শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১
ঘূর্ণিঝড় জাওয়াদের প্রভাব

তলিয়ে গেছে লাখো কৃষকের স্বপ্ন

ম যাযাদি ডেস্ক
  ০৮ ডিসেম্বর ২০২১, ০০:০০
ঝালকাঠির রাজাপুরে ঘূর্ণিঝড়ে বয়ে যাওয়া দমকা হাওয়ায় নুয়ে পড়েছে পাকা আমন ধান -যাযাদি

একবুক স্বপ্ন নিয়ে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কেউ ফলিয়েছেন আমন, কেউ বোরোর বীজতলায় বুনেছিলেন আগামীর সম্ভাবনা, কারও মুখে হাসি ফুটিয়েছিল রবিশস্য, কারও বা শীতের সবজি। কিন্তু সেসব স্বপ্ন-সম্ভাবনা তলিয়ে গেছে ঘূর্ণিঝড় জাওয়াদের প্রভাবে টানা বর্ষণে। অসময়ের এমন বৃষ্টিতে মাথায় হাত পড়েছে লাখ লাখ কৃষকের। দেশের বিভিন্ন জেলায় চাষিদের এমন ক্ষয়ক্ষতির চিত্র ফুটে উঠেছে আমাদের স্টাফ রিপোর্টার, প্রতিনিধিদের পাঠানো খবরে।

মুন্সীগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, দেশের অন্যতম বৃহত্তম আলু উৎপাদনকারী অঞ্চল মুন্সীগঞ্জ। ঘূর্ণিঝড় জাওয়াদের কারণে টানা ৩ দিনের বৃষ্টিতে ৬টি উপজেলায় ১৭ হাজার হেক্টর আলুর বীজ পচে ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কায় রয়েছেন কৃষকরা।

জানা যায়, এ বছর জেলায় আলু রোপণের লক্ষ্যমাত্রা নিধারণ হয় ৩৭ হাজার ৯০০ হেক্টর জমিতে। শনিবার দুপুর পর্যন্ত জেলায় ১৭ হাজারের বেশি জমিতে আলু বীজ রোপণ করা হয়। যেসব ক্ষেতে আলুর চারা গজিয়েছে সেটির খুব ক্ষতি হবে না বলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অভিমত। অর্থাৎ ১০ থেকে ১৫ দিন আগে লাগানো আলু পচবে না। কিন্তু ৫ থেকে ৮ দিন আগে যেসব ক্ষেতে আলু লাগানো বা রোপিত হয়েছে, সেগুলোর পচে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. খোরশেদ আলম বলেন, বৃষ্টির আগ পর্যন্ত জেলায় ১৭ হাজার হেক্টর জমিতে আলু রোপণ সম্পন্ন হয়েছে। এর মধ্যে বৃষ্টির জন্য ৫ হাজার হেক্টর আলু একেবারেই পচে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বৃষ্টি থামলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ সঠিকভাবে নিরূপণ করা যাবে।

শ্রীনগর (মুন্সীগঞ্জ) প্রতিনিধি জানান, ঘূর্ণিঝড় জাওয়াদের প্রভাবে ফলে টানা বর্ষণে শ্রীনগরে প্রায় এক হাজার হেক্টর আলু ও সরিষা জমি পানির নিচে তলিয়ে গেছে। সদ্য রোপণ করা এসব জমির আলুবীজ ও সরিষা পুরোটাই নষ্ট হয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে বোরো ধানের বীজতলা নষ্ট হওয়ার শঙ্কা।

মঙ্গলবার দুপুরে সরজমিনে উপজেলার বীরতারা ইউনিয়নের সালেপুর, বীরতারা, মাশাখোলা, আটপাড়া ইউনিয়নের পূর্ব দেউলভোগসহ বেশ কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা গেছে আলুর জমির উপরে বৃষ্টি পানি জমে নৌকা চলার উপক্রম হয়েছে। বৃষ্টি মাথায় নিয়ে অনেককে দেখা গেছে সেচ দিয়ে জমির পানি সরানোর চেষ্টা করছে।

কামাল শেখ নামের এক আলু চাষি জানান, জানি পানি সেচে কোনো লাভ হবে না, তারপরও মনকে মানাতে পারছি না। গত বছর লোকসান হয়েছে। এ বছর ধার-দেনা করে চাষে নেমেছিলাম। ভেবেছিলাম এ বছর দাম ভালো পেলে লোকসান পুষিয়ে নিতে পারব। কিন্তু শুরুতেই এমন হয়ে গেল।

এদিকে বোরো ধানের আগে শ্রীনগরে অনেক জমিতেই সরিষার আবাদ হয়। এজন্য পানি নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অনেকেই সরিষা চাষ করেছেন। বেশির ভাগ সরিষা গাছেই এখন ফুল। এমন অবস্থায় সরিষার জমি পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় তা পুরোটাই নষ্ট হয়ে গেছে।

শ্রীনগর উপজেলা কৃষি অফিসার শান্তনা রাণী জানান, এ বছর উপজেলায় আলু চাষের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে ২ হাজার ২০০ হেক্টর। এর মধ্যে প্রায় ৬২০ হেক্টর জমিতে আলু বপন করা হয়েছে। পুরোটাই এখন পানির নিচে। সরিষা আবাদ করা হয়েছে ৪৬৫ হেক্টর জমিতে। এর পুরোটাই নষ্ট হয়ে যাবে। সঙ্গে বোরো ধানের বীজ তলাও নষ্ট হচ্ছে। পানি না সরে যাওয়া পর্যন্ত ক্ষতির মাত্রা নির্ধারণ করা যাচ্ছে না।

সিরাজদিখান (মুন্সীগঞ্জ) প্রতিনিধি জানান, মুন্সীগঞ্জের ৬টি উপজেলার মধ্যে সিরাজদিখান উপজেলায় সবচেয়ে বেশি আলু উৎপাদন হয়ে থাকে। গত কয়েকদিনের টানা বৃষ্টিতে এ উপজেলায় প্রায় ১০ হাজারের মতো কৃষকের চোখের পানি ও বৃষ্টির পানি যেন একাকার হয়ে গেছে।

৩ দিনের বৃষ্টিতে আলু চাষিদের রোপণকৃত জমির সঙ্গে তলিয়ে গেছে তাদের স্বপ্ন। লগ্নি এবং সুদে টাকা এনে অনেকে আলু রোপণ করেছেন। তাদের এ ক্ষতি পোষাতে সরকারের প্রতি সহযোগিতা কামনা করেছেন ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা।

এ বছর এ উপজেলায় আলু চাষে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৯ হাজার ৩৫০ হেক্টর জমি। এর মধ্যে ৭ হাজার ৭০০ হেক্টর জমিতে বীজআলু রোপণ করা হয়েছিল। সেখানে বৃষ্টির পানি জমে ৪ হাজার ৮০০ হেক্টর জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

কেয়াইন ইউনিয়নের আলুচাষি জাকির হোসেন বাবু, মালখানগর ইউনিয়নের আওলাদ হোসেন, কোলা ইউনিয়নের রাশেদ, মধ্যপাড়া ইউনিয়নের আলী আকবর জানান, নতুন করে জমি আবাদ করা এখন সময়ের ব্যাপার। বৃষ্টি না থাকলেও জমি উপযুক্ত করতে কমপক্ষে ২ সপ্তাহ সময় লাগবে। এখন বীজ সংকট দেখা দিচ্ছে এবং বীজ বিক্রেতারা বীজের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন, এমন অভিযোগও রয়েছে অনেকের।

উপজেলা সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. মোশারফ হোসেন জানান, এ মুহূর্তে ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করা সম্ভব না। দু-একদিনের মধ্যে পানি সরে গেলে তা বলা যাবে। আমরা একটা তালিকা তৈরিতে কাজ করছি।

হাটহাজারী (চট্টগ্রাম) প্রতিনিধি জানান, ঘূর্ণিঝড় জাওয়াদের প্রভাবে অসময়ে বৃষ্টির কারণে হাটহাজারীতে রোপা আমন ও শাকসবজির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। একই সঙ্গে ক্ষতি হয়েছে ডাল ও তেল জাতীয় ফসলের।

উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, ১৪টি ইউনিয়ন, একটি পৌরসভা ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন দক্ষিণ পাহাড়তলী ১নং ওয়ার্ডে উৎপাদিত ৬০ হেক্টর রোপা আমন, রবি শাকসবজি ৪৫ হেক্টর, ডাল জাতীয় ফসল ৫ হেক্টর ও তেল জাতীয় ফসল ৪ হেক্টর ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে। তবে ক্ষতির পরিমাণ বেশি হয়নি জানিয়ে কৃষি কর্মকর্তা মো. আল মামুন শিকদার যায়যায়দিনকে জানান, উপজেলার রোপা আমন ইতোমধ্যে ৯৫ ভাগ কাটা হয়ে গেছে। বাকি কিছু ধান কাটাবস্থায় বিছানো আরও কিছু খাড়া অবস্থায় আছে। তাই ক্ষতির পরিমাণ মাত্র ১.৫ ভাগ। ক্ষয়-ক্ষতির শিকার কৃষকরা সাহায্য কিংবা প্রণোদনার জন্য আবেদন করলে আমরা ঊর্ধ্বতনদের জানিয়ে দেব।

জানা গেছে উপজেলায় প্রায় ৩৫ হাজার কৃষক ৯ হাজার ৩৫০ হেক্টর জমিতে আমন ধান চাষাবাদ করেন। যার উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ৪৬ হাজার ৭৫০ মে. টন ধান। রবি শাকসবজির লক্ষ্যমাত্রা ১ হাজার হেক্টর হলেও আবাদ হয়েছে ২০০ হেক্টর। ডাল ও তেল জাতীয় ফসল লক্ষ্যমাত্রা যথাক্রমে ৬০০ হেক্টর হলেও আবাদ হয়েছে যথাক্রমে ১২ ও ৮ হেক্টর। রবি শাকসবজি, ডাল ও তেল জাতীয় ফসল ফলান যথাক্রমে ১২ হাজার, ২ হাজার ৫০০ ও ১ হাজার ৫০০ কৃষক।

চৌদ্দগ্রাম (কুমিলস্না) প্রতিনিধি জানান, কুমিলস্নার চৌদ্দগ্রামে ঘূর্ণিঝড় জাওয়াদের প্রভাবে সৃষ্ট বৃষ্টিপাতে আমন, বোরো, আবাদি শাকসবজির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।

রোববার সকাল থেকে টানা বৃষ্টির কারণে উপজেলার নিম্নাঞ্চলে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। এতে করে শত শত হেক্টর পাকা আমন ধানের ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। অনেক স্থানে কাটা ধান গাছসহ পানিতে হেলে পড়েছে। কোথাও কোথাও ধানসহ গাছ পানির নিচে তলিয়ে গেছে। এছাড়াও ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছে বোরোর চাষাবাদ ও ক্ষেতে থাকা শাকসবজি। উপজেলার কয়েকশ' হেক্টর জমিতে চাষাবাদ হওয়া বরবটি, লাউ, বেগুন, ধনিয়া, লালশাক, মরিচের চারারও ব্যাপক ক্ষতিসাধন করেছে টানা বৃষ্টি।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. নাছির উদ্দিন জানান, এ বছর আমন মৌসুমে ধানের ভালো ফলন হয়েছে। বৃষ্টিপাতে উপজেলায় অন্তত ১০০ হেক্টর জমিনে পানি উঠেছে। ফলে আমন চাষ করা কৃষকরা ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছে।

তিনি আরও জানান, উপজেলায় চলমান মৌসুমে ৩৫০ হেক্টর জমিতে সরিষার চাষাবাদ হয়েছে। এর মধ্যে অন্তত ৯৪ হেক্টর সরিষার ক্ষেত ক্ষতির মুখে পড়েছে। আমনের সামান্য ক্ষতি হলেও রবিশস্যের লক্ষ্যমাত্রা ব্যাহত হবে বলেও তিনি জানান।

মতলব (চাঁদপুর) প্রতিনিধি জানান, টানা বৃষ্টিতে চাঁদপুরে মতলবের কৃষকদের মাথায় হাত। অনেক আশা নিয়ে এবার যারা শীতকালীন শবজি চাষ করেছেন তারাও পড়েছেন দারুণ বিপাকে।

বিশেষ করে আলু চাষিদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। জেলার মতলব উত্তর ও দক্ষিণ, হাজীগঞ্জ, কচুয়া এবং চাঁদপুর সদরের বিস্তীর্ণ জমিতে আলুর চাষ হয়ে থাকে। তিন দিনের বৃষ্টিতে আলুর ফসলি মাঠে পানি জমে গেছে। যেসব জমিতে পানি জমেছে ওই সব জমির আলু হবে না। আলুর উৎপাদন কিছুটা হলেও দ্রম্নত পচন ধরবে বলে মনে করছেন চাষিরা।

অপর দিকে আলুর উৎপাদন ব্যাহত হলে আলুর দাম কোথায় গিয়ে ঠেকে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। কৃষকরা মনে করেন এমনিতেই সার ও বীজের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে লাভের পরিমাণ আগের মতো নেই। তারপরও কৃষি বিভাগ কিছু অনুদান দিয়ে সার ও বিজ দিয়ে এবছর সহযোগিতা করেছে। এতে কৃষকদের উপকার হয়েছে। কিন্তু যে আশা নিয়ে বীজ বপন করেছে তা যেন জলেই ভেসে যাচ্ছে।

এদিকে অসময়ের এই বৃষ্টিতে শীতকালীন সব ধরনের সবজিরই ক্ষতি হবে বলে মনে করছেন কৃষকরা। চাঁদপুর সদরের মহামায়া এলাকার আবু ইউসুফ এই মৌসুমে সবজির ভালোই ফলন হয়েছিল। কিন্তু কয়েক দিনের বৃষ্টিতে আমাদের মনে হয় সব শেষ হয়ে যাবে।

রূপসা (খুলনা) প্রতিনিধি জানান, ঘূর্ণিঝড় জাওয়াদের প্রভাবে চার দিন ধরে মাঝারি বৃষ্টি ও দমকা বাতাস যেন পাকা ধানে মই দিয়ে গেছে আমনের মাঠে। হাজার হাজার বিঘা কাঁচা-পাকা আমন ধান শুয়ে পড়েছে। কাটা ধানও মাঠে রয়েছে কৃষকের। আবহাওয়ার এমন বৈরিতায় মাঠের ফসল নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন ১৪ হাজার চাষি।

সোমবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত উপজেলার বিভিন্ন এলাকার আমনের মাঠ ঘুরে চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বৃষ্টি ও বাতাসে উপজেলার ৫টি ইউনিয়নে প্রায় ৪০ হাজার বিঘা জমির ধানের গাছ পড়ে গেছে। পানিতে ডুবে থাকা কিছু কিছু ধানে এরই মধ্যে পচন ধরেছে।

তবে, কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, উন্নত ফলনশীল ও স্থানীয় জাত মিলিয়ে উপজেলার ৫টি ইউনিয়নে এ বছর ৩৮৯০ হেক্টর জমিতে আমনের চাষ করা হয়েছে। এর মধ্যে স্থানীয় জাতের ও উফশী জাতের ধান স্বাভাবিক অবস্থায় আছে। শুধুমাত্র স্থানীয় জাতের মরিচ চাল ও ব্রী ধান-২৩ পাকা আমন বাতাসে নুয়ে পড়েছে। এর পরিমাণ ২০ ভাগ হতে পারে। এছাড়া, মুসুরি ডাল ০.৫ হেক্টর ক্ষতি হবে সম্ভাবনা রয়েছে।

ডুমুরিয়া (খুলনা) প্রতিনিধি জানান, ঘূর্ণিঝড় জাওয়াদের প্রভাবে খুলনার ডুমুরিয়া অঞ্চলে গত দুই দিন থেমে থেমে বৃষ্টিপাত হয়েছে। অসময়ের এই নিম্নচাপে বোরোর বীজতলাসহ সবজির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। মঙ্গলবার বৃষ্টিপাত না হলেও সূর্যের দেখা মেলেনি।

জানা যায়, শনিবার থেকে ঘূর্ণিঝড় জাওয়াদের প্রভাবে বৃষ্টিপাতে তলিয়ে গেছে কৃষকের ফলানো ধান, বোরো বীজতলা ও সবজির ক্ষেত। অনেক ক্ষেতে পাকা ধান কেটে রাখা ছিল মাঠে। যা এখন পানি নিচে। অন্যদিকে বোরো ধানের বীজতলা থেকে শুরু করে অধিকাংশ সবজি ক্ষেতেরও ক্ষতির আশঙ্কা করছেন কৃষকরা। তবে আগামীতে কৃষি প্রণোদনা বা পুনর্বাসনের মাধ্যমে কৃষকদের এ ক্ষতি পুষিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবে কৃষি বিভাগ।

কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, চলতি মৌসুমে উপজেলায় ১৫ হাজার ৬২৫ হেক্টর জমিতে আমনের আবাদ হয়েছে। ইতোমধ্যে কর্তন করা হয়েছে ১০ হাজার ১২৫ হেক্টর। যার উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৭৮ হাজার ১২৫ মেট্রিক টন। অতি বৃষ্টিতে আমনের তেমন ক্ষতি না হলেও ১৩০ হেক্টর বোরো বীজতলার মধ্যে ৫ হেক্টর এবং ১৩০ হেক্টর সরিষার মধ্যে ৫ হেক্টর এবং ২ হাজার ৫০০ হেক্টর বিভিন্ন সবজির মধ্যে ১০ হেক্টর ফসল আক্রান্ত হয়েছে। তবে দ্রম্নত পানি নিষ্কাশন হলে ক্ষতি অনেকটা কম হবে।

বোয়ালমারী (ফরিদপুর) প্রতিনিধি জানান, ঘূর্ণিঝড় জাওয়াদের প্রভাবে রোববার ও সোমবারের তীব্র বৃষ্টির ফলে ফরিদপুরের বোয়ালমারীতে মসুরি, সরিষা, গম ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এছাড়া পেঁয়াজের বীজতলাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, টানা বৃষ্টিতে কৃষি ক্ষেতে সৃষ্টি হয়েছে জলাবদ্ধতা। ফলে গম, মসুরি, সরিষা, খেসারি, শাকসবজি, আলু ও পেঁয়াজ বীজতলার জমি প্রায় ডুবু ডুবু অবস্থা। ক্ষেতের জলাবদ্ধতা এভাবে কয়েকদিন থাকলে মাঠের ফসল পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যাওয়ার শঙ্কা কৃষকদের।

বৃষ্টিতে উপজেলার বিভিন্ন স্থানের মোট ১ হাজার ৪১৮ হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে ১৬২ হেক্টর জমির গম, ৬০০ হেক্টর জমির মসুরি, ২৫০ হেক্টর জমির সরিষা, ৯০ হেক্টর জমির খেসারি, ৬ হেক্টর জমির আলু, ১২০ হেক্টর জমির শাকসবজি এবং ১৯০ হেক্টর জমির পেঁয়াজ বীজতলা রয়েছে।

এ ব্যাপারে বোয়ালমারী কৃষি কর্মকর্তা প্রীতম কুমার হোড় বলেন, উপজেলার ১ হাজার ৪১৮ হেক্টর জমির ফসল গত দুই দিনের বৃষ্টিতে নিমজ্জিত হয়েছে। পানি নেমে গেলে ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করা সহজ হবে।

মণিরামপুর (যশোর) প্রতিনিধি জানান, ঘূর্ণিঝড় জাওয়াদের প্রভাবে টানা বর্ষণে যশোরের মণিরামপুরে চাষকৃত প্রায় অর্ধেক সবজি ক্ষেত পানিতে তলিয়ে গেছে। সিংহভাগ বোরো বীজতলা এখন পানির নিচে রয়েছে। একই সাথে ক্ষেতে কেটে রাখা রোপা আমন পানিতে ভাসছে। পানিতে তলিয়ে গেছে প্রায় সাড়ে ৭০০ রবি শস্য। তবে, টাকায় ক্ষতির পরিমাণ এখনো নিরূপণ করা হয়নি বলে জানিয়েছেন উপজেলা কৃষি অফিস।

সংশ্লিষ্ট কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, চলতি আমন মৌসুমে অধিকাংশ ধান কাটা হলেও এখনো কাটা ধান থেকে গেছে। যা আকস্মিক বর্ষায় ঘরে তুলতে পারেনি কৃষক। চলতি আমন মৌসুমে উপজেলার ২২ হাজার ৬৫০ হেক্টর জমিতে এবার রোপা আমিনের আবাদ হয়। এরমধ্যে উপজেলা কৃষি অফিসের হিসেবে মতে উপজেলার বিভিন্ন মাঠে ২২৭ হেক্টর জমিতে রোপা আমন থেকে গেছে। যা টানা বর্ষণে ক্ষেত তলিয়ে গিয়ে কাটা ধান পানিতে ভাসছে।

সূত্র জানায়, উপজেলায় চলতি শীত মৌসুমে এবার ১৫৭৫ হেক্টর জমিতে ফুল কপি, বাঁধাকপি, মুলা, গাজর, পালংশাক, লাল শাকসহ বিভন্ন ধরনের সবজি চাষ হয়। এরমধ্যে ৮০০ হেক্টর জমির সবজি এখন পানিতে তলিয়ে গেছে।

৩৫ হেক্টর বোরো বীজতলার ২৫ হেক্টর, এখন পানির নিচে। উপজেলায় ৮০ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ চাষ হলেও ৩০ হেক্টর এখন পানির নিচে। তলিয়ে গেছে ৮২০ হেক্টর জমিতে রোপিত আলুর ২০৩ হেক্টর। ১৪০১ হেক্টর জমিতে সরিষা চাষ হলেও ৫০০ হেক্টর এখন পানির নিচে। ৯৯ হেক্টর জমিতে গম চাষ হলেও ২০ হেক্টর পানিতে তলিয়ে গেছে।

চিতলমারী (বাগেরহাট) প্রতিনিধি জানান, বাগেরহাটের চিতলমারীতে ঘূর্ণিঝড় জোয়াদের প্রভাবে রবি ফসলের ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। গত দু'দিনের বর্ষণে এলাকার বীজতলা ও অন্যান্য জমির ফসল তলিয়ে যাওয়ায় চাষিদের মধ্যে হতাশা বিরাজ করছে। এ বিষয়ে স্থানীয় কৃষি অফিস ক্ষয়-ক্ষতি নিরূপণের জন্য তালিকা তৈরির কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।

উপজেলা কৃষি অফিস ও এলাকার চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বোরো ধানের বীজ তলা ও আমন ফসল, ডাল, গম, টমেটো ও অন্যান্য সবজির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। কৃষি প্রধান এলাকার চাষিরা টমেটো ও অন্যান্য সবজি আবাদের মাধ্যমে আর্থিক লাভবান হলেও অসময়ের বৃষ্টিতে তাদের দুশ্চিন্তায় ফেলেছে। এ পরিস্থিতিতে ক্ষতিগ্রস্ত চাষিরা কিভাবে ক্ষতি পুষিয়ে উঠবেন সেটি ভেবে পাচ্ছেন না।

উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অফিসার অসীম কুমার দাস জানান, এ বছর ৩২০ হেক্টর জমিতে বোরো রোপণের জন্য বীজতলা তৈরি করা হয়েছে কিন্তু ঘূর্ণিঝড় জোয়াদের প্রভাবে ১৭৩ হেক্টর বীজতলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়া আমন আবাদ করা হয়েছে ৫৮০ হেক্টর জমিতে এর মধ্যে ১৪৫ হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সরিষা ১৬১ হেক্টর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১২০ হেক্টর। খেসারী ডাল ১৫০ হেক্টর জমিতে আবাদ করা হয়েছে, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১০৯ হেক্টর। পাশাপাশি টমেটো ও অন্যান্য সবজির ক্ষয়-ক্ষতির তালিকা নিরূপণের কাজ চলছে।

রাজাপুর (ঝালকাঠি) প্রতিনিধি জানান, ঝালকাঠির রাজাপুরে ঘূর্ণিঝড় জাওয়াদের প্রভাবে বৃষ্টির সঙ্গে থাকায় আমন ধান হেলে পড়েছে। এছাড়া খেসারি ডাল ও শীতকালীন শাকসবজির বাগানে পানি জমে আছে। এতে ফসলের ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা করছে কৃষকরা।

উপজেলা কৃষি অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরে ১১ হাজার ২৫০ হেক্টর জমিতে আমন ধানের আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে ৮ হাজার ৪৩০ হেক্টর জমির ধান মাঠে রয়েছে। বাকিটা কর্তন করা হয়েছে। মোট ৬ হাজার হেক্টর জমিতে রবি শস্যের আবাদ হবে। ইতোমধ্যে ৪ হাজার হেক্টর জমিতে আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে ২ হাজার ৩৫০ হেক্টর জমিতে রয়েছে খেসারি ডাল। এছাড়াও ৪৬০ হেক্টর জমিতে শীতকালীন শাকসবজি চাষ হয়েছে।

উপজেলা সদরের পিংড়ি, বাড়ইবাড়ি, পুকুরিজানা, সাউথপুর, সাংগর, মানকিসুন্দর এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, টানা বৃষ্টি ও সঙ্গে দমকা বাতাসের কারণে ধান গাছ গুলো মাটিতে নুয়ে পড়েছে। নুয়ে পড়া ধান গাছগুলোর অধিকাংশ ধানের ছড়া পানির মধ্যে ডুবে রয়েছে। খেসারি ডাল ও শীতকালীন শাক সবজির বাগানে পানি জমে রয়েছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে