সড়কে আতঙ্ক বেপরোয়া মোটর সাইকেল

নভেম্বরেই ১৫৮টি মোটর সাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে ১৮৪ জন বিএসটিআইর নজরদারি নেই হেলমেটের মান নির্ণয়ে হেলমেটের পরিবর্তে ব্যবহার হচ্ছে পস্নাস্টিক বাটি ভালো মানের একটি হেলমেটে মৃতু্যঝুঁকি কমে ৪০ শতাংশ

প্রকাশ | ০৫ ডিসেম্বর ২০২১, ০০:০০ | আপডেট: ০৫ ডিসেম্বর ২০২১, ০৯:২১

আব্দুলস্নাহ রায়হান

সারাদেশের সড়ক-মহাসড়কের আতঙ্কের নাম বেপরোয়া মোটর সাইকেল। মোটর সাইকেল চালকদের বেপরোয়া গতির কারণে উদ্বেগজনক হারে মোটর সাইকেল দুর্ঘটনা বাড়ছে। সড়কে ঝরছে কৌতূহলপ্রবণ তরুণ তাজা বহু প্রাণ। অ্যাপসভিত্তিক রাইড সার্ভিসে মোটর সাইকেল যুক্ত হওয়ার পর সড়কে নতুন নতুন মোটর সাইকেল নামছে পালস্না দিয়েই। সেই সঙ্গে দিনদিন বাড়ছে নতুন মোটর সাইকেল চালকও। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীতেই প্রতিদিন গড়ে ২৫০টিরও বেশি মোটর সাইকেল নামছে। শুধু রাজধানীতেই বর্তমানে চলছে ১২ লাখেরও বেশি মোটর সাইকেল। বিপণনকারী কোম্পানিগুলোর হিসাবে দেশে বছরে প্রায় ৫ লাখ নতুন মোটর সাইকেল বিক্রি করছেন তারা। সারাদেশে বর্তমানে প্রায় ৩৫ লাখ মোটর সাইকেল রাস্তায় চলছে। আর এসব মোটর সাইকেলের কারণে যেমন ঘটছে দুর্ঘটনা, তেমনি সড়ক ও ফুটপাতের যাত্রী ও পথচারীরা অধিকাংশ সময়ই বিরূপ পরিস্থিতিতে পড়ছেন। অন্যদিকে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, সড়কে দুর্ঘটনায় আহত হয়ে চিকিৎসা নিতে আসা ব্যক্তিদের বড় অংশই মোটর সাইকেল আরোহী। আবেগের বশবর্তী হয়ে তরুণরা নিজেদের বীরত্ব প্রদর্শন করতে গিয়ে অকালে মোটর সাইকেল দুর্ঘটনায় অকালে প্রাণ হারাচ্ছে। সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে কাজ করা গবেষকরা জানান, বেপরোয়া গতির কারণেই মোটর সাইকেল দুর্ঘটনা বেশি হচ্ছে। ওভারটেকিংয়ের চেষ্টা, বারবার লেন পরিবর্তন, ট্রাফিক আইন না মানা ও চলন্ত অবস্থায় মুঠোফোনে কথা বলার কারণে মোটর সাইকেল চালকরা দুর্ঘটনায় বেশি পড়েন। এ ছাড়া হেলমেট ব্যবহার না করা ও নিম্নমানের হেলমেটের কারণে দুর্ঘটনায় মৃতু্যর সংখ্যাও বাড়ছে উদ্বেগজনক হারে। এদিকে সামাজিক সংগঠন রোড সেফটি ফাউন্ডেশন জানিয়েছে, চলতি বছরের শুধু নভেম্বরেই ১৫৮টি মোটর সাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে ১৮৪ জন। তারা জানান, সারাদেশে নভেম্বরে ৩৭৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৪১৩ এবং আহত ৫৩২ জন। নিহতের মধ্যে নারী ৬৭ এবং শিশু ৫৮ জন। শনিবার ফাউন্ডেশনের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছেন। তিনি জানান, রোড সেফটি ফাউন্ডেশন ৭টি জাতীয় দৈনিক, ৫টি অনলাইন নিউজ পোর্টাল এবং ইলেক্ট্রনিক গণমাধ্যমের তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে। প্রতিবেদনে জানানো হয়, দুর্ঘটনাগুলোর মধ্যে ১৫৮টি মোটর সাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে ১৮৪ জন। দুর্ঘটনায় ৯৬ পথচারী এবং যানবাহনের চালক ও সহকারী নিহত হয়েছেন ৫৩ জন। রোড সেফটি ফাউন্ডেশন জানায়, অক্টোবরে ১৪৪ মোটর সাইকেল দুর্ঘটনায় ১৬৭ জন নিহত হয়েছিল। নভেম্বরে দুর্ঘটনায় নিহতদের তুলনা করলে মোটর সাইকেল দুর্ঘটনা বেড়েছে ৯.৭২ শতাংশ এবং প্রাণহানি বেড়েছে ১০.১৭ শতাংশ। দুর্ঘটনায় ১৮ থেকে ৬৫ বছর বয়সি কর্মক্ষম মানুষ নিহত হয়েছেন ৩৩৪ জন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডবিস্নউএইচও) এক গবেষণায় বলছে, ভালো মানের একটি হেলমেট পরলে মোটর সাইকেল দুর্ঘটনায় মারাত্মক আহত হওয়ার ঝুঁকি কমে ৭০ শতাংশ। আর মৃতু্যঝুঁঁকি কমে ৪০ শতাংশ। বড় শহরের বাইরে হেলমেট না পরার প্রবণতা বেশি চালকদের। এ ছাড়া নিম্নমানের হেলমেট ব্যবহারের কারণে দুর্ঘটনায় মৃতু্যর হারও বাড়ছে। বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) হেলমেটের মান পরীক্ষা করার সুবিধা বাংলাদেশে নেই বলে জানা গেছে। যদিও বাজারে বিক্রি হওয়া সব হেলমেট বিএসটিআইর নির্ধারিত মান অনুযায়ী উৎপাদন ও আমদানি হওয়ার কথা। বিএসটিআইর নজরদারি না থাকায় বাজারে হেলমেটের বদলে বিক্রি হওয়া একাংশ মূলত পস্নাস্টিকের বাটি। বিশেষজ্ঞরা জানান, রাইড শেয়ারিং অ্যাপে ভাড়ায় মোটর সাইকেলে যাত্রী পরিবহণের পর থেকে মোটর সাইকেলের বিক্রি বাড়ছে। ব্যক্তিগত বাহন হিসেবেও এর ব্যয়হার বাড়ছে। সড়কে দুর্ঘটনা কমাতে প্রয়োজন সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ। তারা আরও বলেন, দেশে মোটর সাইকেল চালকদের প্রশিক্ষণের তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই। বেসরকারি খাতকে সঙ্গে নিয়ে সচেতনতা ও প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নিতে হবে। নিরাপত্তা ব্যবস্থাযুক্ত উন্নত প্রযুক্তির মোটর সাইকেল কিনতে উৎসাহ দিতে হবে। চালক ও আরোহীর ভালো মানের হেলমেট ব্যবহার করাও জরুরি। মোটর সাইকেল বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান সূত্রে জানা গেছে, মোটর সাইকেল দুর্ঘটনার বড় কারণগুলোর একটি হলো ওভারটেকিং। এ ছাড়া ক্লান্তি নিয়ে চালানো এবং তাড়াহুড়া করাও অন্যতম কারণ। বাস, ট্রাক, লেগুনা ও প্রাইভেট কারের বেপরোয়া চালনা ও হঠাৎ লেন পরিবর্তন, অযান্ত্রিক যানবাহনের হুটহাট মোড় ঘোরানো ও লেন পরিবর্তন, রাস্তায় হঠাৎ গর্ত, ম্যানহোলের উঁচু অথবা নিচু ঢাকনা ও গতিরোধকে চিহ্ন না থাকা, পথচারীদের অসতর্কতা এবং হঠাৎ কুকুর, গরু-ছাগল রাস্তায় চলে আসাও দুর্ঘটনার বড় কারণ। যাত্রীকল্যাণ সমিতির এক তথ্যমতে জানা যায়, মোটর সাইকেল দুর্ঘটনায় নিহতদের মধ্যে প্রায় ৮০ শতাংশেরই বয়স ২১-এর নিচে; অর্থাৎ কিশোর-তরুণ। এ ছাড়া দুর্ঘটনায় শিকার ব্যক্তিদের মধ্যে ৮৮ শতাংশ হেলমেট না পরার কারণে এবং ১২ শতাংশ নিম্নমানের হেলমেট পরার কারণে মারা গেছেন। মোটর সাইকেল দুর্ঘটনা নিয়ে গত বছরের ফেব্রম্নয়ারিতে এআরআই 'আ রিভিউ অব মোটর সাইকেল সেফটি সিচুয়েশন ইন বাংলাদেশ' শীর্ষক গবেষণাপত্রে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডবিস্নউএইচও) বরাত দিয়ে জানায়, প্রতি ১০ হাজার মোটর সাইকেলের মধ্যে বাংলাদেশে দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে ২৮ দশমিক ৪টি। এর ধারে-কাছেও নেই এশিয়ার অন্য দেশগুলো। বাংলাদেশের পর কম্বোডিয়ায় ১১ দশমিক ৯, লাওসে ১১ দশমিক ৫, থাইল্যান্ডে ১১ দশমিক ২, ভারতে ৯, মিয়ানমারে ৮ দশমিক ৬, মালয়েশিয়ায় ৪ দশমিক ৪, ভিয়েতনামে ৪ দশমিক ১, ইন্দোনেশিয়ায় ২ দশমিক ৫ এবং ভুটানে ২ দশমিক ১টি মোটর সাইকেল দুর্ঘটনা ঘটেছে। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান বলেন, মোটর সাইকেল দুর্ঘটনা রোধে ব্যক্তি সচেতনতাই মুখ্য। মনে রাখতে হবে, মোটর সাইকেল বেপরোয়া গতিতে চালানোর কারণে শুধু চালক কেবল নিজেকেই ঝুঁকিতে ফেলছেন না; একই সঙ্গে পথযাত্রীদেরও ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। জীবনের নিরাপত্তা সবার আগে। জীবন থাকলে মোটর সাইকেল ছাড়াও অনেক জায়গায় নিজের বীরত্ব প্রদর্শনের সুযোগ রয়েছে। তাই মোটর সাইকেল চালানোর সময় সতর্ক থাকতে হবে। তিনি বলেন, দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির হার ঊর্ধ্বমুখী হলেও এটা নিয়ন্ত্রণে সরকারের তেমন কোনো উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়। 'সড়ক পরিবহণ আইন-২০১৮' বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মধ্যে কোনো আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে মূলত সড়ক পরিবহণ খাতের নৈরাজ্য ও অব্যবস্থাপনার কারণে। এ অবস্থার উন্নয়নে সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছার ঘাটতি রয়েছে। নিরাপদ সড়ক চাইয়ের (নিসচা) প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, মোটর সাইকেল দুর্ঘটনা এখন নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে। দুর্ঘটনা বাড়ার প্রধান কারণ হলো, সড়কে যথাযথ আইনের প্রয়োগ নেই। নগর-মহানগরে কিছু তদারকি হচ্ছে, কিন্তু মফস্বলে তেমন কড়াকড়ি নেই। ফলে এখনো মফস্বলেই সড়ক দুর্ঘটনা ও মৃতু্য বেশি হচ্ছে। তিনি বলেন, মোটর সাইকেলের সহজ লভ্যতার কারণেও দিনদিন অনেক সম্ভাবনাময় তরুণ প্রাণ হারাচ্ছে। চালক ও আরোহীর ভালো মানের হেলমেট পরা, রাইড শেয়ারিংয়ে চালকদের প্রতিযোগিতা কমানো, সচেতনতা বাড়ানো এবং ট্রাফিক আইন কঠোরভাবে প্রয়োগই সড়কে মোটর সাইকেল দুর্ঘটনা কমাতে পারে বলেও মনে করেন তিনি।