ফড়িয়াদের কবজায় পাটের বাজার

দেড় মাসে দাম কমেছে মণে ৪ হাজার টাকা হ করোনা সংকটে রপ্তানিতে ধস হ চাষিদের বকেয়া ২৪৪ কোটি টাকা

প্রকাশ | ২৭ জুলাই ২০২১, ০০:০০ | আপডেট: ২৭ জুলাই ২০২১, ০০:১৩

আলতাব হোসেন

বিগত কয়েক বছর বিশ্ববাজারে পাটের রমরমা ব্যবসার পর মহামারি করোনায় পাট এবং পাটজাত পণ্য রপ্তানিতে মন্দা শুরু হয়েছে। অথচ দেশে পাটের ভরা মৌসুম চলছে। দেশের হাট-বাজারগুলোতে এখন পুরোদমে পাট উঠেছে। পাটের সরবরাহ বাড়লেও হাটে পাটের ক্রেতা নেই। বিক্রেতারা পাট নিয়ে বসে আছেন। দেড় মাসে পাটের দাম কমেছে মণপ্রতি চার হাজার টাকা। পাটের দরপতনের এ সুযোগে পাটের বাজার চলে গেছে ফড়িয়াদের কব্জায়। পাটের দরপতনে পাটচাষির মাথায় হাত পড়েছে। পাট আবার রীতিমতো কৃষকের গলার ফাঁসে পরিণত হয়েছে। গত বছরের জুলাই মাসে সরকার রাষ্ট্রায়ত্ত ২৬টি পাটকলে উৎপাদন বন্ধ করে ২৪ হাজার ৮৮৬ জন স্থায়ী শ্রমিককে অবসরে পাঠায়। রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল বন্ধ থাকায় ফড়িয়ারা পানির দরে পাট কিনে নিচ্ছেন। মৌসুম শেষে এই পাট তারা কয়েকগুণ লাভে বিক্রি করবেন। বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশন (বিজেএমসি) পাট না কেনায় পাটের দরপতন চলছে বলে অভিযোগ করছেন পাটচাষিরা। তারা বলছেন পাটের মুনাফা লুটে নিচ্ছে বেসরকারি পাটকল ও ফড়িয়ারা। সরকার যখন আবার পাট কিনবেন তখন কৃষকের হাতে পাট থাকবে না। তখন ফড়িয়াদের কাছ থেকে আট হাজার টাকা মণে পাট কিনতে হয়। গত বছর বেসরকারি পাটকলগুলো সাড়ে ছয় হাজার টাকা মণে পাট কিনেছে। অনেকে আশঙ্কা করছেন, এবার হয়তো পাটের দাম দশ হাজার টাকা ছাড়াতে পারে। মহামারি করোনাভাইরাসের মধ্যেই পাট রপ্তানিতে নতুন রেকর্ড ছুঁয়েছে বাংলাদেশ। গত বছর পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি করে ১০৩ কোটি ৫৭ লাখ (১.০৩ বিলিয়ন) ডলার আয় করেছে বাংলাদেশ। শুক্রবার ফরিদপুরের কানাইপুর হাটে পাট বিক্রি করেন কৃষক আব্দুল আজিজ হাওলাদার। তিনি জানান, নতুন পাট ওঠার পর দ্রম্নত দাম কমতে থাকে। জুন মাসের শুরুতে তিনি সাড়ে ছয় হাজার টাকা মণে পাট বিক্রি করেছেন। আর শুক্রবার সেই পাট মাত্র আড়াই হাজার টাকা দরে বিক্রি করেন। মাত্র দেড় মাসের ব্যবধানে একমণ পাটে লোকসান হয়েছে চার হাজার টাকা। তিনি বিজেএমসি'র পাট ক্রয় কেন্দ্রগুলো চালুর দাবি জানান। তিনি আরও বলেন, এ বছর পাট বিক্রি করে বেশির ভাগ কৃষক উৎপাদন খরচও তুলতে পারছেন না। তার ওপরে আগের বছরের অবিক্রীত পাটের বোঝা তো রয়েছেই। ২০০৯ সাল থেকে দেশের পাট খাত ঘুরে দাঁড়িয়েছিল। নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হয়েছিল। করোনার কারণে আবার পাট খাতে অন্ধকার নেমে আসছে। দেশের নামকরা পাটের বাজার ফরিদপুরের কানাইপুর হাট, তালমা হাট, পুকুরিয়া হাট, কামারখালী হাট, মাগুরার লাঙ্গলবাদ হাট, সিরাগঞ্জের উলস্নাপাড়া, পাবনার বেড়া, টাঙ্গাইলের জামকি হাট, কালিহাতী, ঝিনাইদহ হাট, রাজবাড়ীর পুলার হাট, মানিকগঞ্জের ঘিওর, লালমনিরহাটের আদিতমারী, জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ হাট, সরিষাবাড়ী, ইসলামপুরের ধর্মগোড়া, মাদারীপুরের চর মুগরিয়া হাট, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, বরিশালের গৌরনদী ও মুলাদী হাটে এবার মন্দা চলছে। এসব হাটে পানির দামে বিক্রি হচ্ছে পাট। কৃষকরা বলছেন, এবার ধানের দাম ভালো হলেও পাটের দাম নিয়ে হতাশ কৃষক। চোখে পানি মুছতে মুছতে তারা পাট বিক্রি করছেন। ফরিদপুরের কামারখালী, তালমা, পুকুরিয়া হাটে পাট বিক্রি হচ্ছে পানির দরে। বিজেএমসি এবং বেসরকারি পাটকলগুলো পাট না কেনায় পাটের দরপতন চলছে। কামারখালী হাটে পাট বিক্রেতা উসমান গণি বলেন, পাটের ক্রেতা না থাকায় ভালোমানের পাট শুক্রবারে ২২শ' টাকা মণে বিক্রি করেছেন। অথচ গত মৌসুমে স্বাধীনতার পর পাটের সর্বোচ্চ দাম সাড়ে ছয় হাজার টাকায় বিক্রি করেছিলেন। সরকার পাটের বাজার নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সারা দেশে বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনের (বিজেএমসি) পাট ক্রয় কেন্দ্রের মাধ্যমে পাট কেনা শুরু করা উচিত। পাটের ভালো দাম না পেলে পাটচাষিরা নিরুৎসাহিত হবেন। পাটের পরিবর্তে তারা অন্য ফসলে ঝুঁকে যাবেন। পাটকল বিশেষজ্ঞ ড. সেলিম রায়হান খান যায়যায়দিনকে বলেন, করোনা পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশন (বিজেএমসি) সীমিত আকারে ১০টি পাটকল চালু রাখলে কৃষকরা পাটের ন্যায্য মূল্য পাবেন। এতে কাঁচা পাট চোরাইপথে পাচার হবে না। পাটকল চালু থাকলে অনেকের কর্মসংস্থান হবে। বাংলাদেশ থেকে মধ্যপাচ্যের দেশগুলোতে কাঁচা পাটের পাশাপাশি জুট ইয়ার্ন, টুওয়াইন, চট ও বস্তা রপ্তানি করে। এর পাশাপাশি রপ্তানি হয় হাতে তৈরি বিভিন্ন পাটজাত পণ্য ও কার্পেট। বিশ্বে উৎপাদিত কাঁচা পাটের ৪০ শতাংশ উৎপাদন করে বাংলাদেশ। বিশ্ব বাজারে বাংলাদেশের পাটের সুনাম আছে। তিনি আরও বলেন, দেশেও পাট পণ্যের বড় বাজার আছে। খাদ্য মন্ত্রণালয় যে চালের মজুত করে সেখানে বিজেএমসির পাটের বস্তা ব্যবহার করা হয়। বিএডিসিতে ধানের বীজ সংরক্ষণ করা হয় পাটের বস্তায়, সারের বস্তায়ও পাটের প্রয়োজন হয়। বেড়িবাঁধ রক্ষায় পাটের বস্তা ব্যবহার হয়। পাটের চাহিদা বাড়াতে পাটের মোড়ক ব্যবহার বাধ্যতামূলক করে আইন করায় নানা কাজে পাটের বস্তার চাহিদা বেড়েছে। পলিথিন নিষিদ্ধ হওয়ায় পাটের ব্যাগের চাহিদা বেড়েছে। তাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে অল্প কয়েকটি পাটকল চালু করলে পাটের সোনালী দিন আবার ফিরে আসতে পারে। ফরিদপুরের কামারখালীর ক্ষুদ্র পাট ব্যবসায়ী মুজিব হোসেন চৌধুরী যায়যায়দিনকে বলেন, সরকারি পাটকল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ক্ষুদ্র পাট ব্যবসায়ীরা পথে বসেছেন। বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনের (বিজেএমসি) কাছে তাদের বকেয়ার পরিমাণ ২৮৮ কোটি টাকা। চার বছর ধরে এই বকেয়া পরিশোধ না করায় তারা মানবেতর জীবন-যাপন করছেন বলে জানান তিনি। ব্যাংক ঋণ না পাওয়া এবং বিজেএমসি পাওনা টাকা পরিশোধ না করায় পাট কেনা সম্ভব হচ্ছে না। এ কারণে পাটের বাজারে দরপতন চলছে। বিজেএমসি'র কয়েকটি পাট ক্রয় কেন্দ্র চালু হলে পাটের দাম বাড়বে। বাংলাদেশ ক্ষুদ্র পাটচাষি সমিতির সাধারণ সম্পাদক হারুন অর রশিদ যায়যায়দিনকে বলেন, এবার কৃষি মন্ত্রণালয়ের ৯০ লাখ বেল পাট উৎপাদনের টার্গেট রয়েছে। এবার ভালো মানের পাট উৎপাদন হয়েছে। বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনের (বিজেএমসি) অন্তত দশটি পাটকল চালু রাখতে পাটের ভরা মৌসুমে কম দামে পাট কিনলে ভালো মুনাফা করতে পারবে। এতে কৃষকরা ন্যায্য মূল্য পাবেন এবং করোনাকালে অনেকের কর্মসংস্থান হবে। বিজেএমসি পাওনা টাকা পরিশোধ করতে পারবে। পাটকল যখন বন্ধ হয় তখন সাড়ে চারশ' কোটি টাকার পাটপণ্য মজুত ছিল। তখন বলা হয়েছিল পাটপণ্য বিক্রি করে পাওনা পরিশোধ করা হবে। প্রতিশ্রম্নতির দুই বছরে এক টাকাও পরিশোধ করা হয়নি। দ্রম্নত পাওনা টাকা প্রদানের দাবি জানান তিনি। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, এবার সারা দেশে পাট চাষের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৯০ লাখ বেল। বিশ্বের মোট পাটের ৯০ শতাংশ উৎপাদিত হয় বাংলাদেশ ও ভারতে। দুই দেশই নিজেদের ব্যবহারের পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাট, পাটের সুতা ও পাটের তৈরি বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি করে থাকে।