একাদশ জাতীয় সংসদ নিবার্চন

রাঙামাটিতে ত্রিমুখী লড়াইয়ের সম্ভাবনা

রাঙামাটি পাবর্ত্য জেলা (১০ উপজেলা, ৫০ ইউনিয়ন ও ২ পৌরসভা)

প্রকাশ | ১০ নভেম্বর ২০১৮, ০০:০০

ফজলুর রহমান রাজন, রাঙামাটি
দৃষ্টিনন্দন পাবর্ত্য জেলা রাঙামাটি। পাহাড়ের রাজধানী সেই রাঙামাটিতে বইছে একাদশ জাতীয় সংসদের নিবার্চনী হাওয়া। জেলার একটি মাত্র আসনে ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে সম্ভাব্য প্রাথীের্দর দৌড়ঝঁাপ। এ আসনে কে হবেন সংসদ সদস্য তা নিয়ে সবর্ত্র চলছে আলোচনা। অতীতে বিজয়ী হওয়া প্রাথীর্র তালিকায় আছে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জনসংহতি সমিতি (জেএসএস)র প্রাথীর্রা। রাঙামাটি পাবর্ত্য জেলা বলতে গেলে দেশের অন্য পঁাচটি নিবার্চনী এলাকার চাইতে বড়। এই জেলায় বসবাসকারী লোকের সংখ্যা ৭ লাখেরও বেশি। সবের্শষ ভোটার তালিকা অনুয়ায়ী জেলায় মোট ভোটারের সংখ্যা ৪ লাখ ১৭ হাজার ৩৫৯। যেখানে পুরুষ ভোটারের সংখ্যা দুই লাখ দুই হাজার ৯৯ ও মহিলা ভোটারের সংখ্যা এক লাখ ৯৭ হাজার ২৬০। নিবার্চনে এখানে ত্রিমুখী লড়াইয়ের সম্ভাবনা দেখছেন অভিজ্ঞ মহল। নিবার্চনী অভিজ্ঞতায় কেউ কোনো অংশে কম নয়। জয়ের ব্যাপারে তিন দলই আশাবাদী। তবে নিবার্চনে জয় পরাজয়ের মোড় ঘুরিয়ে দেয়ার ক্ষমতা রাখে অন্য আঞ্চলিক দল ইউপিডিএফ ও জেএসএস। তুরুপের তাস হিসেবে কাজ করতে পারে এ দল দুটি। বতর্মানে আঞ্চলিক দলগুলোর মধ্যে দ্ব›েদ্বর অবসানে সমঝোতার রাজনীতি বিদ্যমান থাকায় শক্তিশালী অবস্থানে থাকবে জেএসএস। এ অবস্থায় গতবারের মত আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রাথীর্র বিজয় কঠিন হয়ে দঁাড়াবে। অন্যদিকে পাবর্ত্য বাঙালি সংগঠন সমঅধিকার আন্দোলন, জাতীয় পাটির্, এলডিপি প্রাথীর্ দেয়ার কথা ভাবলেও ভোটের সমীকরণ বলে এসব প্রাথীর্রা জয়ের ধারে কাছেও যেতে পারবে না। তবে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের কিছু ভোট যে মাইনাস করবে তা জোর দিয়েই বলা যায়। তবে সাধারণ মানুষ বলছে পাহাড়ের বতর্মান সমাজ ব্যবস্থার প্রেক্ষাপটে সামাজিকভাবে জনপ্রিয় নয় এমন ব্যক্তিকে প্রাথীর্ দিলে যেকোনো দলকে ভুলের মাশুল গুণতে হবে নিবার্চনে। ফলে প্রাথীর্র জনপ্রিয়তার উপরও নিভর্র করবে নিবার্চনে প্রাথীর্র জয়-পরাজয়। বিএনপির মধ্যে শহর কেন্দ্রিক কোন্দল থাকলেও সেটি নেই আওয়ামী লীগে। জেএসএসে কোন্দল তো নেইই, আছে ব্যাপক সাংগঠনিক শক্তি। উল্লেখ্য, ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নিবার্চনে এই আসনে এক লাখ ১৫ হাজার ১২ ভোট পেয়ে বিজয়ী হন আওয়ামী লীগের দীপংকর তালুকদার। জনসংহতি সমিতির উষাতন তালুকদার পেয়েছিলেন ৫১ হাজার ৮৩৩ ভোট। সেই নিবার্চনে ৫৬ হাজার ২৪৯ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় হন বিএনপির ‘বিপদ পার হওয়া’র প্রাথীর্ মৈত্রী চাকমা। আর নিবার্চনে ‘না’ প্রতীকে ৩২ হাজার ৬৮ ভোট পড়ে, যা আরেক আঞ্চলিক দল ইউপিডিএফের শক্ত অবস্থানের বিষয়টি সেসময় জানান দিয়েছিল। পঁাচ বছর পরই ২০১৪ সালের দশম সংসদ নিবার্চনে উল্টে যায় ভোটের পুরনো হিসাব-নিকাশ। হেরে যান নিবার্চনকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী দীপংকর তালুকদার। আগের নিবার্চনে যার চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছিলেন, সেই উষাতনের কাছেই ১৮ হাজার ৮৫২ ভোটে হেরে যান তিনি। উষাতন তালুকদার পান ৯৬ হাজার ২৩৭ ভোট। দীপংকর তালুকদার পান ৭৭ হাজার ৩৮৫ ভোট। অথচ ওই নিবার্চনে বিএনপির অংশগ্রহণই ছিল না, ছিল না ইউপিডিএফ। তবে আরেক আঞ্চলিক দল জনসংহতি সমিতির (এমএন লারমা) সভাপতি সুধাসিন্ধু খীসা নিবার্চনে অংশ নিয়ে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ভোট পান। এবার নিবার্চন সামনে রেখে একক প্রাথীর্ চ‚ড়ান্ত করেছে আওয়ামী লীগ। তাদের একক প্রাথীর্ সাবেক পাবর্ত্য প্রতিমন্ত্রী ও বতর্মান জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি দীপংকর তালুকদার। জেলা আওয়ামী লীগ থেকে তার একক প্রাথির্তার কথা জানিয়ে কেন্দ্রে সুপারিশ পাঠানো হয়েছে। অন্যদিকে বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশীর তালিকায় জেলা সভাপতি মো. শাহ আলম, অবসরপ্রাপ্ত সেনা কমর্কতার্ লেফটেন্যান্ট কনের্ল (অব.) মণীষ দেওয়ান, অ্যাডভোকটে মামুনুর রশীদ মামুনের নাম উঠে আসলেও কেন্দ্রীয় জাতীয় নিবার্হী কমিটির সহ-ধমির্বষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট দীপেন দেওয়ানের মনোনয়ন অনেকটা চূড়ান্ত বলে জানান, দলটির স্থানীয় শীষর্ নেতারা। আসনটিতে স্বতন্ত্র হিসেবে এবারও নিবার্চন করবে আঞ্চলিক দল জনসংহতি সমিতি (জেএসএস)। ছাড়াও গৌতম কুমার চাকমা, গৌতম দেওয়ান ও গুণেন্দু বিকাশ চাকমার নাম শোনা যাচ্ছে। তবে জেএসএস প্রাথীর্ উষাতন তালুকদার এমপি নিবাির্চত হওয়ার পর গত ৫ বছরে দল এবং জনগণের জন্য কিছু করতে পারেননি। কিছু লোক এমপির বরাদ্দের কাবিখা, টিআর, কাবিটাসহ উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতে ভাগ বসায়। সাংসদের অনেকটা আথির্ক দৈন্যতার সুযোগ নিয়ে বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে ভুয়া প্রকল্প দেখিয়ে কিছু লোক নিজের আখের গুছিয়েছে। দলের নেতা কমীর্রাও এমপির কাযর্ক্রমে সšুÍষ্ট নয়। গত নিবার্চনে এ আসনে জাতীয় পাটির্র মনোনয়নে ডা. রূপম দেওয়ান প্রতিদ্ব›িদ্বতা করলেও একাদশ জাতীয় সংসদ নিবার্চনে দলের সিনিয়র নেতা আরফান আলী ও জেলা জাপার সাধারণ সম্পাদক প্রজেশ চাকমা মনোনয়নের জন্য লবিং করছেন। জয়ের ব্যাপারে ঊনিশ-বিশ অবস্থানে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জেএসএস। জয় নিয়ে আশাবাদী তিন দলই। তবে আসনটিতে পাহাড়িদের অন্য দুই আঞ্চলিক দল ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) ও জেএসএস (এমএন লারমা) গ্রæপের ভূমিকা একাদশ জাতীয় সংসদ নিবার্চনের ফল মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে বলেও ধারণা করা হচ্ছে। গত নিবার্চনে এ আসনে স্বতন্ত্র হিসেবে প্রতিদ্ব›িদ্বতা করেছিলেন জেএসএস (এমএন লারমা) গ্রæপের সুধাসিন্ধু খীসা। যিনি বই প্রতীকে পেয়েছিলেন ২৪ হাজার ৩৫১। নিজেদের প্রাথীর্ হিসেবে সচিব চাকমাকে দঁাড় করানো হলেও ভেতরে ভেতরে সুধাসিন্ধু খীসাকে সমথর্ন দেয় ইউপিডিএফ। এক সময় আসনটি পরিচিত ছিল আওয়ামী লীগের ঘঁাটি হিসেবে। ১৯৯১ এবং ’৯৬ সালে পরপর নিবাির্চত হয়েছিলেন দীপংকর তালুকদার। ২০০১ সালের নিবার্চনে আসনটি ছিনিয়ে নেন বিএনপির মণিস্বপন দেওয়ান। ২০০৮ সালে দীপংকর তালুকদার আবার পুনরুদ্ধার করলেও গত নিবার্চনে জেএসএস প্রাথীর্ ঊষাতন তালুকদারের কাছে হেরে যান তিনি। তবে দীপংকর তালুকদারের দাবি জেএসএস অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে জয় ছিনিয়ে নিয়েছে। একই আতঙ্কে একাদশ নিবার্চনের আগে পাহাড় থেকে সব অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের দাবি জানান তিনি। একাদশ নিবার্চনে আসনটি পুনরুদ্ধারে মরিয়া আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। ধরে রাখতে তৎপর জেএসএস। এরই মধ্যে প্রতিটি উপজেলায় সদস্য সংগ্রহ অভিযান নিয়ে মাঠে যাচ্ছেন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সম্ভাব্য প্রাথীর্সহ নেতাকমীর্রা। বিভিন্নভাবে জনমত গঠন ও গণসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছে জেএসএস। নিবার্চনের ব্যাপারে জেলা বিএনপির সভাপতি হাজী শাহ আলম বলেন, তিনি দলের মনোনয়ন প্রত্যাশী দল তাকে মনোনয়ন দিলে তিনি নিবার্চন করবেন। আর না দিলে, দল যাকে মনোনয়ন দেয় তার পক্ষে কাজ করবেন কিনাÑ এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রাথীর্র আচরণের উপর অনেক কিছু নিভর্র করে। সাবেক প্রতিমন্ত্রী ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি দীপংকর তালুকদার জানান, নিবার্চনে তিনি আওয়ামী লীগের একক প্রাথীর্, মানুষ নিবার্চনে নিবিের্ঘœ ভোট দিতে পারে তাহলে তিনি-ই বিজয়ী হবেন। তিনি আরও বলেন, গত ৯ বছরে পাহাড়ে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। পক্ষান্তরে বতর্মান এমপি একটি ইটও ফেলতে পারেননি। জেএসএস নেতা ও সংসদ সদস্য উষাতন তালুকদার এমপি বলেন, দল থেকে এখনো মনোনয়ন চ‚ড়ান্ত হয়নি। তিনি দাবি করেন গত বছরে তিনি ব্যাপক উন্নয়ন করেছেন। বিশেষ করে বিদ্যুৎ, স্বাস্থ্য এবং অবকাঠামো সব উন্নয়ন তার আমলে হয়েছে। তিনি কণর্ফুলী পেপার মিলকে আবার সচল করার চেষ্টা করেছেন। রাঙামাটি আসনে লড়াই হবে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও স্বতন্ত্র হিসেবে জনসংহতি সমিতির প্রাথীর্র সাথে, সেক্ষেত্রে জাতীয় পাটির্ বা অন্য দলের প্রাথীর্ নিবার্চনে অংশ নিলে জামানত ফিরে পাবে কিনা সন্দেহ আছে। রাঙামাটি জেলা ১০ উপজেলা, ৫০ ইউনিয়ন, ২ পৌরসভা নিয়ে গঠিত। এর আয়তন ৬১১৬.১৩ বগির্কলোমিটার। গত নিবার্চনে ভোটার ছিল ৩ লাখ ৭১ হাজার ৩৪৮ জন। এবার ভোটার বেড়েছে ৪৬,০১১ জন।