দক্ষিণ কোরিয়ায় কয়েক হাজার বাংলাদেশির অভিবাসন অনিশ্চিত

বছরে গড়ে সুযোগ পান মাত্র ২ হাজার ২০১৮ সালের নিয়োগপ্রাপ্ত অধিকাংশই এবং ২০১৯ সালে যেতে পারেননি একজন কর্মীও মেয়াদ শেষ নিয়োগপ্রাপ্ত অধিকাংশের

প্রকাশ | ২৫ জুন ২০২১, ০০:০০

রেজা মাহমুদ
গত বছরের ফেব্রম্নয়ারি থেকে বন্ধ রয়েছে বাংলাদেশিদের জন্য দক্ষিণ কোরিয়ায় অভিবাসন প্রক্রিয়া। যদিও মাঝে ৮ মাস বিরতির পর এই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল, কিন্তু সে সময়ে দেশ থেকে করোনা নেগেটিভ সনদ নিয়ে যাওয়া কর্মীদের দক্ষিণ কোরিয়ায় করোনা পজিটিভ হওয়ায় তা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। নতুন কর্মীরা কবে যেতে পারবেন সে বিষয়ে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত জানায়নি দেশটি। ফলে কোরিয়ান কোম্পানি থেকে নিয়োগপত্র পেয়েও যেতে পারছেন না কয়েক হাজার বাংলাদেশি; ইতোমধ্যে শেষ হয়ে গেছে অনেকের মেয়াদও। এ বিষয়ে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৭ সালের নিয়োগপ্রাপ্তরা অনেকে যেতে পারলেও রোস্টার প্রক্রিয়ার কারণে ২০১৮ সালের নিয়োগপ্রাপ্ত অধিকাংশই যেতে পারেনি। এছাড়া ২০১৯ সালে নিয়োগপ্রাপ্তদের একজনও যেতে পারেননি। এরই ধারাবাহিকতায় বন্ধ রয়েছে ২০২০ ও ২০২১ সালের কর্মী পাঠানোর প্রক্রিয়া। তবে বিজনেস ও স্টুডেন্ট ভিসায় বাংলাদেশিরা দেশটিতে যেতে পারেছেন। এদিকে, ২০০৮ সাল থেকে বাংলাদেশে একমাত্র প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়েরে অধীনে বাংলাদেশ ওভারসিজ এমপস্নয়মেন্ট অ্যান্ড সার্ভিসেস লিমিটেডই (বোয়েসেল) দেশটিতে কর্মী প্রেরণ করে থাকে। আর পুরো প্রক্রিয়ায় মাত্র ১ লাখ টাকা ব্যয় হলেও, দক্ষিণ কোরিয়ায় ২ থেকে আড়াই লাখ টাকা বেতন পান এসব কর্মী; যা মধ্যপ্রাচ্য কিংবা এশিয়ার যে কোনো দেশের তুলনায় ৪ থেকে ৫ গুণ বেশি। গড়ে প্রতি বছর প্রায় ২ থেকে আড়াই লাখ বাংলাদেশি বোয়েসেল'র মাধ্যমে দেশটিতে যাওয়ার আবেদন করলেও নিয়োগপত্র পান মাত্র ২ হাজার। রাজু এমনই একজন দক্ষিণ কোরিয়ায় অভিবাসন প্রত্যাশী। তিনি ২০১৮ সালে নিয়োগপ্রাপ্ত ভাগ্যবানদের একজন। তবে রোস্টার প্রক্রিয়ায় ২০১৯ সালে না যেতে পারলেও ২০২০ সালে তার যাওয়াটা এক কথায় নিশ্চিত ছিল। কিন্তু করোনার কারণে তা স্থগিত হয়ে যায়। এদিকে শেষ হয়ে গেছে দেশটিতে তার প্রবেশের মেয়াদ। রাজু জানান, বেশ কঠিন যাচাই-বাছাইয়ের মধ্যে দিয়ে কয়েক লাখ থেকে লটারির মাধ্যমে মাত্র ৮ হাজার জন পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ পায়। আর সেখান থেকে দক্ষতানুযায়ী ওই দেশের বিভিন্ন কোম্পানি পর্যায় ক্রমে নিয়োগপত্র দিয়ে থাকে। আর কেউ যদি ২ বছরের মধ্যে না যেতে পারে, তাহলে নতুন করে আবেদনসহ পুরো প্রক্রিয়া আবার পার করে আসতে হয়। সে হিসেবে তিনিসহ প্রায় অনিশ্চিত ২০১৮ ও ২০১৯ সালের নিয়োগপত্র পাওয়া প্রায় ৪ থেকে ৫ হাজার বাংলাদেশির অভিবাসন প্রত্যাশী। অন্যদিকে স্থগিত রয়েছে ২০২০ ও ২০২১ সালে বাছাই প্রক্রিয়াও। রাজুর মতো অন্য নিয়োগপ্রাপ্তরা জানান, এই বাছাই প্রক্রিয়া পার হতে গড়ে তাদের ২ থেকে ৩ বছর প্রস্তুতি নিতে হয়েছে। শুধু তাই নয়, ২০০ নম্বরের পরীক্ষায় কত পেলে নির্বাচিত হবেন, তাও নির্দিষ্ট নয়। কারণ ১৫০ নম্বর পেয়েও ২ হাজারের তালিকায় অনেকে বাদ পড়েন আবার ১২০ নম্বর পেয়েও কোনো বছর সুযোগ পাওয়া যায়। এদিকে বোয়েসেল সূত্র জানিয়েছে, দেশের করোনা পরিস্থিতির কোনো উন্নতি না হওয়ায় এবং রিলিজ ও ছুটিতে দেশে আসা কর্মীসহ যারা করোনাকালীন সময়ে দক্ষিণ কোরিয়া গিয়েছেন তাদের অনেকেরই (১০০ জনের মধ্যে ১০ জন) সেখানে করোনা পজিটিভ হওয়ায় দেশটি নতুন কর্মী নেওয়ার প্রক্রিয়া বন্ধ করে দিয়েছে। এদিকে 'স্টিমজ হেলথ কেয়ার' নামে বাংলাদেশের একটি প্রতিষ্ঠানকে এসব কর্মীর করোনা পরীক্ষার জন্য নির্ধারণ করেছিল সংস্থাটি। আর এখান থেকেই করোনা নেগেটিভ সনদ নিয়েই দক্ষিণ কোরিয়া গিয়েছিলেন তারা। খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, সম্প্রতি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ভুয়া করোনা সনদসহ বিভিন্ন অভিযোগে 'স্টিমজ হেলথ কেয়ার'র করোনা সংশ্লিষ্ট সব কার্যক্রম সাময়িকভাবে বন্ধ করে দিয়েছে। এ বিষয়ে বোয়েসেল'র ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. বিলস্নাল হোসেন জানান, করোনার কারণে গত বছর থেকেই নতুন কর্মী পাঠানোর প্রক্রিয়া স্থগিত রয়েছে। তবে ইতিমধ্যে যারা দক্ষিণ কোরিয়া গেছেন তারাসহ বাণিজ্যিক ও স্টুডেন্ট ভিসার বাংলাদেশিরা নির্দিষ্ট একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দেশটিতে যেতে পারছেন এবং সে ক্ষেত্রে তাঁর প্রতিষ্ঠান কঠোর নিয়ম-কানুন মেনেই কাজ করছে। তবে নতুন কর্মী কবে যেতে পারবে সে বিষয়ে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। কিন্তু মন্ত্রণালয় এই প্রক্রিয়া শুরু করার জন্য সব ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছে বলেও তিনি জানান। 'স্টিমজ হেলথ কেয়ার' ও দক্ষিণ কোরিয়া বড় একটা সংখ্যায় করোনা পজিটিভ হওয়া সংস্থা হিসেবে বোয়েসেল'র দীর্ঘদিনের ভাবমূর্তি কিছুটা হলেও ক্ষুণ্ন্ন হয়েছে উলেস্নখ করে তিনি বলেন, দক্ষিণ কোরিয়ান সরকারি প্রতিষ্ঠান হিউম্যান রিসোর্স ডেভেলপমেন্ট (এইচআরডি) ও বোয়েসেল পুরো বাছাই প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতার সঙ্গে সম্পন্ন করে থাকে বলে প্রতারণা কিংবা অতিরিক্ত অর্থ নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই এখানে। এমন রেকর্ড অন্য কোনো সংস্থার আছে কিনা তার জানা নেই। তিনি আরও বলেন, তবে করোনা সনদের ব্যাপারে যে অভিযোগটি আছে সে বিষয়টি তারা খতিয়ে দেখছেন। ইতোমধ্যে অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানটির কাছে লিখিত ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে। এছাড়াও যে সময় এই প্রতিষ্ঠানটিকে করোনা পরীক্ষার জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয়, তখন মাত্র ১৬ প্রতিষ্ঠান সরকার কর্তৃক অনুমোদিত ছিল। পরবর্তীতে বোয়েসেল খোঁজ নিয়ে জানতে পারে, ১৬টার মধ্যে ৩টা প্রতিষ্ঠানে করোনা সনদ নেগেটিভ হলেও পরবর্তী পরীক্ষায় পজিটিভ শনাক্ত হচ্ছে। তাই এই তিন প্রতিষ্ঠানকে তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরও বলেন, দক্ষিণ কোরিয়ান সরকার জানিয়েছে, জুনের ১০ তারিখ থেকে জুলাই মাসের ১০ তারিখ পর্যন্ত ছুটি ও রিলিজে আসা কর্মীদের করোনা নেগেটিভ হলে আবার নতুন অভিবাসন প্রক্রিয়া শুরু হতে পারে। তাই অনাকাঙ্ক্ষিত ইমেজ সংকট দূর করতে গত মে মাসে আন্ত-মন্ত্রণালয় বৈঠকে কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৭ দিনের শারীরিক দূরত্ব ও কোরিয়ান কিট দিয়ে দু'দফা করোনা পরীক্ষাসহ বেশকিছু পদক্ষেপ রয়েছে। এবং এর ফলাফল বেশ ভালো। কারণ গত দু'সপ্তাহে দেশটিতে যাওয়া ৫৮ জনের মধ্যে প্রত্যেকেই করোনা নেগেটিভ হয়েছে। এছাড়াও তাদের পক্ষ থেকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে টিকা পাওয়ার সব রকম চেষ্টা চলছে বলে তিনি জানান। প্রসঙ্গত, এশিয়ার অন্যতম শক্তিশালী অর্থনীতির দেশ দক্ষিণ কোরিয়া এক যুগেরও বেশি সময় ধরে বেশ সম্ভাবনাময় শ্রমবাজার। দক্ষিণ কোরিয়ান সরকারি প্রতিষ্ঠান হিউম্যান রিসোর্স ডেভেলপমেন্ট (এইচআরডি) মাধ্যমে সারা বিশ্বের ১৬টি দেশ থেকে চাহিদানুযায়ী তারা কর্মী নিয়োগ দিয়ে থাকে। বাংলাদেশে একমাত্র সংস্থা বোয়েসেল ২০০৮ সাল থেকে সে দেশে কর্মী পাঠাচ্ছে। এ পর্যন্ত প্রায় ২১ হাজার কর্মী দেশটিতে পাঠিয়েছে সংস্থাটি। তবে করোনার কারণে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার ১২টি দেশ থেকে কর্মী নেওয়ার প্রক্রিয়া বন্ধ রয়েছে।