প্রসাধন ও টয়লেট্রিজ পণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণহীন

ছয় মাসের ব্যবধানে দাম বেড়েছে ২৭ শতাংশ পযর্ন্ত উৎপাদন ব্যয় বাড়ার যুক্তি দিচ্ছেন উৎপাদকরা বাজেটে কঁাচামালের আমদানি শুল্ক কমানো হলেও দাম বাড়ছে দাম অপরিবতির্ত রেখে ওজন কম ও মোড়কের আকার ছোট করছে বিভিন্ন ব্রান্ড

প্রকাশ | ২৩ অক্টোবর ২০১৮, ০০:০০

আহমেদ তোফায়েল
নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে প্রসাধন ও টয়লেট্রিজ সামগ্রীর বাজার। কী সাবান, কী টুথপেস্ট, পাউডার, কী ডিটারজেন্ট শ্যাম্পু এবং টয়লেট্রিজ পণ্য সবকিছুরই দাম বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। বাজার চলছে ইচ্ছেমতো। বাজার অনুসদ্ধানে জানা যায়, গত ছয় মাসের মধ্যে প্রায় সব ধরনের প্রসাধন ও টয়লেট্রিজ সামগ্রীর খুচরা বাজারে দাম বেড়েছে ২৭ শতাংশ পযর্ন্ত। অথচ এ ব্যাপারে কারও কোনো নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নেই। সে সুযোগে অন্যায় দাম বৃদ্ধি করে যাচ্ছে মুনাফাখোর কোম্পানিগুলো। রাজধানীর বিভিন্ন পাইকারি ও খুচরা বাজারে খেঁাজ নিয়ে জানা যায়, হঠাৎ করেই দাম বাড়ছে প্রসাধন ও টয়লেট্রিজ সামগ্রীর। অনেক কোম্পানি দাম অপরিবতির্ত রাখলেও ওজন কমিয়ে মোড়কের আকার ছোট করেছে। নিত্য ব্যবহাযর্ এসব পণ্যের অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধিতে সমস্যায় পড়েছেন নিদির্ষ্ট আয়ের সাধারণ মানুষ। উৎপাদকরা উৎপাদন ব্যয় বাড়ার যুক্তি দিলেও সংশ্লিষ্ট অনেকে বলছেন, এটা তাদের খেঁাড়া যুক্তি। কারণ, দাম বাড়ার এমন কিছু ঘটেনি। অথচ চলতি অথর্বছরে এ সম্পকির্ত অনেক কঁাচামাল আমদানিতে শুল্ক ছাড় দেয়া হয়েছে। ফলে যেখানে দাম কমার কথা, যেখানে উল্টো তারা দাম বাড়িয়ে চলেছেন। খুচরা দোকানিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অনেক প্রতিষ্ঠান মূল্য সমন্বয়ের জন্য তাদের পণ্যের মোড়ক ছোট করেছে। যদিও কিছু উৎপাদক বলছেন, পণ্যের উৎপাদন খরচ দিন দিন বাড়ছে, যার কারণে এসব কাজ করতে হচ্ছে। তবে ভোক্তা অধিকার আন্দোলনের কমীর্রা তাদের এ দাবি প্রত্যাখ্যান করে বলছেন, কিছু কিছু পণ্যের কঁাচামালের আমদানি খরচ কমেছে। যার ফলে যেখানে উৎপাদন ব্যয় কমার কথা, সেখানে বাড়ছেÑ এটা কোনো যুক্তিতেই আসে না। বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, বাজারে একচেটিয়া দখল থাকার কারণে এভাবে বল্গাহীন দাম বাড়াতে পারছে তারা। বিশেষ কয়েকটি পণ্যের ক্ষেত্রে বাজার একেবারেই তাদের দখলে। কোনো একটি কোম্পানি নিজের পণ্যের দাম বাড়ালে তাকে অনুসরণ করে অন্যরাও সমজাতীয় ওই পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়। যে প্রতিযোগিতা হওয়ার কথা পণ্যের গুণগত মান বাড়ানোর ক্ষেত্রে, তা হচ্ছে দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে। দাম বাড়লেও পণ্যের মান বাড়ানো হয়েছে মমের্ কোনো প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে না। একই মানের পণ্য ছয় মাসের ব্যবধানে বিক্রি করা হচ্ছে বধির্ত দামে। ঠিক কী কারণে দাম বাড়ানো হলো, তার কোনো জবাব নেই। কেউ এর জবাব চায়ও না তাদের কাছে। এসব পণ্যের বাজারে সরকারের নেই কোনো নিয়ন্ত্রণ। ক্রমাগত ঠকছে ভোক্তা। ঠকছে সাধারণ মানুষ। লাভবান হচ্ছে বহুজাতিক ও দেশীয় গৃহস্থালি পণ্য উৎপাদক কোম্পানিগুলো। গত কয়েক মাসে বহুজাতিক কোম্পানি ইউনিলিভারের ১০০ গ্রাম ওজনের প্রতিটি লাক্স সাবানের মূল্য ৩০ টাকা থেকে বেড়ে ৩৪ টাকা এবং ১৫০ গ্রামের ৪২ টাকা থেকে বেড়ে ৪৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বাংলাদেশ কসমেটিকস অ্যান্ড টয়লেট্রিজ ম্যানুফেকচারাসর্ অ্যাসোসিয়েশনের (বিসিটিএমএ) সূত্রানুসারে, ৪৫ শতাংশ বাজার দখলে রাখা লাক্স দেশে সব থেকে বেশি জনপ্রিয় বিউটি সোপ। ইউনিলিভারের গুঁড়া সাবান হুইল ব্রান্ড যা বাজারের শীষর্ ব্রান্ডের অবস্থানে আছে। খুচরা বাজারে ৫০০ গ্রামের প্যাকেটের দাম ৩৫ টাকা থেকে বেড়ে ৪২ টাকা হয়েছে। ইউনিলিভারের অন্য আরেকটি ডিটারজেন্ট ব্রান্ড রিন। যা দ্রæত জনিপ্রিয় হওয়া একটি পণ্য। এর প্রতি কেজিতে ২৬ দশমকি ৩ শতাংশ দাম বেড়েছে । ধানমÐি ও মোহাম্মদপুর এলাকার এনবিএস ডিসট্রিবিউশন কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধি মো. জামান জানান, একই কোম্পানির সাফর্ এক্সেল নামের আরও একটি ডিটারজেন্ট ব্রান্ড ২০ গ্রামের (মিনি প্যাক) মূল্য ৪ টাকা থেকে বেড়ে ৫ টাকা হয়েছে। এদেশে দীঘর্ ৪০ বছর ধরে মানুষের আস্থা অজর্ন করা জনপ্রিয় টয়লেট ক্লিনার ব্র্যান্ড হারপিক। হারপিকের উৎপাদন এবং বাজারজাতকারী কোম্পানি রেকিট বেনকিজার। বাজারে শীষর্ স্থানীয় এই পণ্যটির দাম ৮৫ টাকা থেকে বেড়ে ১০০ টাকা হয়েছে। বৃদ্ধির এই হার ১৭ দশমকি ৬ শতাংশ। এই কোম্পানির আরও একটি পণ্য ডেটল সোপ। ৭৫ গ্রাম ওজনের একটি সাবানের দাম ৩২ টাকা বেড়ে ৩৬ টাকা হয়েছে। কোহিনুর কেমিক্যালস কোম্পানি তাদের পণ্য স্যান্ডেলিনা বিউটি সোপের দাম ৭৫ গ্রামে এক টাকা এবং ১২৫ গ্রামে দুই টাকা বাড়িয়েছে। ধানমÐির মুদি দোকানি মো. বেলাল হোসেন জানান, বিভিন্ন ব্রান্ডের মিনি প্যাক শ্যাম্পু যেমন- হেড অ্যান্ড সোল্ডাসর্, প্যান্টিন, অল ক্লিয়ার এবং ডাভ এক টাকা করে বেড়েছে। ইউনিলিভারের সানসিল্ক মিনি প্যাক এখনো দুই টাকায় পাওয়া যাচ্ছে। তবে নতুন মোড়কে এক মিলিলিটার শ্যাম্পু কম দিচ্ছে। আগে একই দামে পাওয়া যেত ৭ এমএল এখন দিচ্ছে ৬ এমএল। এদিকে ক্লোজ-আপ ব্রান্ডের ৫০ গ্রাম ওজনের টুথপেস্টের দাম কিছু দিন আগেও ৩৫ টাকা ছিল। কিন্তু এখন কোম্পানি সরবরাহ করছে ৪৫ গ্রামের মোড়ক এবং দাম নিধার্রণ করেছে ৪০ টাকা। এর ফলে খুচরা বাজারে এই পণ্যটির প্রায় ২৭ শতাংশ মূল্য বেড়েছে। কয়েক দিন আগেও ১০০ গ্রাম ওজনের পেপসোডেন্ট টুথপেস্টের দাম ছিল ৮০ টাকা। কিন্তু এখন কোম্পানি ৯০ গ্রাম ওজনের মোড়ক সরবরাহ করছে, দাম নিধার্রণ করেছে ৯০ টাকা। অথার্ৎ এই পণ্যের দাম প্রায় ২৫ শতাংশ বেড়েছে। একই সময়ে ডিস, গøাস এবং টয়লেট পরিস্কারক এবং নারিকেল তেলের দামও বেড়েছে। মেরিকো বাংলাদেশের পণ্য প্যারাসুট নারিকেলের ২০০ এমএল বোতলের দাম ১০৮ থেকে বেড়ে ১২০ টাকা হয়েছে। কোহিনুর কেমিক্যাল কোম্পানির এক কমর্কতা নাম প্রকাশ না করার শতের্ জানান, স্যান্ডোলিনা সাবানের উৎপাদন খরচ বাড়ার কারণে তারা ইউনিট প্রতি ৪ টাকা দাম বাড়িয়েছেন। তিন বছর পর কোম্পানি এই মূল্য পরিবতর্ন করল। কোম্পানিটি প্রসাধন ও টয়লেট্রিজ সামগ্রীর বাজারের ১৭ শতাংশ দখল করে আছে। কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সেক্রেটারি হুমায়ুন কবির ভূইয়া বলেন, টয়লেট্রিজ এবং প্রসাধন সামগ্রী নিত্য ব্যবহাযর্ পণ্য। এই উচ্চমূল্য নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির জীবনযাত্রায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। তবে এ বছর কোম্পানিগুলো নজিরবিহীনভাবে দাম বাড়িয়েছে। তিনি আরও বলেন, চলতি অথর্বছর এসব পণ্যের অনেকগুলোর আমদানি শুল্ক কমানো হয়েছে। কিন্তু দাম কেন বাড়ছে তা জানা নেই। ভোক্তা স্বাথের্র কথা বিবেচনা করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এই বিষয়টিতে নজর দেয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি। অন্যদিকে প্রসাধনী পণ্যে শুধূ দাম বৃদ্ধি নয়, বাংলাদেশের যেসব প্রসাধন সামগ্রী ব্যবহার করা হয়, সেগুলোর বেশির ভাগই ক্ষতিকর বিষাক্ত রাসায়নিক উপাদান রয়েছে যা স্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর বলে জানিয়েছে বেসরকারি একটি সংস্থা। ২০১৬ সালে এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অগার্নাইজেশন (এসডো) নামের সংস্থাটি বাংলাদেশের নামীদামি ৩৩টি প্রসাধনী পণ্য পরীক্ষা করে সবগুলোয় ক্ষতিকর উপাদানের অস্তিত্ব পায়। বাংলাদেশ কসমেটিকস অ্যান্ড টয়লেট্রিজের ইমপোটার্সর্ অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য, দেশের বাজারে চার হাজার কোটি টাকার প্রসাধনী পণ্য বিক্রি হয়। আর খ্যাতনামা আন্তজাির্তক ব্র্যান্ডের প্রসাধনী প্রায় সবই দেশের বাইরে থেকে আমদানি করতে হয়, যার দামও খুব বেশি। এ সুযোগে প্রসাধনী ব্যবসায়ীরা নকল প্রসাধনী তৈরি করেন। তবে নামীদামি কোম্পানির প্রসাধনী কিনলে ঝুঁকি কম থাকে। কিন্তু তাদের কাছ থেকে নগদ টাকায় কিনতে হয় বলে কিছু সুপারশপ ভিন্ন মাধ্যম থেকে বাকিতে এসব পণ্য ক্রয় করে। এ সুযোগে সুপারশপেও নকল পণ্য ঢুকে যাচ্ছে। আবার মিডফোটের্র্র কিছু কেমিক্যাল দোকান থেকেও ভেজাল প্রসাধনী তৈরির কঁাচামাল সংগ্রহ করে তা দিয়ে ভেজাল কারখানায় নকল পণ্য তৈরি করানো হচ্ছে। বাজারে বতর্মানে সানসিল্ক, ডাভ ও সেনসোডাইনসহ বিভিন্ন ব্র্যান্ডের নকল প্রসাধনী সামগ্রী বিক্রি হচ্ছে। স¤প্রতি র‌্যাব-১০-এর অভিযানে কেরানীগঞ্জের জিঞ্জিরায় এ ধরনের ভেজাল প্রসাধনী সামগ্রীর পঁাচটি প্রতিষ্ঠানকে ১৪ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। একই সঙ্গে এসব প্রতিষ্ঠানের এক কোটি টাকার নকল পণ্য ধ্বংস করা হয়। দেশি-বিদেশি স্বনামধন্য বিভিন্ন কোম্পানির ২৪ প্রকার প্রসাধনী কোনো প্রকার মান নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই নকল করে সেখানে উৎপাদন করা হতো।