শিক্ষক বঞ্চনা

ফিকে হচ্ছে এমপিওভুক্তির আশ্বাস

প্রকাশ | ১১ অক্টোবর ২০১৮, ০০:০০

এসএম মামুন হোসেন
এমপিওভুক্তির দাবিতে দফায় দফায় আন্দোলন করে সরকারের শীষর্ মহলের আশ্বাসে অনশন ভেঙে শিক্ষকরা বাড়ি ফিরলেও সেটা বাস্তবায়নের কোনো লক্ষণ নেই। সরকারের পক্ষ থেকে বিষয়টিতে কাজ চলছে বলে দাবি করা হয়েছে। কিন্তু মাঠপযাের্য় কাজের ধীরগতি এবং অথর্ বরাদ্দ না হওয়ায় আন্দোলনকারী শিক্ষকরা বলছেন, সরকার তাদের কাছে দেয়া ওয়াদা সহসা কাযর্কর করবেÑ এমন কোনো লক্ষণ তারা দেখছেন না। এ অবস্থায় আদৌ এমপিওভুক্তির দাবি কাযর্কর হবে কিনা, সেটা নিয়ে হতাশায় ভুগছেন তারা। সরকারের পক্ষ থেকে এমপিওভুক্তির আবেদন করতে বলার পর এখনো পযর্ন্ত প্রায় ১০ হাজার প্রতিষ্ঠান আবেদন করেছে। এমপিও’র জন্য করা নতুন নীতিমালা অনুসারে কাজ করলে এক হাজারেরও কম প্রতিষ্ঠান বেতনভুক্তির আওতায় আসবে। এ কারণে আন্দোলনরত শিক্ষকদের দাবি ছিল পূবের্র নীতিমালা অনুসারে এমপিও করতে হবে। অথবা নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক-কমর্চারী ফেডারেশনের সদস্যভুক্ত (ব্যানবেইসের তালিকাভুক্ত) সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে একযোগে বেতনভুক্ত করতে হবে। সরকারের পক্ষ থেকেও একবার থোক হিসেবে বড় সংখ্যায় এমপিও করার আশ্বাস দেয়া হয়েছিল। কিন্তু এমপিও’র জন্য আবেদন করতে বলার পর ১০ হাজার প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে আবেদন পড়ায় সেটা বাস্তবায়নে অনেক বড় অংকের বাজেট প্রয়োজন। নিবার্চনী বছরে সরকারকে এরই মধ্যে কয়েকটি জনতুষ্টির বরাদ্দ দিতে হয়েছে। ভতুির্কর ব্যয়ও বেড়েছে। এ অবস্থায় এই বিশাল সংখ্যক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করতে যে বাজেট প্রয়োজন, এর সংস্থান করা অথর্ ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য রীতিমতো দুঃসাধ্য হয়ে উঠেছে। তবে এ বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ অবশ্য বলেছেন, এবার নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্ত করা হবে। প্রধানমন্ত্রীর আদেশে আবেদন যাচাই-বাছাই চলছে। সরেজমিন যাচাই-বাছাই করে এমপিওভুক্ত করা হবে। এ বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র যায়যায়দিনকে জানিয়েছে, ‘সরেজমিন যাচাই-বাছাইয়ে কাজ ধীরে চলছে। কারণ, এত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এ সময় এসে একবারে এমপিও দেয়া সম্ভব নয়।’ এ ছাড়া আবেদনকারী প্রায় অধের্ক প্রতিষ্ঠানই এমপিওভুক্তির যোগ্য নয়। বতর্মানের নীতিমালাতো দূরে থাক, পুরনো নীতিমালাতেও তাদের নাম খাতায় উঠানো সম্ভব হবে না বলে মনে করছে সরকার। সরকারের পক্ষ থেকে অনুসন্ধানে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবস্থা, শিক্ষাথীর্, শিক্ষকদের অনুপাত ও যোগ্যতা এবং ফলাফলসহ বিভিন্ন দিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে করুণ চিত্র ফুটে উঠেছে। সংশ্লিষ্ট একাধিক কমর্কতার্র সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আবেদন করা প্রায় ১০ হাজার প্রতিষ্ঠানের অধেের্করও কম প্রতিষ্ঠান এমপিও’র যোগ্য। ফলে তাদের বেতনভুক্ত করা সম্ভব হবে না। কিন্তু নিবার্চনের আগে এসব প্রতিষ্ঠানকে বাদ দিয়ে ক্ষুদ্রসংখ্যককে এমপিও করলে বাকিরা আন্দোলনে নামতে পারে। ভোটের মাঠেও এর প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। সবকিছু বিবেচনায় প্রতিষ্ঠানের যাচাই-বাছাইয়ের কথা বলে ধীরগতিতে চলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এমপিও-সংশ্লিষ্ট বিষয়ের দায়িত্বে থাকা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন কমর্কতার্ নাম প্রকাশ না করার শতের্ যায়যায়দিনকে জানিয়েছেন, ‘১০ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আবেদন করেছে। কিন্তু এর মধ্যে সবোর্চ্চ এক-তৃতীয়াংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা যায়। বাকিদের অবস্থা খুবই খারাপ। প্রায় অধের্ক প্রতিষ্ঠানের যোগ্যতা নিয়ে বড় ধরনের প্রশ্ন রয়েছে। তাদের এমপিও করলে রাষ্ট্রের অথের্র অপচয় হবে। ছাত্রছাত্রী নেই, শ্রেণিকক্ষ নেই, কয়েকজন ব্যক্তি মিলে দুই-চারজন ছেলেমেয়ে নিয়ে একেকটি প্রতিষ্ঠান খুলে এমপিও দাবি করছেÑ এমন প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। তাদের এমপিও দেয়া ঠিক হবে না। তবে নিবার্চনের জন্য তাদের এখনি অসন্তুষ্ট করতে চায় না সরকার।’ তবে আন্দোলনরত শিক্ষক নেতারা যায়যায়দিনকে জানান, নিবার্চনের আগে যদি তাদের দাবি বাস্তবায়ন না হয়, তবে পরে সেটা আর বাস্তবায়ন হবে কিনা তা নিয়ে তাদের ঘোরতর সংশয় রয়েছে। তাদের ভাষায়, বতর্মান সরকারের কাছ থেকে প্রতিশ্রæতি পেতেই তাদের চড়া মূল্য গুণতে হয়েছে। নিবার্চনের পর সরকারে কে থাকবে বা না থাকবে, এর কোনো নিশ্চয়তা নেই। তখন নতুন সরকারকে তারা কতটা কাছে পাবে, সেটাও নিশ্চিত নয়। আর এ কারণে তাদের ভাষায় নিবার্চনের আগে এটি করতে ব্যথর্ হলে তাদের আশা শেষ হয়ে যেতে পারে। এ বিষয়ে নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক-কমর্চারী ফেডারেশনের সভাপতি গোলাম মাহমুদুন্নবী (ডলার) যায়যায়দিনকে বলেন, ‘আমরা খবর পেয়েছি সরকার আমাদের কাছে দেয়া প্রতিশ্রæতি অনুসারে নিবার্চনের আগে এমপিওভুক্তি করার কথা নাও রাখতে পারে। এ জন্য আমরা গত কয়েক দিন ধরে ঢাকায় অবস্থান করছি। শিক্ষামন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর কাযার্লয়ের কমর্কতাের্দর সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করছি। কিন্তু আবেদন করে এখনো কোনো পক্ষের সঙ্গে বসার অনুমতি পাইনি। আমরা চেষ্টা করছি। আশা করি, এ বিষয়ে সরকারের যে শীষর্ মহল আমাদের প্রতিশ্রæতি দিয়েছিলেন, তাদের সঙ্গে কথা বলার পর বিষয়টি নিশ্চত হতে পারব।’ নন-এমপিও শিক্ষকদের এই নেতা আরও বলেন, ‘সরকার আমাদের প্রতিশ্রæতি দিয়েছে। নিবার্চনের পর কে ক্ষমতায় আসবে, তা আমরা জানি না। পরবতীর্ সরকার যদি এমপিও দিতে না চায় তবে আমাদের জন্য আরও দুগির্ত অপেক্ষা করছে। আমরা খুবই মানবেতর জীবনযাপন করছি। তাই মানবিক দিক বিবেচনায় সরকারের উচিত, প্রতিশ্রæতি ঠিক রাখা। যদি সরকার তার দেয়া প্রতিশ্রæতি না রাখে, সেটা হবে আমাদের সঙ্গে উপহাস। কিন্তু আমরা আশাবাদী, বতর্মান প্রধানমন্ত্রী আমাদের আশাহত করবেন না।’ উল্লেখ্য, সরকার ২০১০ সালের পর দেশে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্ত করেনি। সবের্শষ ২০১০ সালে এক হাজার ৬২৪টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা হয়েছিল। বতর্মানে দেশে এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে ২৭ হাজার ২১০টি। যাতে শিক্ষক-কমর্চারীর সংখ্যা চার লাখ ৯৬ হাজার ৩৩২ জন। এমপিও’র জন্য আবেদনকারী প্রায় ১০ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে সরকারি বেতনের আওতায় আনতে গেলে বাষির্ক তিন হাজার কোটি টাকা প্রয়োজন হতে পারে বলে মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়েছে। বতর্মানে এমপিওভুক্ত প্রায় ২৮ হাজার প্রতিষ্ঠানের জন্য সরকারের বছরে ব্যয় হয় ১৪ হাজার ১৮২ কোটি টাকা।