জনমনে আতঙ্ক

জয়পুরহাটে প্রাণঘাতী জিবিএস, ৪ জনের মৃত্যু

প্রকাশ | ১১ নভেম্বর ২০১৮, ০০:০০

মাসুদ রানা, জয়পুরহাট
জয়পুরহাট জেলায় প্রাণঘাতী নতুন রোগ জিবিএসে গত কয়েকদিনে আক্রান্ত হয়েছে অন্তত ১৩ জন। এরমধ্যে মারা গেছে ৪ জন, বাকি ৯ জনের চিকিৎসা চলছে। এ রোগটি অজানা ও অপরিচিত হওয়ায় এবং চিকিৎসার ব্যয়ভার বেশি হওয়ায় জেলাবাসী আতঙ্কে আছেন। তবে আতঙ্কিত না হয়ে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়ার জন্য পরামশর্ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা। এ ব্যাপারে তথ্য অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত ৬ অক্টোবর শহরের বারিধারা মহল্লার পীযূষ কুমার সাহা সুমনের স্ত্রী পিংকি রানী সাহার (২২) হাত-পা অবশ হয়ে পড়লে জয়পুরহাট জেলা আধুনিক হাসপাতালে নেয়া হলে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে ঢাকা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভতির্ করানো হয়। সেখানে তার জিবিএস রোগ শনাক্ত হয়। পরে সেখানে ভতির্ অবস্থায় ৯ অক্টোবর তিনি মারা যান। গত ৪ অক্টোবর শহরের সাহেবপাড়া মহল্লার পল্লী চিকিৎসক দিলদার হোসেন জিবিএস রোগে আক্রান্ত হলে তাকে চিকিৎসার জন্য ঢাকায় নেয়া হয়। বতর্মানে তিনি ঢাকা থেকে ফিরে নিজ বাড়িতে চিকিৎসাধীন আছেন। গত ১৯ অক্টোবর রাতে সদর উপজেলার ধলাহার ইউপির দড়িপাড়া গ্রামের মৃত আব্দুল হাকিমের পুত্র রুহুল আমিন (৫০) রাতে একবার পাতলা পায়খানা করেন। পরদিন সকালে তিনি ফজরের নামাজ পড়ে মসজিদ থেকে বাড়ি ফেরার পথে হঠাৎ তার হাত-পা অবশ হয়ে পড়ে এবং শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়। তাকে প্রথমে জয়পুরহাট জেলা আধুনিক হাসপাতালে নেয়া হলে সেখান থেকে বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভতির্ করা হলে চিকিৎসকরা জিবিএস রোগ হিসেবে শনাক্ত করেন। পরে তিনি ২৭ অক্টোবর মারা যান। গত ২৭ অক্টোবর শহরের সবুজনগর মহল্লার মনছুর আলী শাহিনের স্ত্রী ফেরদৌসী বেগম জিবিএস রোগে আক্রান্ত হলে তাকে ২৮ অক্টোবর ঢাকা ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরো সাইন্স অ্যান্ড হাসপাতালে ভতির্ করানো হলে এখন পযর্ন্ত তাকে সেখানে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। গত ৩০ অক্টোবর হঠাৎ করে শহরের থানা এলাকার দীপক চাকীর মেয়ে বনশ্রী জিবিএস রোগে আক্রান্ত হলে তাকে ঢাকা ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরো সাইন্স অ্যান্ড হাসপাতালে ভতির্ করানো হলে তাকে এখন পযর্ন্ত চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। গত ৩ নভেম্বর সকালে জেলার আক্কেলপুর উপজেলার মাস্টারপাড়া মহল্লার রাব্বীর ছেলে ৮ম শ্রেণির ছাত্র মারুফের হাত-পা অবশ হয়ে পড়ে। এসময় তাকে বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভতির্ করা হলে চিকিৎসকরা জিবিএস রোগ হিসেবে তাকে ঢাকায় নেয়ার পরামশর্ দেন। তাকে ঢাকায় নেয়ার পথে তিনি মারা যান। গত ৫ নভেম্বর জয়পুরহাটের বিএনপি দলীয় সাবেক হুইপ ও এমপি অ্যাডভোকেট আবু ইউসুফ মো. খলিলুর রহমানের স্ত্রী অ্যাডভোকেট নাজমুন নাহার ফেন্সি জিবিএস রোগে আক্রান্ত হলে তাকে ঢাকায় একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা শেষে বতর্মানে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরো সাইন্স অ্যান্ড হাসপাতালে ভতির্ করে আইসিইউতে রাখা হয়েছে। বেশ কিছুদিন আগে জেলার কালাই উপজেলার মোস্তাফিজুর রহমান স্বপনের ছেলে নিশাত খন্দকার জিবিএস রোগে আক্রান্ত হলে তাকে বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভতির্ করা হয়। সেখানে তিনি ৪৮ দিন চিকিৎসা শেষে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে আসেন। গত ৩০ সেপ্টেম্বরর পঁাচবিবি পৌর এলাকার দমদমা মহল্লার শহীদুল ইসলামের ছেলে জয়পুরহাট সরকারি কলেজের ছাত্র জিহাদ হাসান রাতে হঠাৎ করে হালকা জ্বর ও কয়েকবার পাতলা পায়খানা করে। ৩১ সেপ্টেম্বর সকালে তার হাত-পা অবশ হয়ে পড়লে তাকে ঢাকা ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরো সাইন্স অ্যান্ড হাসপাতালে ভতির্ করানো হলে তাকে দীঘর্ এক মাস চিকিৎসা শেষে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে আসেন। এভাবে জয়পুরহাট জেলায় অনেকেই বিরল এই রোগ জিবিএসে আক্রান্ত হচ্ছে। এ ব্যাপারে রোগীর একাধিক স্বজনের সাথে কথা বলে জানা গেছে, প্রাথমিকভাবে জিবিএস রোগ শনাক্ত হলে এ রোগের চিকিৎসা করাতে রোগীকে ৫টি ইনজেকশন দিতে হয়। প্রতিটি ইনজেকশনের দাম ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা। সব মিলিয়ে ৮ লাখ টাকার মতো খরচ হয়। এ রোগীকে আইসিইউতে রাখতে হয় এক মাস। ফলে এত টাকা খরচ করে চিকিৎসা নেয়াটা অনেকের পক্ষে সম্ভব হয় না। এ ব্যাপারে জয়পুরহাট জেলা আধুনিক হাসপাতালের কনসালট্যান্ট ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. আব্দুর রাজ্জাক জানান, এই রোগ সাধারণত পা থেকে শুরু হয়। প্রথমে পা অবশ হয়ে পড়ে তারপর পেটের মাংস ও বুকের মাংস ক্রেথিয়াল নাভর্ পযর্ন্ত আক্রান্ত হয়। জিবিএস আক্রান্ত রোগীর শ্বাসতন্ত্রের মাংশপেশি দুবর্ল করে ফলে রোগীর প্রচÐ শ্বাসকষ্ট হয়। এমনকি শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে রোগীর মৃত্যু পযর্ন্ত ঘটতে পারে। এক্ষেত্রে রোগীকে আইসিইউতে রেখে চিকিৎসা দিতে হয়। এই রোগে শ্বাসতন্ত্রকে আক্রমণ করে। জ্বর, সদির্, আমাশয়, রক্ত আমাশয়, ডায়রিয়া ও ভাইরাসজনিত সংক্রমণ ২ থেকে ৩ সপ্তাহ ধরে থাকলে জিবিএস রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থকে। এছাড়া যারা ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয় তাদের মধ্যে রোগীর দেহে ক্যামপিলোব্যাকটর জীবাণু থাকলে জিবিএস হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থকে। এছাড়া অজানা কারণেও এ রোগ হতে পারে। এদিকে জয়পুরহাট জেলায় এ রোগ বেশি দেখা দেয়ার ঢাকা থেকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় হতে একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন টিম শনিবার জয়পুরহাট আসেন। টিমের সদস্যরা জেলার বিভিন্ন জিবিএস রোগীর বাড়ি পরিদশর্ন করে তথ্য সংগ্রহ করেছেন। জেলা সিভিল সাজর্ন অফিস সূত্রে জানা গেছে, জয়পুরহাটে এখন পযর্ন্ত ১৩ জন জিবিএস রোগী পাওয়া গেছে। তার মধ্যে ৪ জন মারা গেছে। বাকি ৯ জন চিকিৎসাধীন আছে। এর মধ্যে ২ জন বিভিন্ন জায়গায় চিকিৎসা শেষে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন। জেলা সিভিল সাজর্ন ডা. হাবিবুল আহসান তালুকদার জানান, জিবিএস রোগটি জয়পুরহাট এলাকায় নতুন। এটি বিরল একটি রোগ। কয়েক লাখে একজন এ রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে। তবে এ ধরনের রোগের লক্ষণ দেখা দিলে রোগী এবং রোগীর স্বজনদের আতঙ্কিত না হয়ে নিকটস্থ হাসপাতালে ভতির্ করানো প্রয়োজন। রোগীকে দেরি না করে যত দ্রæত সম্ভব বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়ার জন্য পরামশর্ প্রদান করেন।