বগুড়ার শাজাহানপুরে ৪৫ বছর ধরে জনশূন্য পিচুলগাড়ি গ্রাম। বগুড়া থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দক্ষিণে শাজাহানপুর উপজেলার গোহাইল ইউনিয়নে এ গ্রামটি অবস্থিত। ৬০ বিঘারও বেশি জায়গাজুড়ে এখনো দাঁড়িয়ে আছে গ্রামটি। একসময় যেখানে ছিল প্রায় ৫০টি পরিবারের বসবাস। চারদিকে বিস্তীর্ণ ধানক্ষেত, মাঝখানে পরিত্যক্ত বসতভিটা, বাড়ির আঙ্গিনা, উঠান, মসজিদ, নানা ফলমুলের গাছপালা, বাঁশঝাড় সুদৃশ্য পুকুরসহ অপরূপ প্রাকৃতিক দৃশ্যেভরা এ পিচুলগাড়ি গ্রাম। এখন নেই শুধু মানুষের প্রাণচাঞ্চল্য ও জীবন-জীবিকা। ডাকাতের ভয়ে জীবন বাঁচাতে বসতভিটা রেখে ৪৫ বছর আগে গ্রাম ছেড়ে অন্যত্র গিয়ে বসবাস করছেন এ গ্রামের আদি বাসিন্দারা। দেশের দীর্ঘ পথ-পরিক্রমায় অনেক কিছুর পরিবর্তন হলেও আজও তাদের ভাগ্যের দুয়ারে লাগেনি সুবাতাস। নিরাপত্তার অভাবে বাসিন্দারা আজও ফিরতে পারেননি গ্রামটিতে। প্রবীণ বাসিন্দারা জানান, আশির দশকে প্রায় রাতেই গ্রামটিতে ডাকাতের হামলা হতো। খুন, রাহাজানি, লুটপাট, অর্থকড়ি ছিনতাই ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। ডাকাতের ভয়ে গ্রামে কেউ কোনো কিছু রাখতে পারত না। ডাকাত দল ধান-চাল, গবাদি পশু, গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগিও নিয়ে যেত। হঠাৎ হামলা চালিয়ে লুটপাটের সঙ্গে জ্বালিয়ে দিত ঘরবাড়ি ও সম্পদ। মাঝে মধ্যে মানুষ খুন করেও সবকিছু লুটপাট করে নিয়ে যেত। কয়েক বছর এভাবে একের পর এক মানুষ খুন করেছিল ডাকাত দল। ১৯৭৪ সালে এই গ্রামের মাতব্বর নান্নু মোলস্না ডাকাতদের হাতে নির্মমভাবে খুন হন। ডাকাতরা নান্নু মোলস্নার কাছে টাকা চাইলে তিনি তা দিতে অস্বীকার করলে খুন করা হয় তাকে। সর্বশেষ ১৯৮১ সালে ডাকাত দল গ্রামের মাতব্বর ওসব থেকে ধনাঢ্য গৃহস্থ মফিজ উদ্দিন মন্ডলকে খুন করে। এরপর থেকেই গ্রামের বাসিন্দারা তাদের সহায়-সম্বল রেখে প্রাণের ভয়ে অন্য গ্রামে চলে যান। সেই থেকে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে পিচুলগাড়ি গ্রাম। বর্তমানে জঙ্গলে আবৃত এবং ভগ্নদশা বসতভিটাগুলো দেখে গ্রামটিকে বেশ ভূতুড়ে লাগে আর দীর্ঘ সময় ধরে জনবসতি না থাকায় এ গ্রামটিকে ঘিরে রয়েছে অনেক অলৌকিক গল্প। নিজেদের ভূ-সম্পত্তি হলেও ভয়ে কেউ গাছের পাতাও ছিঁড়েন না, ফলও খান না। নান্নু মোলস্নার দুই নাতি বলেন, পিচুলগাড়ি গ্রামে থাকতেই বিয়ে করেন; কিন্তু প্রায়ই ডাকাতদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েন তারা। তারা আরও বলেন, একদিন দাদা হাটে যায় গরু বিক্রি করতে, ডাকাতরা হাট থেকেই পিছু নেয়, টাকাও চেয়েছিল রাস্তায়, কিন্তু দাদা দেননি। সেই দিনগত রাতে ডাকাতরা বাড়িতে হামলা করে সবাইকে জিম্মি করে আবারও টাকা চায়। তাতেও দাদা টাকা না দিলে একটি ঢেঁকির মৌনি দিয়ে দাদার মাথায় বাড়ি দেয়। এতে অল্পক্ষণের মধ্যেই মৃতু্য হয়। সে ঘটনায় পুলিশ এসে মরদেহ থানায় নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু কোনো মামলা হয়নি। ডাকাতরা কোথাকার জানতে চাইলে বলেন, ওরা সবাই আশপাশের গ্রামের চেনা মুখ। কিন্তু ভয়ে কিছু বলতে পারিনি আমরা। এমন জঙ্গল আর পরিত্যক্ত বাবার ভিটায় এখনো স্মৃতির খোরাক খোঁজেন মজিবর রহমান মন্ডল। তিনি বলেন, ফেলে আসা সেই দিনগুলোর কথা। মজিবরের মতোই গ্রামের অন্যদের গল্পও একই। একসময় এ গ্রামে আনন্দ-উদ্দীপনা আর মিলেমিশে বসবাস করত সবাই একসঙ্গে। সেই দিনগুলো আজ শুধুই স্মৃতি। তবে চার দশকেরও বেশি সময় ধরে এ গ্রামে বসবাস না করলেও আদি বাসিন্দারা ও তাদের প্রজন্ম প্রতি শুক্রবার ঠিকই বাপ-দাদার পুরনো মসজিদে জমায়েত হয়ে জুমার নামাজ আদায় করেন। দোয়া করেন- পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়া তাদের বাবা-মা ও স্বজনদের জন্য। এখানেই তাদের পূর্বপুরুষদের শেষ ঠিকানা। গ্রামটি এখনো অন্যান্য গ্রাম থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। এর যোগাযোগ ব্যবস্থা বলতে যে রাস্তাটি ছিল সেটিও এখন সম্পূর্ণ বিলীন। তাই গ্রামে প্রবেশ করার একমাত্র পথ হচ্ছে দেড় কিলোমিটারেরও বেশি ক্ষেতের আইল। সম্প্রতি একজন সেখানে হাস-মুরগির খামার করে বসতি গড়ার চেষ্টা করছেন। একইভাবে গ্রাম ছেড়ে চলে যাওয়া সেসব প্রবীণ এবং তাদের বংশধররা সেখানে আবারও বসতি গড়তে চান; কিন্তু গ্রামটিতে যাতায়াতের রাস্তা না থাকায় এবং বিদু্যৎ ও নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করতে না পারায় তারা বসতি গড়ার সাহস পাচ্ছেন না। কথা হয় গ্রামটিতে একমাত্র মসজিদের ইমাম আব্দুর রহমানের সঙ্গে। তিনি বলেন, 'মাঠে কাজ করতে আসা মুসলিস্নদের নিয়ে ওয়াক্ত নামাজ ও শুক্রবারে জুমার নামাজ হয় এখানে। ইচ্ছা হয় আবারও এই গ্রামে ফিরে আসতে। তবে যোগাযোগ ও বিদু্যতের ব্যবস্থা হলে অনেকেই হয়তো বসবাস শুরু করবে।' বগুড়া জেলা প্রশাসক জিয়াউল হক বলেন, গ্রামবাসী ফিরতে চাইলে নিরাপত্তার পাশাপাশি সব ধরনের সহযোগিতাও করা হবে। স্থানীয় সংসদ সদস্য রেজাউল করিম বাবলু বলেন, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা লিখিতভাবে আবেদন করলে পেচুলগাড়ি থেকে পার্শ্ববর্তী গ্রামের সঙ্গে সংযোগ রাস্তাসহ অন্যান্য পদক্ষেপ নেওয়া হবে।