শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১
বেসরকারি সিকিউরিটি কোম্পানির গার্ড

পুলিশ ভেরিফিকেশন ছাড়াই নিয়োগে হুমকির আশঙ্কা

অধিকাংশ সিকিউরিটি কোম্পানির গার্ডের পোশাক অনেকটাই বিভিন্ন সরকারি বাহিনীর মতো। যা সম্পূর্ণ বেআইনি। সরকারি বাহিনীর পোশাকের সঙ্গে মিল থাকায় বেসরকারি সিকিউরিটি কোম্পানির সদস্যদের দেখে মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হচ্ছে
গাফফার খান চৌধুরী
  ০৪ ডিসেম্বর ২০২১, ০০:০০

পুলিশ ভেরিফিকেশন ছাড়াই বেসরকারি সিকিউরিটি কোম্পানিতে জনবল নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। যা নিরাপত্তার জন্য বড় ধরনের হুমকি বলে মনে করছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা। এজন্য নিয়োগের আগে পুলিশ ভেরিফিকেশন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। যদিও তা শতভাগ মানছে না কোম্পানিগুলো। এদিকে সিকিউরিটি কোম্পানির গার্ডদের একই পোশাক পরিধান করা বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে। অধিকাংশ সিকিউরিটি কোম্পানির গার্ডদের পোশাক অনেকটাই বিভিন্ন সরকারি বাহিনীর মতো। যা সম্পূর্ণ বেআইনি। সরকারি বাহিনীর পোশাকের সঙ্গে মিল থাকায় বেসরকারি সিকিউরিটি কোম্পানির সদস্যদের দেখে মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হচ্ছে।

গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, সিকিউরিটি কোম্পানি খোলার ক্ষেত্রে বেসরকারি নিরাপত্তা বিধিমালা মানতে হবে। অথচ তা মানা হচ্ছে না। জেলাভিত্তিক সিকিউরিটি কোম্পানি গঠনের জন্য জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এবং মেট্রোপলিটন এলাকায় পুলিশ কমিশনার বেসরকারি সিকিউরিটি কোম্পানি খোলার জন্য লাইসেন্স ইসু্য করার ক্ষেত্রে ক্ষমতাপ্রাপ্ত।

সিকিউরিটি কোম্পানিতে লোক নিয়োগের ক্ষেত্রে পুলিশ ভেরিফিকেশন করানো বাধ্যতামূলক। নিরাপত্তা কোম্পানিগুলোর সদস্যদের পোশাক কোনো সরকারি বাহিনীর মতো বা সাদৃশ্যপূর্ণ হতে পারবে না। পোশাকে কোনোর্ যাংক ব্যাজ ব্যবহার করতে পারবে না। এমন সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। এমনকি দেশে কী পরিমাণ বেসরকারি সিকিউরিটি কোম্পানি রয়েছে, তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যানও নেই।

সূত্রটি বলছে, অনেক সময়ই সিকিউরিটি কোম্পানির সদস্যরা চুরি, ডাকাতি, চাঁদাবাজি বা অন্যান্য অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন। দেশের অনেক নামকরা বেসরকারি সিকিউরিটি কোম্পানির সদস্যদের ডাকাতি করে ধরা পড়ার রেকর্ডও আছে। আবার দাগি অপরাধীরা বড় ধরনের অপরাধ করার পর আত্মগোপন করতে বেসরকারি সিকিউরিটি কোম্পানিতে চাকরি নেয়।

গোয়েন্দা সূত্রটি বলছে, বিভিন্ন সরকারি বাহিনীর পোশাকের সঙ্গে অনেক বেসরকারি সিকিউরিটি কোম্পানির সদস্যদের পোশাকের মিল আছে। আচমকা দেখলে মনে হবে, কোনো সরকারি বাহিনীর সদস্য। ফলে অনেক সময়ই মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। আবার অনেক সময় বেসরকারি সিকিউরিটি কোম্পানির সদস্যরা অপরাধ করার পর, মানুষ মনে করছে কোনো সরকারি বাহিনী ওই অপরাধ করেছে। অনেকেই এসব নিয়ে ফেসবুকে নানা ধরনের পোস্টও দিয়ে থাকেন।

বিশিষ্ট নিরাপত্তা বিশ্লেষক অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল আব্দুর রশীদ যায়যায়দিনকে বলেন, বেসরকারি সিকিউরিটি কোম্পানির গার্ডদের অবশ্যই একটি নির্দিষ্ট পোশাক থাকতে হবে। এ সম্পর্কে জনগণকে

\হসচেতন করতে হবে। প্রয়োজনে বিজ্ঞাপন আকারে টেলিভিশনসহ অন্যান্য গণমাধ্যমে প্রকাশ করতে হবে। যাতে মানুষ দেখলেই বেসরকারি সিকিউরিটি কোম্পানি এবং সরকারি বাহিনীর সদস্যদের পার্থক্য বুঝতে পারেন।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক আরও বলেন, অনেক বেসরকারি বাহিনীর পোশাক সরকারি বাহিনীর পোশাকের মতো। যা রীতিমতো আতঙ্কের। এতে করে অনেক সময় মানুষের মধ্যে সরকারি বাহিনী সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণার সৃষ্টি হতে পারে। এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে হয়েও থাকে। বেসরকারি সিকিউরিটি কোম্পানিতে কাউকে নিয়োগ দেওয়ার আগে অবশ্যই ওই ব্যক্তির পুলিশ ভেরিফিকেশন করতে হবে। তা না করলে দাগি অপরাধীদের সিকিউরিটি কোম্পানিতে চাকরি নিয়ে আত্মগোপনে থাকার সম্ভাবনা থেকে যাবে।

তিনি বলেন, বিশেষ করে জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোর সদস্যদের মধ্যে এ ধরনের প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। তারা দেশের যেকোনো জায়গায় নাশকতামূলক কর্মকান্ড চালানোর পর শনাক্ত হলে আত্মগোপনে চলে যায়। আত্মগোপনে থেকে গার্মেন্টে চাকরি নেয়, রিকশা চালায়, সবজি বিক্রি করে। আবার বেসরকারি সিকিউরিটি কোম্পানিতেও চাকরি নিয়ে থাকে। তারা যদি পরিকল্পিতভাবে নাশকতার উদ্দেশ্যে কোনো বেসরকারি সিকিউরিটি কোম্পানিতে চাকরি নেয়, তাহলে সেই নাশকতা রোধ করা কঠিন হয়ে পড়বে। যা নিরাপত্তার জন্য বড় ধরনের হুমকি। এজন্য অবশ্যই কাউকে বেসরকারি সিকিউরিটি কোম্পানিতে চাকরি দেওয়ার আগে পুলিশ ভেরিফিকেশন করাতে হবে।

গোয়েন্দা সূত্রটি বলছে, সিকিউরিটি কোম্পানিতে কর্মরতরা যাতে নিয়মমাফিক সুবিধা পায় তা নিশ্চিত করতেও নির্দেশনা দিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। এমন নির্দেশের পর সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের রাজনৈতিক শাখা থেকে পুলিশ মহাপরিদর্শক, আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব, প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরের (ডিজিএফআই) মহাপরিচালক, জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা অধিদপ্তরের (এনএসআই) মহাপরিচালক, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) মহাপরিচালক,র্ যাব মহাপরিচালক, পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) প্রধান, আনসার ও ভিডিপির মহাপরিচালক, ঢাকার বিভাগীয় কমিশনার, ডিএমপি কমিশনার, কোস্টগার্ড, আমর্ড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন), ঢাকা জেলার প্রশাসক ও মেট্রোপলিটন সিকিউরিটি ম্যানেজমেন্ট সার্ভিস গ্রম্নপের চেয়ারম্যান বা মহাসচিব বরাবর নোটিশ পাঠানো হয়েছে।

পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, এমন নোটিশ জারির পর সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে দেশের অনেক বেসরকারি সিকিউরিটি কোম্পানির পোশাক,র্ যাংক ব্যাজ ও টুপি অনেক সরকারি বাহিনীর মতো এবং সাদৃশ্যপূর্ণ বলে জানানো হয়। এজন্য দেশের প্রতিটি বেসরকারি সিকিউরিটি কোম্পানিকে একই পোশাক ব্যবহারের প্রস্তাব দেওয়া হয়।

প্রস্তাবে বলা হয়, শুধু পোশাকে নির্দিষ্ট সিকিউরিটি কোম্পানির উজ্জ্বল মনোগ্রাম বা লোগো ব্যবহার করতে পারবে। পোশাকে ও বাহিনীর সদস্যের বুকে লাইসেন্সিং প্রতিষ্ঠানের নাম, মনোগ্রাম স্থায়ী কালি বা সুতো দ্বারা লিখতে হবে, যা সহজেই দেখা যায়। মাথার টুপিতে কোনো মনোগ্রাম থাকতে পারবে না। টুপির রং কোনো সরকারি বাহিনীর টুপির রঙের মতো বা সাদৃশ্যপূর্ণ হতে পারবে না। সারাদেশের সিকিউরিটি কোম্পানিগুলোকে একই ধরনের পোশাক ব্যবহার করতে হবে। সদস্য নিয়োগের ক্ষেত্রে পুলিশ ভেরিফিকেশন বাধ্যতামূলক করতে বলা হয়। সিকিউরিটি কোম্পানিগুলোকে নিয়মিত মনিটরিং করার কথাও আলোচিত হয়েছে।

সভায় আলোচিত বিষয় সম্পর্কিত একটি নির্দেশনা পুলিশ সদর দপ্তরের পুলিশ মহাপরিদর্শক, ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, সিলেট ও রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার, দেশের প্রতিটি জেলার ম্যাজিস্ট্রেট, সামরিক গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরের (ডিজিএফআই) মহাপরিচালক, প্রতিটি বিভাগের বিভাগীয় কমিশনার ওর্ যাব মহাপরিচালক বরাবর পাঠানো হয়।

নির্দেশনায় বেসরকারি সিকিউরিটি কোম্পানিগুলোর ওপর নজরদারি করতে সরকারের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থাকে যথাযথ দায়িত্ব পালনের কথা বলা হয়। যেসব সিকিউরিটি কোম্পানি নিয়ম বা বিধি মোতাবেক পরিচালিত হচ্ছে না সেসব কোম্পানির বিষয়ে তদন্তপূর্বক প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। প্রয়োজনে ওইসব কোম্পানিকে কালো তালিকাভুক্ত করে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। বিধিমালা অমান্যকারী কোম্পানির লাইসেন্স বাতিলের সুপারিশ করতে বলা হয়েছে। এসব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের আগে বেসরকারি সিকিউরিটি কোম্পানিগুলোকে আগাম নোটিশ দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে