বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১
নওগাঁর নিয়ামতপুর

মোগল আমলের মসজিদ অযত্নে বিলুপ্তির পথে

রুহুল আমিন, নওগাঁ
  ২৪ অক্টোবর ২০২১, ০০:০০
নিয়ামতপুর উপজেলার ঐতিহ্যবাহী ধরমপুর মসজিদ

ইতিহাস বিজড়িত জেলা নওগাঁর বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে নানা ঐতিহাসিক স্থান ও স্থাপনা। তেমনি একটি ঐতিহ্যবাহী মসজিদ আছে নিয়ামতপুর উপজেলার ধরমপুর গ্রামে। মোগল আমলে নির্মিত মসজিদটি বর্তমানে অযত্ন, অবহেলায় বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে। বর্তমানে মসজিদটির কিছু ধ্বংসপ্রায় অবকাঠামো ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই।

নওগাঁ জেলা শহর থেকে প্রায় ৫৩ কিলোমিটার দূরে নিয়ামতপুর উপজেলার ভাবিচা ইউনিয়নের ধরমপুর গ্রামে অবস্থিত ধরমপুর মসজিদ। মসজিদের অবশিষ্ট দেয়ালের পরতে পরতে জানান দিচ্ছে প্রাচীন ঐতিহ্যের ছাপ। নান্দনিক নকশা ও সুনিপুণ নির্মাণশৈলী মনে করিয়ে দেয় মুসলিম ইতিহাসের নান্দনিকতা ও রুচিশীলতার কথা। স্থাপত্যকলা, শিল্প-সৌন্দর্যের আধার ধরমপুরে এ মসজিদ ঠিক কত বছর আগে নির্মাণ করা হয়েছিল, এর সঠিক কোনো তথ্য জানা না গেলেও ধারণা করা হয় কোনো এক সময় এর আশপাশে মুসলিম জনবসতি ছিল। মসজিদের পাশে বিশাল পুকুর থাকার কারণে এখানে মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছিল। আবার কী কারণে তারা মসজিদটি ছেড়ে অন্যত্র চলে যান সে সম্পর্কে সঠিক তথ্য আজও কেউ সঠিকভাবে জানতে পারেননি।

তবে স্থানীয় প্রবীণরা বলছেন এটি মোগল আমলে নির্মিত। এখানে দুই ঈদের নামাজ হতো। শেষ ঈদের জামাত ২০০০ সালে অনুষ্ঠিত হয়। ২০ বছর আগেও মসজিদটি অনেক সুন্দর ছিল। দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ আসতেন দেখতে। কিন্তু তা এখন বিলুপ্তপ্রায়। স্থানীয়দের অভিযোগ- বারবার প্রত্নতত্ত্ব বিভাগকে জানানো হলেও এখন পর্যন্ত কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি মসজিদটি রক্ষায়।

স্থানীয় ধরমপুর পাইকপাড়া-মন্ডলপাড়া হাফেজিয়া মাদ্রাসার শিক্ষক মহসিন আলী বলেন, মসজিদটির গঠন পদ্ধতি ও স্থাপত্য কৌশল শিল্পসমৃদ্ধ ও অনন্য। ৯ গম্বুজ বিশিষ্ট বর্গাকৃতির মসজিদটির ভেতরে রয়েছে চারটি সুদৃঢ় খিলান। দরজা রয়েছে মাত্র একটি। দ্বিতল ভবনের ভেতরে মেহরাব ও দেয়ালে আঁকা রয়েছে বিভিন্ন কারুকাজের ফুলদানি ও ফুল। মসজিদের দেয়ালের গাঁথুনি চার ফুট প্রস্থ, যা চুন ও সুরকি দিয়ে গাঁথা। মসজিদটির চিকন ইটের দেয়ালে এখনো রয়েছে নকশা করা কারুকাজ। মসজিদটি সিঁড়িসহ প্রবেশপথ, খোলা চত্বর ও মূল ভবন বা নামাজঘর- তিনটি অংশে বিভক্ত। তবে এর আয়তনের সঠিক তথ্য জানা যায়নি।

তিনি আরও বলেন, বিভিন্ন তথ্য মিলিয়ে মসজিদটির সম্ভাব্য বয়স নির্ধারণ করা হয়েছে প্রায় ৪০০ বছর। অযত্ন-অবহেলায় ঐতিহ্য ও গর্বের এই মসজিদ আশির দশক থেকে ধীরে ধীরে ধ্বংস হতে শুরু করে। দেখা দিয়েছে বড় বড় ফাটল। নামাজ পড়ার অনুপযুক্ত হওয়ার কারণে একই স্থানে এলাকাবাসীর উদ্যোগে আরও একটি মসজিদ স্থাপন করা হয়। বেশ কয়েকবার সরকারের পক্ষে মসজিদটি পরিদর্শন করা হলেও সংরক্ষণে এখনো কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। দ্রম্নত মসজিদটি সংস্কারের দাবি জানান তিনি।

ধরমপুর গ্রামের ৭০ বছর বয়সি প্রবীণ বাসিন্দা মাজেদ আলী জানান, ১৯২০ সালের দিকে বড় ধরনের ভূমিকম্পে ৯টি গম্বুজসহ মসজিদের কিছু অংশ ভেঙে যায়। তারপর থেকেই অনেকের কাছে ভাঙা মসজিদ নামেও পরিচিত পায়। মসজিদটির একটি দরজার ওপর মূল্যবান কষ্টি পাথরে খোদাই করে আরবি ভাষায় কোরআনের আয়াত লেখা ছিল। ৩৫-৪০ বছর আগে কে বা কারা পাথরটি চুরি করে নিয়ে যায়। গত বছর প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের কিছু লোক এসে পরিদর্শন করে গেছে কিন্তু এখনো কোনো উদ্যোগ নেয়নি।

স্থানীয় ভাবিচা ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার সাদেক আলী বলেন, আশির দশকে ঢাকা থেকে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা নিয়ামতপুরে আসেন, সেসময় তিনি এই মসজিদ পরিদর্শন করেছিলেন। আনুমানিক ১৭০০ খ্রিষ্টাব্দের ৯ গম্বুজবিশিষ্ট ৪টি পিলার ও পশ্চিম দিকে মেহরাবের এই মসজিদটি মোগল আমলের একটি মসজিদের ভিত্তি বলে সেসময় নিশ্চিত করেছিলেন তিনি। নওগাঁ জেলার ইতিহাস-ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে মোগল আমলে নির্মিত ঐতিহ্যবাহী মসজিদটি পরবর্তী প্রজন্মের জন্য সরকার এবং প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নেওয়া উচিত। এজন্য দ্রম্নত পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। নইলে যেটুকু অবশিষ্ট আছে তাও ধ্বংস হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন তিনি।

প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর বগুড়ার আঞ্চলিক পরিচালক মোছা. নাহিদ সুলতানার সঙ্গে ফোনে কথা হলে তিনি জানান, 'সম্প্রতি মসজিদটি আমরা পরিদর্শন করেছি। আমাদের কাছে মনে হয়েছে মসজিদটি মোগল আমলের একটি ভিত্তি। এটি প্রত্নসম্পদ সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী সংস্কারযোগ্য। বিষয়টি আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবগত করেছি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে