন পার অক্সাইড, কার্বাইড ও ফরমালিনের মতো রাসায়নিক। ফলের ভরা মৌসুম শুরুর আগে ভেজাল ও রাসায়নিক রোধে কঠোর অভিযান পরিচালনার দাবি পুষ্টিবিদ ও ভোক্তাদের। বিক্রেতাদের কেউ আমগুলোকে বলছেন সাতক্ষীরার আবার কেউ বলছেন রাজশাহীর আম। মিরপুর দশ নম্বর ওভারব্রিজে ওঠার সিঁড়ির পাশে আম বিক্রি হতে দেখা যায়। একজন আম বিক্রেতা রাজশাহীর গোবিন্দভোগ আম বলে বিক্রি করছেন প্রতিকেজি ১৮০ থেকে ২২০ টাকা দরে। এখন রাজশাহীর আম বাজারে আসছে কিনা জানতে চাইলে এই বিক্রেতা বলেন, তিনি যাত্রাবাড়ী আড়ত থেকে পাইকারি কিনে এনেছেন। রাজধানীর ফুটপাত থেকে শুরু করে বনানী কাঁচা বাজার, নিউমার্কেট, মোহাম্মদপুর কৃষি মাকের্ট, কারওয়ান বাজার, ফার্মগেট, মালিবাগ, মিরপুর ১০ এবং এক নম্বর ফলপট্টি, শেওড়াপাড়া ফলবাজার, পুরানা পল্টন, হাতিরপুল, মতিঝিল, বাজারে এখন কার্বাইড দিয়ে পাকানো আম বিক্রি হচ্ছে। রাজধানীর সবচেয়ে বড় ফলের আড়ত বাদামতলীতে প্রতিদিনই শত শত ট্রাকভর্তি আম আসছে। পুষ্টি বিশেষজ্ঞ ডা. নাজনীন আলম বলেন, কার্বাইড দিয়ে পাকানো আম বা অন্য ফলে লিভারের সমস্যাসহ ক্যানসার হওয়ার ঝুঁকি থাকে। তিনি বলেন, কাঁচা আমে আছে ক্যারোটিনয়েড, ভিটামিন ই, ভিটামিন বিও ভিটামিন বি টুয়েলভ। এতে আছে ১৭ রকমের অ্যামাইনো এসিড। কাঁচা আমের আঁশ পাকস্থলিসহ পেটের অন্যান্য অঙ্গ ভালো রাখে। কাঁচা আম চর্বি কমাতে সাহায্য করে। তিনি আরও জানান, কাঁচা আমে রয়েছে উচ্চমাত্রার ভিটামিন এ, যা চোখের জন্য উপকারী। মিরপুরের ব্যাংক কর্মকর্তা আব্দুল রশিদ বলেন, বাজারে টসটসে পাকা আম দেখে এবং ইফতারিতে আম খাওয়ার ইচ্ছায় অফিস থেকে ফেরার পথে মতিঝিল থেকে ২৫০ টাকা কেজি দরে দুই কেজি আম কিনেছিলেন। ইফতারের আগে বাসায় গৃহকর্মী কেটে আমের আঁটি কাঁচা দেখতে পান। দেখতে পাকা হলেও সেগুলো স্বাদে টক। এরপর বুঝতে পারেন তিনি প্রতারিত হয়েছেন। তিনি বলেন, বাজারে পাকা আমের সঙ্গে কাঁচা আমও বিক্রি হচ্ছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমচাষি ইয়াকুব আলী যায়যায়দিনকে বলেন, গাছপাকা আম উঠতে আরও সময় লাগবে। মৌসুমের শুরুতে আকাশচুম্বী দাম পাওয়ার আশায় আম পাকাতে রাসায়নিক মেশাচ্ছে অসাধু কিছু লোক। এসব অতি মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের কারণে অপরিপক্ব পাকা আম কিনে চরম ক্ষতির শিকার হচ্ছে রোজাদার মানুষ। আম গাছ দেশের জাতীয় বৃক্ষ। আম ও আম গাছবাংলা সংস্কৃতির অপরিহার্য অংশ। বাংলা সাহিত্য ও লোকগাঁথায়ও আম নিবিড়ভাবে যুক্ত। বাংলাদেশের স্বাধীনতা দেশপ্রেমের অনুভূতির সঙ্গে আম গাছের সম্পর্ক রয়েছে। ১৭৫৭ সালে পলাশীর আম্রকাননে ব্রিটিশদের হাতে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার পরাজয়ে যে বেদনার ইতিহাস সৃষ্টি হয়েছিল, ১৯৭১ সালে মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আমবাগানে তার পরিসমাপ্তি ঘটে। মুক্তিযুদ্ধের সময় ১৭ এপ্রিল প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার শপথ নেয় এই আম্রকাননে।