আজ নাজিরপুর গণহত্যা দিবস

এই দিনে নৃশংস হত্যাকান্ডের শিকার হন ৬২ জন

প্রকাশ | ০১ ডিসেম্বর ২০২১, ০০:০০

ম পাবনা প্রতিনিধি
আজ পহেলা ডিসেম্বর। পাবনার নাজিরপুর গণহত্যা দিবস। মহান মুক্তিযুদ্ধের এইদিনে নাজিরপুর গ্রামে হানাদার বাহিনী তাদের দোসর রাজাকার, আলবদর আর আলশামসদের সঙ্গে নিয়ে চালায় নির্মম হত্যাযজ্ঞ। এই হত্যাযজ্ঞে শহীদ হন অর্ধশতাধিক মুক্তিযোদ্ধা। পুড়িয়ে দেওয়া হয় অসংখ্য ঘরবাড়ি। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে আলাপকালে তারা বলেন, পাবনা শহরের অদূরে হেমায়েতপুর ইউনিয়ন। এই ইউনিয়নের সবচেয়ে বড় গ্রামটি নাজিরপুর। মুক্তিযুদ্ধের সময় এই গ্রামটি ছিল জেলার পশ্চিমাঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধাদের মূল ঘাঁটি। এখান থেকেই পরিচালিত হতো পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে হামলার রণকৌশল। জানা যায়, পাকিস্তানি বাহিনীর কাছেও আতঙ্কের নাম ছিল নাজিরপুর। প্রশিক্ষিত মুক্তিযোদ্ধারা নভেম্বরে নাজিরপুর ও এর আশপাশের গ্রামগুলোতে অবস্থান নিতে থাকে। তাদের গেরিলা আক্রমণে হানাদার বাহিনীর কয়েকজন সদস্য নিহত হয়। এ অবস্থায় আতঙ্কিত হয়ে পড়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। শঙ্কা সঞ্চারিত হতে থাকে। তাই চরমপন্থিরা পার্শ্ববর্তী চরশানিরদিয়াড়, তিনগাছা বাগান, শ্রীকৃষ্ণপুরসহ আশপাশে ক্যাম্প স্থাপন করে। এ ক্যাম্প থেকে তারা দলবল নিয়ে ঘরে ঘরে অনুপ্রবেশ করে সন্দেহজনকভাবে তরুণ-যুবকদের ধরে নিয়ে যায়। তাদেরকে গলাকেটে হত্যা করা হয়। পাকিস্তানি হানাদাররা তাদের দোসরদের সহায়তায় হামলা চালায়। এ যুদ্ধে মাস্টার শাহেদ ও আফতাব নামের দুই মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। মুক্তিযোদ্ধারা ২৭ নভেম্বর কৃষ্ণপুর ও ১০ নভেম্বর তিনগাছা ক্যাম্পে গেরিলা হামলা চালিয়ে তাদের অবস্থান লন্ডভন্ড করে দেয়। হামলায় মহরম ও ছানা শহীদ হন। চরমপন্থিরা সবাই নিহত হন। এ দুটি হামলায় প্রতিশোধ নিতেই নাজিরপুরে গণহত্যা চালানো হয়। ৬২ জনকে ধরে নিয়ে গিয়ে দুটি খালে নৃশংসভাবে হত্যা করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। আগুনে জ্বালিয়ে দেওয়া হয় প্রায় দুই শতাধিক বাড়িঘর। সেদিনের কথা মনে করে আজও শিউরে ওঠেন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাসহ স্বজন হারানো মানুষগুলো। নাজিরগ্রামে যার নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল সেই নজরুল ইসলাম হাবুর স্মরণে নির্মিত হয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। \হজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুর রহমান হাবিব জানান, হামলাকারীরা তলস্নাশি চালিয়ে আটক করে শিশু, তরুণ, যুবক ও বৃদ্ধদের। মধ্য গ্রামে বাড়ি ঘিরে আহম্মদ, ছোরাব, হিরাই ও ছলিম এই চার ভাইকে বন্দি করে। তাদের একটি ঘরে আটকে রেখে আগুন দেয়। তারা অগ্নিদগ্ধ হয়ে শহীদ হন। ঘরবাড়িতে লুটতরাজ চালিয়ে অগ্নিসংযোগ করে। ধর্ষণকামীরা নেমে পড়ে পাশবিক নির্যাতনে। আটককৃতদের ভোরে পাবনা-পাকশী সড়কের উত্তর পাশে দুটি খালে জড়ো করে হাত ও চোখ বাধা অবস্থায় গুলিবিদ্ধ করে হত্যা করা হয়। বীর মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম, তোফাজ্জল হোসেন, তরিকুল ইসলাম নিলু জানান, পহেলা ডিসেম্বর ভোরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাদের এ দেশীয় দোসরদের নিয়ে চারদিক থেকে নাজিরপুর গ্রামটিকে ঘিরে ফেলে। এরপর নারী, পুরুষ, শিশু, বৃদ্ধসহ ৬২ জনকে গুলি করে হত্যা করে। রক্তের বন্যা বয়ে যায় এ গ্রামে। অথচ আজ সেই শহীদ পরিবারগুলোর খোঁজ নেয় না কেউ। ওই সময় পাকবাহিনীর হাতে নিহত শহীদ আলীর স্ত্রী হাজেরা বেগম বলেন, আমার স্বামীসহ আরও কয়েকজনকে পাকবাহিনী ধরে নিয়ে যায়। আমি তাদের হাতে পায়ে ধরেও ঠেকাতে পারিনি। তারা গুলি করে আমার স্বামীকে। জবাই করার সময় আমি তাদের হাতে পায়ে ধরলে তারা গলাকাটা থেকে বিরত থাকে। শেষবারের মতো ওইদিন আমার স্বামীর সঙ্গে কথা বলি। পাবনার অন্যতম যুদ্ধের মধ্যে এই নাজিরপুর গণহত্যার ইতিহাস আগামী প্রজন্মের জন্য সংরক্ষণের উদ্যোগ গ্রহণ করাসহ শহীদদের কবরস্থান সংরক্ষণের জোর দাবি জানান স্থানীয়রা।