১৪ দিনের রিমান্ডে হেলেনা জাহাঙ্গীর

জয়যাত্রা টেলিভিশন :জেলায় নিয়োগে ৫০ হাজার, চলত হংকংয়ের তরঙ্গে

প্রকাশ | ০৪ আগস্ট ২০২১, ০০:০০ | আপডেট: ০৪ আগস্ট ২০২১, ০০:৪৪

ম যাযাদি রিপোর্ট

একের পর এক চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসছে হেলেনা জাহাঙ্গীরের মালিকানাধীন আইপি বা অনলাইন টেলিভিশন 'জয়যাত্রা টেলিভিশন' সম্পর্কে।র্ যাব বলছে, হংকং থেকে বরাদ্দ নেওয়া তরঙ্গে বাংলাদেশসহ বিশ্বের ৩৪টি দেশে 'জয়যাত্রা টেলিভিশন' সম্প্রচার করা হতো। এজন্য প্রতি মাসে প্রায় ছয় লাখ টাকা পরিশোধ করতে হতো। অনুমোদনহীন এ টিভির প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগ পেতে ৫০ হাজার এবং উপজেলা প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগ পেতে ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা এককালীন দিতে হতো। এমনকি দেশের বাইরেও প্রতিনিধি নিয়োগ দেওয়া হতো এক থেকে পাঁচ লাখ টাকার বিনিময়ে। মঙ্গলবার দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারের্ যাবের মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে বাহিনীর মুখপাত্র খন্দকার আল মঈন এসব তথ্য জানান। এর আগে আওয়ামী লীগের উপ-কমিটির সদস্য পদ থেকে অব্যাহতিপ্রাপ্ত হেলেনা জাহাঙ্গীরের দুই সহযোগী এবং জয়যাত্রা ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তা হাজেরা খাতুন ও সানাউলস্নাহ নূরীকে গ্রেপ্তার করের্ যাব-৪। মঙ্গলবার ভোরে রাজধানীর গাবতলী এলাকা থেকে অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। এ সময় তাদের কাছ থেকে দুটি ল্যাপটপ ও দুটি মোবাইল ফোন জব্দ করা হয়। কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, গ্রেপ্তার হাজেরা খাতুন ২০০৯ সালে কুমিলস্নার একটি কলেজ থেকে মাস্টার্স সম্পন্ন করে হেলেনা জাহাঙ্গীরের মালিকানাধীন মিরপুরে একটি গার্মেন্টে অ্যাডমিন (এইচআর) পদে চাকরি শুরু করেন। তিনি হেলেনা জাহাঙ্গীরের নিকটাত্মীয় এবং একই সঙ্গে কর্মদক্ষতা বলে হেলেনার অত্যন্ত আস্থাভাজন হয়ে ওঠেন। ২০১৬ সালে তিনি 'জয়যাত্রা ফাউন্ডেশন'র ডিজিএম হিসেবে নিযুক্ত হন। এরপর ২০১৮ সালে জয়যাত্রা টিভি প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে জিএম (অ্যাডমিন) পদে নিযুক্ত হন। হাজেরা মূলত দুটি প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক কার্যক্রমসহ হেলেনার আর্থিক বিষয়াদি দেখভাল করতেন বলে জিজ্ঞাসাবাদে জানান। র্ যাব জানায়, জয়যাত্রা টিভি ২০১৮ সাল থেকে হংকংয়ের একটি ডাউনলিংক চ্যানেল হিসেবে সম্প্রচার হয়ে আসছে। যার ফ্রিকোয়েন্সি হংকং থেকে বরাদ্দ করা হয়েছে। ফ্রিকোয়েন্সির জন্য হংকংকে মাসে প্রায় ছয় লাখ টাকা পরিশোধ করতে হতো। হংকং থেকে বরাদ্দ ফ্রিকোয়েন্সির মাধ্যমে বাংলাদেশে সম্প্রচারের কোনো বৈধ অনুমোদন নেই। হেলেনা জাহাঙ্গীর প্রতি মাসে হংকং যেভাবে টাকা পাঠাতেন সেটা অবৈধ কি না জানতে চাইলের্ যাবের কর্মকর্তা বলেন, 'প্রতি মাসে হংকং তিনি টাকা পাঠাতেন, এটি আমরা খতিয়ে দেখছি। অন্য সংস্থাগুলোও খতিয়ে দেখবেন। এটা পাচার। এসব তথ্য আমরা দুদক, সিআইডিসহ সব সংস্থাকে জানাব।' র্ যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক বলেন, বাংলাদেশের প্রায় ৫০টি জেলায় সম্প্রচারিত হয় এ জয়যাত্রা টিভি। টিভি চ্যানেলটি রাজধানী ও জেলা পর্যায়ের পাশাপাশি মফস্বল ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে জনপ্রিয় করার লক্ষ্যে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত পরিকল্পনা নেওয়া হয়। যাতে প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে অধিক সংখ্যক প্রতিনিধি নিয়োগের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করা যায়। সম্প্রচারের জন্য রিসিভার জয়যাত্রা টিভি বা তার প্রতিনিধির মাধ্যমে ক্যাবল ব্যবসায়ীদের কাছে সরবরাহ করা হয়। ক্যাবল ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে সম্প্রচার নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হলে চাকরিচু্যত করা হতো প্রতিনিধিদের। হাজেরা খাতুনের দেওয়া তথ্যমতে, অর্থ বাণিজ্যের মাধ্যমে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অনেক বিতর্কিত ব্যক্তিরা নিয়োগ পেয়েছেন জয়যাত্রা টিভিতে। হেলেনা জাহাঙ্গীরের পরিকল্পনা, উৎসাহে বা চাপে, নির্দেশনায় জয়যাত্রা টিভির কোনো কোনো প্রতিনিধি নেতিবাচক কর্মকান্ডে জড়িত হন। এ ছাড়া প্রত্যন্ত অঞ্চলে ব্যক্তি প্রচার, প্রার্থিতা প্রচার, সাক্ষাৎকার ইত্যাদির মাধ্যমে অর্জিত অর্থের একটি অংশ গ্রেপ্তারদের মাধ্যমে হেলেনা জাহাঙ্গীর গ্রহণ করতেন। হাজেরা খাতুনের জিজ্ঞাসাবাদের্ যাব আরও জানতে পারে, দেশের ৫০টি জেলায় প্রতিনিধি নিয়োগ দিয়েছিল জয়যাত্রা টেলিভিশন। বিনিময়ে প্রতিনিধিদের কাছ থেকে ৫০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা নিয়েছিল। উপজেলা পর্যায়ের প্রতিনিধিদের কাছ থেকে ১০ থেকে ২০ হাজার করে টাকা নেওয়া হতো। জেলা পর্যায়ের প্রতিনিধিদের কাছ থেকে মাসে মাসে ২০ থেকে ৫০ হাজার টাকা নিত। আর উপজেলা প্রতিনিধিদের কাছ থেকে প্রতি মাসে ২ থেকে ৩ হাজার টাকা নিত। র্ যাব জানায়, দেশের বাইরে প্রতিনিধি নিয়োগের ক্ষেত্রে এক থেকে ৫ লাখ টাকা নিত। এই টেলিভিশনের প্রতিনিধিরা বিভিন্ন অখ্যাত ব্যক্তির সাক্ষাৎকার প্রচার করে টাকা নিতেন, অনৈতিক বিজ্ঞাপন প্রচার করেও টাকা নিতেন। যেসব বিজ্ঞাপন প্রতিষ্ঠিত গণমাধ্যমে প্রচারিত না হতো সেগুলো জয়যাত্রা টিভিতে প্রচার করা হতো। যেমন- 'তাবিজ-কবচ', 'টোটকা-ফাটকা', 'ভাগ্য বলে দিতে পারা', 'জিনের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ,' 'ফাড়া কেটে যাওয়া' এবং 'গোপন সমস্যার সমাধান' ইত্যাদি। হাজেরা খাতুন জানান, হেলেনা জাহাঙ্গীর জয়যাত্রা টিভিকে নিজের প্রচার ও প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য ব্যবহার করতেন। উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বিভিন্ন ব্যক্তির বিরুদ্ধে জয়যাত্রা টিভি ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নেতিবাচক প্রচারণা চালাতেন। তিনি তার প্রতিষ্ঠান থেকে চাকরিচু্যতদেরও একইভাবে হেনস্তা করতেন। তিনি জানান, জয়যাত্রা টিভির বিশাল নেটওয়ার্ক নিয়ে তিনি নেতিবাচক উদ্দেশ্য চরিতার্থে একটি পরিকল্পনা তৈরি করেন। মূল মিডিয়া জগতের বিপরীতে তিনি একটি সংগঠন তৈরির পরিকল্পনা করেন, যেখানে ৫ হাজার সংবাদকর্মীর একটি বিশাল নেটওয়ার্ক তৈরি হবে। তিনি দেশব্যাপী এ নেটওয়ার্ক হীন স্বার্থে ব্যবহারের পরিকল্পনা করেন। মাঝেমধ্যে তিনি ঢাকায় কর্মী সমাবেশ করতেন এবং ক্ষেত্রবিশেষ নিজের শোডাউনে তাদের ব্যবহার করতেন। জয়যাত্রা ফাউন্ডেশন সম্পর্কের্ যাবের কর্মকর্তা খন্দকার আল মঈন বলেন, ফাউন্ডেশনে ডোনার, জেনারেল মেম্বার, লাইফ টাইম মেম্বার ইত্যাদি ক্যাটাগরিতে অর্থ সংগ্রহ করা হতো। এই সংগঠনের প্রায় ২০০ জন সদস্য রয়েছে। যাদের কাছ থেকে সদস্যপদ বাবদ ২০ হাজার থেকে দুই লাখ টাকা পর্যন্ত সংগ্রহ করা হয়েছে। যার সামান্যই মানবিক কাজে ব্যবহার করে জয়যাত্রা টিভি ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারণা চালানো হতো। অবশিষ্ট অর্থ তার সন্তানদের নামে সঞ্চয় করা হতো বলে হাজেরা জানান। সানাউলস্ন্যা নুরী জয়যাত্রা টিভির প্রতিনিধি সমন্বয়ক ছিলেন। তিনি হেলেনা জাহাঙ্গীরের নির্দেশনায় প্রতিনিধিদের সমন্বয় করতেন। প্রতিনিধিদের কেউ মাসিক টাকা দিতে ব্যর্থ হলে বা গড়িমসি করলে তিনি ভয়ভীতি প্রদর্শন করতেন। এলাকায় তার নামে চাঁদাবাজির অভিযোগ রয়েছে। তিনি গাজীপুর গার্মেন্ট সেক্টরে ব্যাপক চাঁদাবাজি করে তার একটি অংশও জয়যাত্রা টিভিকে দিতেন বলে জানান। এ ছাড়াও তিনি গাজীপুর ও আশপাশের এলাকার অনুমোদনহীন জয়যাত্রা টিভির সম্প্রচার নিশ্চিত করতেন। জয়যাত্রা টিভির সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রীর সম্পর্ক আছে কি না- এমন প্রশ্নের উত্তরে খন্দকার আল মঈন বলেন, আমরা দেখেছি, হেলেনা জাহাঙ্গীর বিভিন্ন ব্যক্তির সঙ্গে তোলা ছবি ব্যবহার করতেন। এসব ছবি তিনি নিজের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে এবং বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে প্রতারণার জন্য ব্যবহার করতেন। আপনারা যা বলেছেন, তা এ ধরনের প্রতারণার অংশ কি না- তা গোয়েন্দাসহ বিভিন্ন সংস্থা খতিয়ে দেখছে। ৪ মামলায় ১৪ দিনের রিমান্ডে হেলেনা জাহাঙ্গীর এদিকে পৃথক ৪ মামলায় হেলেনা জাহাঙ্গীরের ১৪ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর হয়েছে। মঙ্গলবার ঢাকার দুই মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট পৃথক আদেশে তার এ রিমান্ড মঞ্জুর করেন। রাজধানীর মিরপুর থানার প্রতারণা মামলা এবং পলস্নবী থানার টেলিযোগাযোগ আইনের মামলায় দুপুর আড়াইটায় হেলেনার ৪ দিন করে মোট ৮ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট শাহীনুর রহমান। পরে বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে গুলশান থানার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলা এবং মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের মামলায় ৩ দিন করে ৬ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট নিভানা খায়ের জেসি। সব মিলিয়ে ৪ মামলায় হেলেনা জাহাঙ্গীরের মোট ১৪ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর হলো। গুলশান থানার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দায়ের করা মামলায় গত ৩০ জুলাই হেলেনা জাহাঙ্গীরের তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর হয়েছিল। মঙ্গলবার এই তিন দিনের মেয়াদ শেষ হয়। এই মামলায় ফের ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন করে হেলেনাকে আদালতে হাজির করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা শেখ শাহানুর রহমান। আইপি টিভির নামে অপসাংবাদিকতা বিষয়ে প্রশ্ন হাইকোর্টের সম্প্রতি আইপি টিভির মাধ্যমে চাঁদাবাজির ঘটনা সামনে আসায় হেলেনা জাহাঙ্গীর ও সাংবাদিকতার বিষয়ে প্রশ্ন রেখে হাইকোর্ট বলেছেন, 'ইদানীং সাংবাদিকতার নামে এসব কী হচ্ছে? দেখেন না কী হচ্ছে? কী এক জাহাঙ্গীর বের হয়েছে? আইপি টিভির নামে কত চ্যানেল বের হয়েছে!' দুদক আইনজীবী খুরশীদ আলম খানকে উদ্দেশ্য করে আদালত এসব কথা বলেন। চট্টগ্রামের দৈনিক পূর্বকোণসহ বেশ কয়েকটি পত্রিকায় আদালতের আদেশ নিয়ে ভুল সংবাদ পরিবেশনের বিষয়ে শুনানিকালে মঙ্গলবার বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বাধীন ভার্চুয়াল হাইকোর্ট বেঞ্চ এ মন্তব্য করেন। শুনানি শেষে চট্টগ্রামের যেসব পত্রিকা আদালতের আদেশ নিয়ে ভুল সংবাদ পরিবেশন করেছে, সব পত্রিকাকে সংশোধনী দিয়ে দুঃখ প্রকাশ করতে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে মামলার পরবর্তী আদেশের জন্য আগামী ৪ আগস্ট দিন নির্ধারণ করেন আদালত। এর আগে মো. খুরশীদ আলম খান আদালতকে জানান, চট্টগ্রামের দৈনিক পূর্বকোণ পত্রিকা ভুল সংবাদ পরিবেশনের জন্য দুঃখ প্রকাশ করে সংশোধনী দিয়েছে।