বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

ভালো নেই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পাদুকাশিল্পীরা

করোনার কারণে অস্তিত্ব সংকটে কারখানাগুলো
মো. বাহারুল ইসলাম মোলস্না, ব্রাহ্মণবাড়িয়া
  ১১ মে ২০২১, ০০:০০
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একটি কারখানায় পাদুকা তৈরিতে ব্যস্ত কয়েকজন শ্রমিক -যাযাদি

করোনাভাইরাসের চলমান মহাঘাতে ভালো নেই ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পাদুকা (জুতা) শিল্পীরা। ১ বছরেরও অধিককাল ধরে করোনাভাইরাসজনিত কারণে অস্তিত্ব সংকটের মুখে পড়েছেন তারা।

একদিকে করোনা সংকট, অপরদিকে এই শিল্পের কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি ও চলতি লকডাউনের কারণে উৎপাদিত পাদুকা বাজারজাত করতে না পারায় কারখানার মালিকরা এখন দিশেহারা। ভরা মৌসুমেও মালিক শ্রমিকদের মাঝে বিরাজ করছে চরম হতাশা। অন্যান্য বছর পবিত্র ঈদুল ফিতরকে সামনে রেখে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পাদুকা শিল্পীরা ব্যস্ত সময় পার করলেও বর্তমানে সেই চিত্র আর নেই। ঢিমেতালে চলছে উৎপাদন।

পাদুকা কারখানার মালিক ও শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৯৮৪ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পাদুকা শিল্পের গোড়াপত্তন হয়। ব্যবসা লাভজনক হওয়ায় এখানকার লোকজন এই শিল্পের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। ফলে প্রতি বছরই বাড়তে থাকে নতুন নতুন কারখানা। জিপসি, লালা, রক্সি, সিটি, ইসপি, উডল্যান্ড, দেশ, সোহাগ, রানা, আরমান, কলেজ, শাপলা, শামীম, হাসান, মুরাদ, দিনা, সুসহ ছোট-বড় প্রায় তিন শতাধিক পাদুকা কারখানা গড়ে ওঠে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। এসব কারখানায় কাজ করত প্রায় ৮ হাজার শ্রমিক।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌর এলাকার পশ্চিম মেড্ডা পীর বাড়ি বাজার, সদর উপজেলার নাটাই উত্তর ইউনিয়নের বটতলী বাজার, ভাটপাড়া, রাজঘর, সুহিলপুর ইউনিয়নের সুহিলপুর ও তালশহর পূর্ব ইউনিয়নের অষ্টগ্রামে রয়েছে পাদুকা কারখানা।

এসব পাদুকা কারখানায় চামড়া, রাবার, সোল, ফোম ও রেক্সিন দিয়ে বিভিন্ন ডিজাইনের জুতা তৈরি করা হয়। আধুনিক, রুচিশীল, নতুন ডিজাইন, মানসম্মত ও টেকসই পাদুকা তৈরি হওয়ায় দেশের বিভিন্ন স্থানে দ্রম্নত ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জুতার বাজার জনপ্রিয়তা লাভ করে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তৈরি পাদুকা জেলার চাহিদা মিটিয়েও চলে যেত রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায়। কিন্তু বর্তমানে সেই অবস্থা আর নেই।

পাদুকা শিল্প মালিক সমিতি সূত্রে জানা গেছে, আগে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তিন শতাধিক কারখানা চালু থাকলেও ক্রমাগত লোকসানের কারণে বর্তমানে চালু প্রায় শ'খানেক কারখানা। এর মধ্যে ১৬টি স্বয়ংক্রিয় এবং বাকিগুলো সনাতনি (ম্যানুয়েল) পদ্ধতিতে চলে। এসব কারখানায় বর্তমানে প্রায় ৬ হাজার শ্রমিক কাজ করছেন।

পাদুকা কারখানার কয়েকজন মালিক বলেন, তাদের উৎপাদিত জুতা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাজারের চাহিদা মিটিয়ে ঢাকা, সিলেট, চট্টগ্রাম, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, কুমিলস্না, চাঁদপুর, ফেনী, লক্ষ্ণীপুর, ভৈরব, কিশোরগঞ্জ, টাঙ্গাইল, জামালপুর, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনাসহ বিভিন্ন জেলায় পাঠানো হয়। রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন অভিজাত মার্কেটেও পাওয়া যাচ্ছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পাদুকা। পাদুকা কারখানার মালিকরা আক্ষেপ করে বলেন, লকডাউনের কারণে পাদুকা তৈরির উপকরণের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় তাদের উৎপাদিত পাদুকা বিভিন্ন জেলায় বাজারজাত করতে না পারায় এই ব্যবসা হুমকির মুখে।

পাদুকা শিল্প মালিক সমিতি সূত্রে জানা গেছে, স্বয়ংক্রিয় কারখানার উৎপাদিত পাদুকার কাঁচামাল চীন থেকে আমদানি করা হয়। ফলে এই পাদুকা টেকসই ও মজবুত। বিদেশ থেকে আমদানি করা পাদুকার দামের তুলনায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কারখানাগুলোতে তৈরি পাদুকা দামেও অনেক সাশ্রয়ী। ফলে বাজারে এর চাহিদাও রয়েছে। বর্তমানে লকডাউনের কারণে এ শিল্পের কাঁচামালের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় উৎপাদন খরচ বহুগুণ বেড়েছে।

পাদুকা কারখানার কয়েকজন মালিক জানান, পাদুকা শিল্প মূলত মৌসুমভিত্তিক ব্যবসা। ঈদ উল ফিতরকে সামনে রেখে কয়েক মাস আগ থেকেই কারখানাগুলোতে দিন-রাত কাজ করে শ্রমিকরা। কিন্তু গত ১ বছরের অধিককাল ধরে করোনার প্রভাবে ও লকডাউনের কারণে কারখানার মালিকদের লোকসান গুনতে হচ্ছে। অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে সম্ভাবনাময় এই শিল্প। ক্রমাগত লোকসানের মুখে ইতিমধ্যে অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে।

পৌর এলাকার পীর বাড়ির সোহাগ সুজের মালিক সোহাগ মিয়া বলেন, গত ৭/৮ বছর ধরে এই ব্যবসা করছি, আমাদের এই ব্যবসা ভালোই ছিল। এই ব্যবসা করে আমার সংসার চলেছে। আমার কারখানায় কাজ করে ২০/২৫ জন কারিগরও (শ্রমিক) তাদের সংসার চালাচ্ছে। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে ও লকডাউনের কারণে কারখানায় উৎপাদিত পাদুকা অন্যান্য জেলায় পাঠাতে পারছি না, অন্যান্য জেলা থেকে অর্ডারও পাচ্ছি না। কারিগরদের কাজ না দিতে পারলে তারা অন্যত্র চলে যাবে। তাই বাধ্য হয়ে ধার-কর্জ করে কারখানা চালু রাখতে হচ্ছে।'

একই এলাকার দেশ সুজের মালিক জয়নাল মিয়া বলেন, 'দূরপালস্নার গাড়ি না চলায় মালামাল ডেলিভারি দিতে পারছি না। সময়মত মাল না পাঠানোর কারণে অনেক অর্ডারও বাতিল হয়ে যাচ্ছে। কুমিলস্না, নোয়াখালী, সিলেট, হবিগঞ্জ, গাজীপুরসহ দেশের অনেক জেলায় আমাদের প্রডাক্টের চাহিদা আছে।'

উডল্যান্ড সুজের মালিক কামাল মিয়া বলেন, 'আমার মালের চাহিদা আছে। কিন্তু লকডাউনের কারণে মালামাল পাঠাতে পারছি না। জুতার কাঁচামাল চীন থেকে আসে। করোনার কারণে এসব উপকরণের দাম বেড়ে যাওয়ায় জুতার লাভ এখন খুব কম হয়।' তিনি বলেন, 'আমাদের এলাকায় অনেক কারখানা ইতিমধ্যেই বন্ধ হয়ে গেছে। সরকার যদি ব্যাংক থেকে কম সুদে ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করে তাহলে আমরা আবার দাঁড়াতে পারতাম। কিন্তু বিভিন্ন শিল্পের জন্য সরকারি প্রণোদনার কথা শুনলেও আমরা এখন পর্যন্ত কোনো প্রণোদনা পাইনি।'

পাদুকা শিল্পী (কারিগর) রাশেদ মিয়া, জাহাঙ্গীর মিয়া ও আনোয়ার মিয়া বলেন, 'এই মৌসুমে আমরা প্রতি মাসে ৩০/৪০ হাজার টাকার কাজ করতাম। এই বছর ৫/৭ হাজার টাকার কাজ করতে পারিনি। কারণ মালিকের অর্ডার নাই, আমরা ছেলে-মেয়ে নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছি। ঈদে ছেলে-মেয়েদের চাহিদা কীভাবে মেটাবো তা নিয়ে চিন্তায় আছি।'

পাদুকা শিল্পী (কারিগর) রুহুল আমিন বলেন, 'আমি ঢাকায় জুতার কারখানায় কাজ করতাম। দেশে এসে ৭ বছর ধরে এই কারখানায় কাজ করছি। ভালোই ছিলাম। তবে লকডাউনে গভীর রাতে কারখানা থেকে ৪ কিলোমিটার দূরবর্তী বাসায় ফিরতে পুলিশের ভয়ে আতংকে থাকি।'

ব্রাহ্মণবাড়িয়া পাদুকা শিল্প মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক হাজী মো. মহসিন মিয়া বলেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় প্রায় ৩ শতাধিক কারখানা ছিল। এসব কারখানায় কাজ করত প্রায় ৮ হাজার কারিগর। ক্রমাগত লোকসানের মুখে শতাধিক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। তিনি বলেন, 'করোনাভাইরাস ও লকডাউনের কারণে আমাদের উৎপাদিত মালামাল বাইরে পাঠাতে পারছি না। সময়মতো মাল পাঠাতে না পারায় অর্ডারও বাতিল হচ্ছে।'

পাদুকা শিল্প মালিক সমিতির সভাপতি মো. শফিউদ্দিন বলেন, 'বছরে রোজার ঈদের সময়টা আমাদের ব্যবসার সময়। এই সময় প্রতিটি কারখানা কারিগর শ্রমিক ও দোকান ভাড়া দিয়ে ৪/৫ লাখ টাকা লাভ করতে পারত। গত বছর ও এই বছর লকডাউনের কারণে আমাদের ব্যবসার অবস্থা খুবই খারাপ। গাড়ি না চলার কারণে মালামাল ডেলিভারি দিতে পারছি না।

এ ব্যাপারে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলা প্রশাসক হায়াত উদ-দৌলা-খাঁন বলেন, 'আমরা পাদুকা শ্রমিকদের খাদ্য সহায়তা দিয়েছি। করোনাকালে ক্ষতিগ্রস্ত উদ্যোক্তাদের এসএমই সহায়তা প্রদানের জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোকে বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া আছে। উদ্যোক্তারা আবেদন করে সহায়তা না পেলে আমাকে জানালে অবশ্যই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।'

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে