বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

করোনায় বিপর্যস্ত পাটি শিল্প

ওয়ালী উলস্নাহ সরকার, জামালগঞ্জ (সুনামগঞ্জ)
  ১৬ জুন ২০২১, ০০:০০
জামালগঞ্জে শীতল পাটি বুননে ব্যস্ত কয়েকজন নারী -যাযাদি

পস্নাস্টিকের তৈরি পাটির চাহিদা বাজারে বৃদ্ধি পাওয়ায় পাটি শিল্পীদের দুর্দিন চলছে দীর্ঘ সময় ধরে। তার মধ্যে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয় দাঁড়িয়েছে করোনাভাইরাস। করোনা এবং পস্নাস্টিকের প্রভাবে জর্জরিত জামালগঞ্জের ৫ শতাধিক পাটি শিল্পী পরিবার। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, করোনা পরিস্থিতি বিবেচনায় এই পাটি শিল্পীদের প্রণোদনার ব্যবস্থাসহ সুদে ঋণ দেওয়া প্রয়োজন। নতুবা ঐতিহ্যবাহী শীতল পাটি শিল্প অচিরেই হারিয়ে যাবে এ উপজেলা থেকে।

সুনামগঞ্জ জেলার জামালগঞ্জ উপজেলার সদর ইউনিয়নের চাঁনপুর, কদমতলী, সোনাপুর ও দুর্গাপুর পাটি শিল্পীদের গ্রাম হিসেবে পরিচিত। এই গ্রামেই অধিকাংশ পাটি শিল্পীর বাস। জীবিকার প্রধান অবলম্বন এবং বাপ-দাদার ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখতে যুগের পর যুগ পাটি তৈরি করে বাজারে বিক্রি করে সংসার চালান তারা। তাদের তৈরি পাটি সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় গরমের সময়ে। সেই হিসেবে বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবণ এই চার মাস পাটি শিল্পীদের ব্যবসা মৌসুম। অথচ করোনার কারণে ক্রেতা অনেক কমে গেছে তাদের। খুচরা বাজারে টুকটাক বিক্রি হলেও পাইকাররা আসতে পারছেন না বিভিন্ন অঞ্চল থেকে। ফলে পাটি শিল্পীরা পড়েছেন চরম বিপাকে। এই মৌসুমে পাটি তৈরির কাঁচামাল সংগ্রহ করবেন নাকি সংসার সামলাবেন এই দুশ্চিন্তায় পাটি শিল্পীদের কপালে পড়েছে দুশ্চিন্তার ভার। এদিকে পস্নাস্টিকের তৈরি পাটির চাহিদা বাড়ায় দুইশ' বছরের ঐতিহ্যবাহী শীতল পাটি ক্রমেই বাজার হারাতে বসেছে।

সোনাপুর, চাঁনপুর, কদমতলী, দুর্গাপুর কয়েকটি গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, নারীদের পাশাপাশি স্কুলে-কলেজের মেয়েরাও নিপুণ হাতে পাটি তৈরি করছে। বড়দের কাজে সহযোগিতা করে যাচ্ছে তারা। এসব গ্রামের পুরুষ হাটবাজার থেকে মুর্তা কিনে এনে বেতি তৈরি করেন। সেগুলো গরম পানিতে জাল দিয়ে ভাতের মার দিয়ে পানিতে ভিজিয়ে রাখা হয়। বেতি মসৃণ ও সাদা রং ধারণ করার পর শীতল পাটি তৈরি করা হয়। এসব গ্রামে শীতল পাটি, আসন পাটি, নামাজের পাটি তৈরি করা হয়। একটি শীতল পাটি বুনতে ৩-৪ জনের ৩ থেকে ৪ দিন সময় লাগে। বিক্রি হয় ১৩ থেকে ১৪শ' টাকা। নরমাল সাদা পাটি তৈরি করতে একজনের এক সপ্তাহ লেগে যায়। বিক্রি হয় ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা। বেতিসহ অন্যান্য খরচ হয় ৩০০ টাকা।

পাটি শিল্পী গীতা রানী কর জানান, এই পেশায় তিনি ২০ বছর ধরে রেখেছেন। কিন্তু এমন দুর্দিন আর দেখেননি কখনো। এ বছর মেলায় বিক্রি নেই। গ্রামগঞ্জে মেলা নেই। শহর-বন্দরে যাওয়ারও সুযোগ নেই। অথচ মহাজনের ঋণ নিয়ে মুর্তা কিনে পাটি তৈরি করেছেন বৈশাখী মেলার জন্য। এখন ঋণ পরিশোধ করতে হিমশিম খাচ্ছেন তিনি। সরকার বিনা সুদে ঋণ দিলে তাদের অনেক উপকার হতো।

একই গ্রামের পাটি শিল্পী পুষ্প রানী কর জানান, 'পূর্বপুরুষদের এই পাটি শিল্প ধরে রাখতে আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছি। আমাদের পুরুষেরা নেত্রকোনা জেলার দুর্গাপুর, ময়মনসিংহ জেলার হালুয়াঘাট এবং সিলেটের গোয়াইনঘাটসহ পাহাড়ি এলাকা থেকে মুর্তা কিনে এনে বেতি তৈরি করে দেন। আমরা পাটি বুনন করি। করোনার কারণে বিভিন্ন জায়গায় যাওয়া যায় না। আর গেলেও মুর্তার দাম অনেক বেশি। তাই বিক্রিতে আগের মতো লাভ নেই। তারপরও অন্য পেশা জানা না থাকায় এই পেশায় কোনোরকম টিকে আছি।'

মোহনগঞ্জ, কলমাকান্দা, তাহিরপুর, জামালগঞ্জসহ ৪ উপজেলার ১৬টি গ্রামের পাটি শিল্পীদের কায়েস্থ সমাজ উন্নয়ন কমিটির সাধারণ সম্পাদক বিমল চন্দ্র কর জানান, 'যদিও আমরা পাটি তৈরি করি কিন্তু আমাদের মাঝে কর, ধর, নন্দী, বণিক, দত্ত ইত্যাদি সম্প্রদায়ের লোক একসাথে পাটির কাজ করে থাকি। এই শিল্প ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন কুটির শিল্পের একটি অংশ। পূর্বে পাটি শিল্পের জৌলুশ ছিল। বর্তমানে করোনা এবং পস্নাস্টিকের কারণে এই শিল্প টিকিয়ে রাখতে আমরা হিমশিম খাচ্ছি। আগে গ্রামের পর গ্রাম এই পেশায় নিয়োজিত ছিলেন, বর্তমানে শিল্পের ধস নামার কারণে অনেকেই অন্য পেশায় চলে গেছেন। যারা রয়েছেন তারা সীমিত লাভে ঐতিহ্যবাহী এই শিল্পকে ধরে রেখেছে। সরকার আমাদের এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে হলে বিসিক ব্যাংক অথবা অন্য কোনো ব্যাংক থেকে বিনা সুদে ঋণ এবং মুর্তা চাষের জন্য খাস জমি বন্দোবস্তের ব্যবস্থা করলে পাটি শিল্প টিকিয়ে রাখা সম্ভব। নতুবা এই ঐতিহ্যবাহী শিল্প বিলীন হয়ে যাবে।'

এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বিশ্বজিত দেব বলেন, শীতল পাটির চাহিদা থাকা সত্ত্বেও বিপণন ব্যবস্থা এবং মেলা বন্ধ থাকায় বছরের পুরো সময় তাদের বাজারজাত বন্ধ হয়ে গেছে। করোনাভাইরাসে অন্যান্য পেশাজীবীদের মতো তাদেরও দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। তাদেরকে কর্মসূচির আওতায় এনে সহযোগিতার ব্যবস্থা নিতে উপজেলা প্রশাসন কাজ করে যাবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে