বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

হারিয়ে যাচ্ছে দেশি জাতের ধান

বৃষ্টি, বন্যা ও প্রাকৃতিক সহিষ্ণু অসংখ্য ধান ছিল বাংলাদেশে। দেশি জাতের ধানগুলো ছিল পরিবেশবান্ধব। হাইব্রিড আর বহুজাতিক কোম্পানির বাণিজ্যের দাপটে হারিয়ে যাচ্ছে বাংলার ধান
ম আলতাব হোসেন
  ০২ আগস্ট ২০২১, ০০:০০
আপডেট  : ০২ আগস্ট ২০২১, ০৯:৪৪

দুই যুগ আগেও নেত্রকোনা ও ময়মনসিংহ অঞ্চলের নিম্নাঞ্চলে ব্যাপক চাষ হতো কুমড়ি নামে একটি স্থানীয় জাতের ধান। সেই ধান রোপণের পর বন্যা বা বৃষ্টি হলে খাল-বিলে যত হাত পানি হতো, ধানটিও তত লম্বা হতো। পানি কমার সাথে ধানগাছটিও নিজেকে গুটিয়ে নিত। পরে লম্বা হয়ে মাটি থেকে আবার ধান গাছটি দাঁড়িয়ে যেত। এই ধান ছিল ওই এলাকার জলবায়ু সহিষ্ণু। বরিশাল অঞ্চলের জনপ্রিয় বালাম ধান এখন দেখা যায় না। টাঙ্গাইল অঞ্চলে একটি স্বাস্থ্যসম্মত ধান ছিল চামারা। ওই এলাকার মানুষ বলত, 'ধানের মধ্যে চামারা আর ইষ্টির মধ্যে মামারা।' বৃষ্টি, বন্যা ও প্রাকৃতিক সহিষ্ণু অসংখ্য ধান ছিল বাংলাদেশে। দেশি জাতের ধানগুলো ছিল পরিবেশবান্ধব। হাইব্রিড আর বহুজাতিক কোম্পানির বাণিজ্যের দাপটে হারিয়ে যাচ্ছে বাংলার ধান। অথচ একটা সময় কৃষকরা নিজেদের উদ্ভাবিত লবণাক্ততা সহিষ্ণু, খরা সহিষ্ণু, বন্যা সহিষ্ণু, জলাবদ্ধতা সহিষ্ণু ধানের আবাদ করতেন। হারিয়ে যাওয়া এসব পেটপূর্তি ছাড়াও শারীরিক অনেক উপকারে আসত। যেমন অসুস্থ লোককে কালোজিরা ধান খাওয়ালে সে দ্রম্নত আরোগ্য লাভ করত। এমন ধান ছিল যা গর্ভবতী নারীর জন্য বিশেষ উপকার হতো। এমন জাতের ধানও ছিল যার মাড় খেয়ে দিন কাটিয়ে দিত দরিদ্র মানুষ। দুই থেকে তিন পাতিলে ভাত রেখে দিয়ে পরে খেতে পারতেন। ভাত নষ্ট হতো না। সেসব ধানের পান্তাভাত খেয়ে কৃষকরা মাঠে কাজ করতে যেতেন। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ডক্টর মো. শাহজাহান কবীর যায়যায়দিনকে বলেন, গত শতাব্দীতে দেশে প্রায় ১৮ হাজার ধানের জাতের চাষ হতো। ১৯৩৯ সালে প্রতিষ্ঠিত কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের প্রথম অর্থনৈতিক উদ্ভিদ বিজ্ঞানসংক্রান্ত গবেষণা বিভাগের আওতায় ডক্টর জি পি হেক্টর নামে ইরির একজন বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশের ধানের ওপর গবেষণা করেন। তার গবেষণায় দেখা গেছে দেশে ১৮ হাজার ধানের চাষাবাদ হতো। দেশে বর্তমানে পাহাড়ি অঞ্চল থেকে সমতল অঞ্চলে আউশ, আমন ও বোরো মৌসুমে হাতে গোনা কয়েকটি ধানের চাষ হচ্ছে। যার মধ্যে অধিকাংশ হাইব্রিড ও উচ্চফলনশীল জাতের ধান। তিনি আরও বলেন, খরা, লবণাক্ত, জলাবদ্ধসহ বিভিন্ন খাত সহিঞ্চু, জিংকসমৃদ্ধ ধানের জাত উদ্বাবন করা হয়েছে। যা মাঠ পর্যায়ে নিয়ে যেতে কাজ করছেন সম্প্রসারণ কর্মীরা। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের সর্বশেষ ২০১১ সালের এক জরিপে জানা গেছে, দেশে আউশ, আমন ও বোরো মৌসুমে সারাদেশে আট হাজার ৬০০ জাতের দেশি ধান চাষ হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, হাইব্রিড ও উচ্চফলনশীল ধানের দাপটে দিনের পর দিন হারিয়ে যাচ্ছে দেশি জাতের ধান। বেশি ফলনের আশায় কৃষকরা ঝুঁকছেন হাইব্রিডে। সরকারও খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা ধরে রাখতে হাইব্রিডে জোর দিচ্ছেন। গত বোরো মৌসুমেও সরকারি উদ্যোগে দুই লাখ হেক্টর জমিতে হাইব্রিড ধান চাষ করা হয়। হাওড় অঞ্চলে দেশীয় প্রজাতির ধান যা ইতিমধ্যে হারিয়ে গেছে তার মধ্যে রয়েছে- নাজিশাইল, লাকাই, রাতা শাইল, পানি শাইল, টেপি, রঙ্গিলা টেপি, রাজাশাইল, বিচি, ধলাকাচাই, মৌমাইল ও গড়িয়া ইত্যাদি। একটা সময় অতিথিদের আপ্যায়নের জন্য বিভিন্ন রকমের সুস্বাদু জাতের ধানের চাল দিয়ে রান্না করা হতো। বরিশাল অঞ্চলে বালাম ধানের জন্য বিখ্যাত ছিল। বালাম চালের সুখ্যাতি ছিল দেশের গন্ডি ছাড়িয়ে বহির্বিশ্বেও। বালামের অনেক স্থানীয় নাম ছিল। সেগুলো হচ্ছে- শিতাভোগ, জয়না, নলডোক, রূপের শাইল, রাজশাইল, কুটিআগনি, বেতিচিকন, কেয়া মৌ, কেরাঙ্গাল, বাঁশফুল, ডিঙ্গামনি ও লক্ষ্ণীবিলাস। কৃষি বিজ্ঞানীরা বলছেন, বালামের সঙ্গে ব্রি'র উদ্ভাবিত বিআর-৪৯ ও ৫৫ এবং উত্তরাঞ্চলের মিনিকেটের মধ্যে ক্রস ব্রিডিং করে বালামের উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব। দেশে-বিদেশে ব্যাপক চাহিদা থাকায় বালাম রপ্তানি করেও অর্থ উপার্জন সম্ভব। দেশের বরেন্দ্র এলাকার জনপ্রিয় ধান ছিল- গোবিন্দভোগ, জামাইভোগ, মোগাইবালাম, রূপকথা, রাঁধুনীপাগল ও পাঙ্গাস। পানি সংকটাপূর্ণ এলাকায় এসব ধানের ফলন ভালো হতো। এখন হাইব্রিড জাতের ধানের চাষাবাদে অধিক সেচ দিতে হচ্ছে। কৃষকের সার ও কীটনাশক খরচ বাড়ায় ধান উৎপাদনে খরচ বাড়ছে। উত্তরাঞ্চলে ধান উৎপাদনে শুধু সেচ খরচ বেড়েছে ৬০ শতাংশ। কারণ উচ্চ ফলনশীল ধান চাষে বেশি পানির প্রয়োজন হয়। এতে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নামছে। উত্তরাঞ্চলে স্বল্প খরচ পরিবেশবান্ধব দেশীয় প্রজাতির ধান চাষ এখন সুদূর অতীত। যেসব দেশীয় প্রজাতির ধান ইতিমধ্যে হারিয়ে গেছে তা হলো- দুমড়া, চাপালো, কাচাননী, ধলকাচাই, গড়িয়া, মৌমাইল, জশোয়া, নীলকমর, নয়ারাজ, বসি, বেতো, পানিশাইল, শাইল্যা, বেগুনবিচি ইত্যাদি। সাপাহার এলাকার কৃষক আব্দুল লতিফ বলেন, দেশি জাতের ধান চাষের উৎপাদন খরচ কম ছিল। তখন ধান কাটার মৌসুমে গ্রামে পিঠা পায়েস, চিড়া, খই, মুড়ি তৈরির ধুমও ছিল। দেশি জাতের ধান আবাদে অতিরিক্ত সার-কীটনাশক ব্যবহারের প্রয়োজন পড়ত না। এতে প্রতি বছর জমির উর্বরা শক্তি নষ্ট হতো না। এ বিষয়ে ধান গবেষক ডক্টর হামিদুল ইসলাম যায়যায়দিনকে বলেন, বাংলাদেশে এখনো প্রধান খাদ্য ভাত এবং এ দেশের কৃষকরা বছরে এখন তিনটি ফসল চাষ করছেন। আগের মতো মৌসুম ভিত্তিক শত শত জাতের ধান আবাদ করার জন্য বীজ ধান পান না। উচ্চ ফলনের আশায় এখন মাত্র পাঁচ থেকে আটটি ধানের মধ্যে আটকে গেছেন কৃষকরা। তিনি আরও বলেন, দেশীয় প্রতিটি ধানের মধ্যেই এমন অনেক গুণাবলি আছে যা ভবিষ্যতে আরও উন্নতমানের ধানের জাত উদ্ভাবনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। রাজশাহীর হেরিটেজ বাংলাদেশ নামে একটি সংস্থার কাছে ১০০ থেকে ১৫০ ও সিলেটের আব্দুল বাছিত নামে এক ব্যক্তির কাছে ৬০ থেকে ৬৫টি দেশি জাতের সুগন্ধি ধানের বীজ সংরক্ষিত আছে। সরকারের উচিত দেশি ধানের পেটেন্ট তৈরি করে সংরক্ষণ করা। অন্যথায় আমরা এসব বীজ হারিয়ে ফেলব। একটি দেশি ধানের জাত হারিয়ে যাওয়ার সঙ্গে একটি এলাকার সংস্কৃতিতেও বিরূপ প্রভাব পড়ছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে