দাম্পত্য কলহের জেরে চলচ্চিত্র শিল্পী শিমুকে শ্বাসরোধে হত্যা

প্রকাশ | ১৯ জানুয়ারি ২০২২, ০০:০০

ম যাযাদি রিপোর্ট
বহুল আলোচিত চলচ্চিত্র শিল্পী রাইমা ইসলাম শিমুকে দাম্পত্য কলহের জেরে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়েছে। এরপর লাশটি একটি পস্নাস্টিকের বস্তায় ভরে, সেই বস্তা লুকিয়ে রাখা হয় খাটের নিচে। প্রায় ষোলো ঘণ্টা শিমুর লাশ বস্তার ভেতরে খাটের নিচে ছিল। এরপর গভীর রাতে লাশটি একটি পাজেরো গাড়িতে করে কেরানীগঞ্জের হজরতপুর ব্রিজের কাছে আলিয়াপুর এলাকার রাস্তার পাশের একটি ঝোপের ভেতর ফেলে দেওয়া হয়। হত্যাকান্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে নিহত শিমুর স্বামী খন্দকার শাখাওয়াত আলীম নোবেল ও নোবেলের বাল্যবন্ধু এসএম ওয়াই আব্দুলস্নাহ ফরহাদকে আটক করেছে পুলিশ। জব্দ হয়েছে লাশ গুমের কাজে ব্যবহৃত গাড়িটিও। মঙ্গলবার ঢাকা জেলা পুলিশ সুপার মারুফ হোসেন সরদার আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, গত ১৭ জানুয়ারি সকাল দশটার দিকে ঢাকা জেলার কেরানীগঞ্জ থানাধীন হজরতপুর ব্রিজের কাছে আলিয়াপুর এলাকার রাস্তার পাশের একটি ঝোপের ভেতর থেকে চিত্রনায়িকা শিমুর (৪১) লাশ বস্তাবন্দি অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। তিনি বলেন, ঘটনাস্থলে হত্যাকান্ডের গুরুত্বপূর্ণ আলামত পাওয়া গেছে। সেই আলামতের সূত্রধরেই লাশ উদ্ধারের পর শিমুর মৃতু্যর নেপথ্য কারণ জানতে গোয়েন্দা তৎপরতা ও তদন্ত শুরু করা হয়। তদন্তের এক পর্যায়ে তিনি পরিকল্পিত হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছেন বলে নিশ্চিত হওয়া যায়। পুলিশ সুপার মারুফ হোসেন সরদার বলেন, ১৭ জানুয়ারি মধ্যরাতে পুলিশ শিমুর স্বামীর রাজধানীর কলাবাগান থানাধীন গ্রীন রোডের ৩৪ নম্বর বাড়িতে অভিযান চালায়। অভিযানে বাসা থেকে হত্যাকান্ডের আরও আলামত পাওয়া যায়। এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, যতই পরিকল্পিত হত্যাকান্ড হউক না কেন, খুনি বা খুনিরা কোনো না কোনো চিহ্ন রেখে যায়। সেই আলামতের সূত্রধরেই শিমু হত্যাকান্ডে তার স্বামী ও স্বামীর এক বাল্যবন্ধু জড়িত বলে তথ্য মিলে। অভিযানে শিমুর বাসা থেকেই তার স্বামী খন্দকার শাখাওয়াত আলীম নোবেলকে (৪৮) আটক করা হয়। পরে পাশের একটি বাড়ি থেকে তার বাল্যবন্ধু এসএম ওয়াই আব্দুলস্নাহ ফরহাদকে (৪৭) আটক করা হয়। পুলিশ সুপার মারুফ হোসেন বলেন, রাতেই তাদের কেরানীগঞ্জ থানা হেফাজতে নেওয়া হয়। জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে শিমু হত্যাকান্ডে আটক হওয়া দুই জন তাদের সংশ্লিষ্টতার কথা জানায়। শিমুর স্বামীর দেওয়া তথ্যের বরাত দিয়ে পুলিশ সুপার বলেন, মূলত পারিবারিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে স্বামীর সঙ্গে দাম্পত্য কলহ ছিল শিমুর। দাম্পত্য কলহের জেরে গত ১৬ জানুয়ারি সকাল ৭টা থেকে ৮টার মধ্যে শিমুকে হত্যা করে তার স্বামী নোবেল। পরে লাশটি ওইদিনই মধ্যরাতে একটি গাড়িতে করে নিয়ে সেখানে ফেলে রেখে আসে। পুলিশ সুপার মারুফ হোসেন সরদার বলেন, লাশ উদ্ধারের ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই আমরা খুনিদের শনাক্ত করে তাদের গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়েছি। এমনকি চাঞ্চল্যকর হত্যাকান্ডের ঘটনার রহস্যও উদঘাটন করা সম্ভব হয়েছে। হত্যাকান্ডের সঙ্গে আরও কেউ জড়িত আছে কিনা সে বিষয়ে গভীর তদন্ত চলছে। চাঞ্চল্যকর শিমু হত্যাকান্ডে জড়িতদের গ্রেপ্তারে অভিযান পরিচালনকারী পুলিশ দলের প্রধান ঢাকা জেলার কেরানীগঞ্জ সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. শাহাবুদ্দিন কবির বলেন, শিমু ও তার স্বামী রাজধানীর কলাবাগান থানাধীন গ্রীন রোডের ৩৪ নম্বর বাড়িতে থাকতেন। ওই বাড়িটি নোবেলদের নিজস্ব। ছয় তলা বাড়িটি তারা একটি ডেভেলপার কোম্পানি দিয়ে তৈরি করিয়েছেন। তারা ভাগ হিসেবে একাধিক ফ্ল্যাট পেয়েছেন। এই দম্পতি তিন তলার একটি ফ্ল্যাটে বসবাস করতেন। দীর্ঘ দিন ধরেই তাদের দাম্পত্য জীবনে কলহ চলছিল। এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, গত ১৬ জানুয়ারি সকালেই তাদের মধ্যে কলহ শুরু হয়। কলহ চরম আকার ধারণ করলে এক পর্যায়ে নোবেল তার স্ত্রী শিমুকে শ্বাসরোধে হত্যা করে। তখন সকাল আনুমানিক ৭টা কি ৮টা বাজে। হত্যার পর লাশ ঘরেই লুকিয়ে রাখে। এরপর লাশ গুম করে ফেলার পরিকল্পনা করে। সেই পরিকল্পনা মতে ফরহাদ আর নোবেল গত ১৬ জানুয়ারি দিবাগত রাতে এসইউভি সিরিজের একটি পাজেরো গাড়ি নিয়ে আসে। বস্তায় ভরে রাখা লাশটি সেই গাড়িতে তুলে। গভীর রাতে লাশটি কেরানীগঞ্জের ওই জায়গায় ফেলে দেয়। এদিকে আমাদের কেরানীগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, লাশ স্যার সলিমুলস্নাহ মেডিকেল কলেজ মর্গে (মিডফোর্ড হাসপাতাল) পাঠানো হয়। ময়নাতদন্ত শেষে চিকিৎসকরা জানান, শিমুকে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়েছে। শিমুর শরীরে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। নিহত শিমুর বোন ফাতেমা নিশু বলেন, 'আমরা দুই ভাই দুই বোন। সবার বড় ভাই হারুন অর রশীদ। দ্বিতীয় ভাই শহিদুল ইসলাম খোকন। তৃতীয় ছিল শিমু। আমি সবার ছোট। আমাদের পিতা নুরুল ইসলাম। মা রাশিদা বেগম। পৈতৃক বাড়ি বরগুনা জেলার আমতলী থানাধীন হলুদিয়া গ্রামে। তবে আমরা সবাই ঢাকায় থাকি। তিনি বলেন, 'শিমুর বিয়ে হয়েছে প্রায় ১৮ বছর হবে। তাদের সংসারে রিট (১৬) নামে এক মেয়ে আছে। আর রাইয়ান (৭) নামে এক ছেলে আছে। তাদের সংসারে দাম্পত্য কলহ থাকার তেমন কোনো কথা আমার জানা নেই। দাম্পত্য জীবনে কোনো মানুষেরই শতভাগ সুখী হওয়ার রেকর্ড খুবই কম। তবে তারা দাম্পত্য জীবনে অসুখী ছিলেন বলে আমার জানা নেই। তিনি আরও বলেন, 'গত ১৫ জানুয়ারি রাতে আমার সঙ্গে শিমুর কথা হয়। পরদিন সকালে ম্যাজেঞ্জারে ফোন দেই। ফোন বাজলেও কেউ তা ধরেনি। ভাবলাম ব্যস্ত হয়তো। তাই ফোন ধরেনি। এরপর ওইদিনই সকালে রিটকে ফোন দেই। বলি, তোমার আম্মু ফোন ধরছে না কেন? রিট বলে, আম্মু বাইরে গেছে। এরপর সারাদিন ব্যস্ততার কারণে আর ফোন দেওয়া হয়নি। রাতে দুলাভাইকে ফোন দেই। তিনি জানান, শিমু বাইরে আছে। পরদিন অর্থাৎ ১৬ জানুয়ারি সকাল সাড়ে দশটার দিকে শিমুর ফোন বন্ধ পাই। এরপর একটানা চেষ্টা করেও তাকে পাইনি। পরে শিমুর পরিচিতদের কাছ থেকে শিমুর খবর জানতে চাই। তারা শিমুকে পাচ্ছে না বলে জানায়। পরদিন তো সব শেষ! শিমুর লাশ পাওয়া যায়। আমাদের কেরানীগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, এ ঘটনায় শিমুর বড় ভাই হারুন অর রশীদ বাদী হয়ে মামলা দায়ের করেছেন। মঙ্গলবার সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। শিমুর ছোট বোন নিশু জানান, লাশ কবে নাগাদ দাফন করা হবে, সে বিষয়ে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।