শেষ পর্যায়ে চলছে গ্যাস ও বিদু্যৎ সংযোগ

মহামারিতেও থেমে নেই পদ্মা সেতুর কাজ

প্রকাশ | ১৫ জুন ২০২১, ০০:০০

আলতাব হোসেন
দেশে করোনা ঠেকাতে কঠোর বিধিনিষেধ প্রয়োগের প্রভাব পড়ে পদ্মা সেতুর কাজে। নৌ ও আকাশপথ বন্ধ হয়ে পড়ায় মালামাল আনা এবং বিদেশ থেকে বিশেষজ্ঞ, প্রকৌশলী ও শ্রমিকদের দেশে আনা-নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। এর মধ্যে শ্রমিকদের করোনামুক্ত নিরাপদ রাখা নিয়েও সমস্যা দেখা দেয়। শুরু থেকেই একের পর এক প্রতিকূলতা কাটিয়ে বর্তমানে পুরোদমে এগিয়ে চলছে স্বপ্নের পদ্মা সেতুর কাজ। করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের মধ্যেও বিরামহীনভাবে চলছে নির্মাণকাজ। সব বাধা পেরিয়ে এখন চলছে একেবারেই শেষ পর্যায়ের কাজ। এর মধ্যে রোড এবং রেলওয়ে সস্নাব স্থাপনের কাজ প্রায় শেষের পথে। গত এক সপ্তাহ ধরে চলছে রেলিং, গ্যাস ও ৪০০ কেভি বিদু্যৎ সংযোগের কাজ। ল্যাম্পপোস্ট বসানো ও টেলিযোগাযোগ লাইন স্থাপনের কাজ শুরুর প্রস্তুতি চলছে। কাজে যুক্তদের দম ফেলার ফুসরত যেন নেই। সস্নাব বসানোর পর পিচ ঢালাই দেওয়া হবে। এরপর শুরু হবে রোড সাইন ও মার্কিং করার কাজ। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রোববার পর্যন্ত পদ্মা সেতুর সার্বিক অগ্রগতি ৮৬ শতাংশ এবং মূল সেতুর কাজ শেষ হয়েছে ৯৩ দশমিক পাঁচ শতাংশ। আগামী বছরের জুনের মধ্যে একসাথে গণপরিবহণ ও ট্রেন চলাচলের জন্য কাজ শেষ করার কর্মযজ্ঞ চলছে। এখন সেতুর নিচতলায় রেলওয়ে সস্ন্যাব, উপরে রোড সস্ন্যাব বসানোর কাজ চলছে। এর মধ্যে পদ্মা সেতুর রোড সস্নাবের অগ্রগতি ৯৪ শতাংশ এবং রেল সস্নাবের অগ্রগতি ৯৬ শতাংশ। ২৯১৭টি রোডওয়ে সস্নাবের মধ্যে বাকি আছে ৩০০টি আর ২৯৫৯টি রেলওয়ে সস্নাবের মধ্যে বাকি আছে মাত্র ২০০টি। মহামারিতে কাজের যে গতি কমেছিল, তা পুষিয়ে নিতে সংশ্লিষ্টদের বেশ বেগ পেতে হয়েছে। দেশের বাইরে থেকে যেসব মালামাল আগে এক মাসে আসত, তা আসতে এখন দুই থেকে তিন মাস সময় নিচ্ছে। তাতেও কাজ পিছিয়ে থাকে। প্রকল্পের অনেক বিশেষজ্ঞ দেশের বাইরে থেকে আসেন। বিশেষ করে প্রধান প্রকৌশলীরা চীন থেকে আসা যাওয়া করেন। তাদের ১৪ থেকে ২০ দিন কোয়ারেন্টিনে থাকতে হয়। বিশ্বজুড়ে বিমান চলাচল বন্ধ থাকায় প্রকৌশলীদের আসা-যাওয়ায় বড় সমস্যা তৈরি হচ্ছে। সব বাধা পেরিয়ে নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই কাজ শেষ হবে বলে আশা করছেন সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। এ বিষয়ে পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক শফিকুল ইসলাম যায়যায়দিনকে বলেন, 'সব ঠিক থাকলে ২০২২ সালের জুনে এ সেতু চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করা যাবে। নির্ধারিত সময়ের আগেই কাজ শেষ করার টার্গেট নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি। একবারে শেষ পর্যায়ের কাজ চলছে। পদ্মা সেতু প্রকল্পে শুরুতে প্রায় সাড়ে চার হাজার শ্রমিক কাজ করছিলেন। মহামারির শুরুতে চীনা শ্রমিকরা চলে যাওয়ার পরও কাজে ছিলেন প্রায় দেড় হাজার শ্রমিক। তাদের নিয়েই সীমিত পরিসরে কাজ চলে। পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ার পর ডিসেম্বর থেকে আবার পুরোদমে কাজ শুরু হয়।' নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করতে বর্তমানে এ প্রকল্পে ৪ হাজার শ্রমিক-কর্মচারী কাজ করছেন। প্রায়ই এ সংখ্যা কম বেশি হয়। ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের পদ্মা সেতুটি দ্বিতল হবে, যার ওপর দিয়ে সড়কপথ ও নিচের অংশে থাকছে রেলপথ। পদ্মা সেতু শুধু বাংলাদেশের একটি বড় অবকাঠামোই নয়। পদ্মা সেতু বিশ্বকে জানিয়ে দিচ্ছে- বাংলাদেশ এখন আর তলাবিহীন ঝুড়ি নয়। দক্ষিণ জনপদের মানুষের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন পূরণে যে বিপুল কর্মযজ্ঞ কয়েক বছর ধরে পদ্মাপাড়ে চলছে, তা পূর্ণ অবয়ব পায় গত ১০ ডিসেম্বর। সেতুর ৪১তম স্প্যান স্থাপনের মধ্য দিয়ে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার পদ্মা সেতুর পুরো মূল কাঠামো দৃশ্যমান হয় সেদিন; তৈরি হয় রাজধানীর সঙ্গে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার সরাসরি সড়ক যোগাযোগের স্বপ্ন। প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে উৎসুক মানুষের ভিড় বাড়ছে স্বপ্নের পদ্মা সেতু দেখতে। নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন এবার বাস্তবে ধরা দিচ্ছে। পদ্মা সেতু নিয়ে যড়যন্ত্র ও অপপ্রচার কম হয়নি। শেষ দিকে পদ্মায় বাচ্চাদের মাথা কেটে ফেলার কথাও প্রচার করা হয়। বিশ্বব্যাংকসহ বহুজাতিক অর্থলগ্নিকারী দাতা সংস্থাগুলোর দুর্নীতির মিথ্যা অভিযোগ। দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রে অর্থায়ন প্রত্যাহার। নজিরবিহীন বন্যা, মহামারি করোনার ছোবল, বৈরী প্রকৃতি কোনো বাধায় গতি টেনে ধরতে পারেনি পদ্মা সেতুর। সব যড়যন্ত্র পায়ে দলে বাংলাদেশের সক্ষমতার বিশ্ব উদাহরণ হয়ে ডানা মেলছে পদ্মা সেতু। সমালোচনাকারীরা এবার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠেছে। পদ্মায় মূল সেতু নির্মাণের জন্য কাজটি করছে চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি (এমবিইসি) ও নদী শাসনের কাজ করছে চীনের 'সিনো হাইড্রো করপোরেশন'। ১০ হাজার ১৬২ কোটি টাকায় ২০০৭ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে প্রকল্পটি শেষ করার লক্ষ্য ছিল। কিন্তু প্রকল্প শুরু হতেই সময় লেগে যায় ২০১৪ সাল। চারবার প্রকল্প সংশোধন করে এখন ব্যয় ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে।