প্রতিদিনই সড়কে ঝরছে প্রাণ

বেপরোয়া গাড়ি চালানোর প্রতিযোগিতায় ঘটছে দুর্ঘটনা দক্ষ ও লাইসেন্সধারী চালকের তীব্র অভাব লাইসেন্সবিহীন চালক ও হেলপার দিয়ে গাড়ি চালানোয় দুর্ঘটনা বাড়ছে

প্রকাশ | ২৪ জানুয়ারি ২০২২, ০০:০০ | আপডেট: ২৪ জানুয়ারি ২০২২, ০৯:১০

আবদুল্লাহ রায়হান

রাজধানীর সড়কে গণপরিবহণ চালকরা দিনদিন বেপরোয়া হয়ে উঠছে। অধিক আয়ের লোভে চালকদের রেষারেষিতে সড়কে প্রাণ ঝরছে মানুষের। কার আগে কে যাবে এই নিয়ে প্রতিযোগিতা ও যাত্রী নেওয়ার তাড়াহুড়োয় প্রতিদিনই অসংখ্য দুর্ঘটনা ঘটছে। গাড়ির সঙ্গে গাড়ির ধাক্কা খেয়ে গস্নাস ভেঙে, দুই বাসের মাঝে চাপা পড়ে আহত হচ্ছেন অনেকেই। সড়কে চালকদের খামখেয়ালিপনার এইসব নৈরাজ্য দীর্ঘদিনের। সরকার বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এসব নিয়ন্ত্রণ করতে পুরোপুরি ব্যর্থ হচ্ছে বলে মনে করেন পরিবহণ সংশ্লিষ্টরা। অভিযোগ রয়েছে, পরিবহণ সেক্টরে কার্যত নৈরাজ্য চলছে সরকার নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে বেশি ভাড়া আদায়ের লোভ। বেশিরভাগ চালক যত্রতত্র বাস থামিয়ে যাত্রী উঠা-নামা করছেন। 'ডেইলি জমায়' গাড়ি চালানোর কারণে জমার টাকা উঠিয়ে সবাই অধিক মুনাফা নিতে বেশি যাত্রী নেওয়ার প্রতিযোগিতা করছে। সারাদেশে লাইসেন্সবিহীন চালকদের পাশাপাশি হেলপার দিয়ে গাড়ি চালানোর কারণেও দুর্ঘটনা ঘটছে বলে মনে করেন পরিবহণ বিশেষজ্ঞরা। স্বল্প বয়সি তরুণ অনেক হেলপার বাস চালিয়ে থাকে। প্রতিদিন বাসের ড্রাইভারদের মালিক জমার টাকা নির্ধারণ করে দিচ্ছে। মাস শেষে বেতনের নিশ্চয়তা না থাকায় তাদের ভয়ংকর প্রতিযোগিতায় নামতে হচ্ছে। এজন্য সড়কে মারা যাচ্ছে মানুষ, কেউ কেউ দুর্ঘটনায় পড়ে পঙ্গুত্বও বরণ করছেন চিরদিনের জন্য। দুর্ঘটনা কমাতে সরকারের আরও কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করার পরামর্শ তাদের। সেইসঙ্গে গণপরিবহণে যাতায়াতকারী মানুষেরও সচেতন হওয়া উচিত। এদিকে, বৃহস্পতিবার রাজধানীর মগবাজার মোড়ে আজমেরী পরিবহণের তিন বাসের প্রতিযোগিতায় রাকিব নামে এক কিশোর নিহত হয়েছে। শুক্রবার সকালে রাজধানীর শনিরআখড়ায় সেইন্টমার্টিন পরিবহণের ধাক্কায় অটোরিকশা উল্টে নিহত হয়েছে একই পরিবারের তিনজন। এর আগে চলতি মাসেই মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভার থেকে গুলিস্তান ঢালে নামতে গিয়ে মেঘলা পরিবহণের বাসের চাপায় দুইজন নিহত হন। এভাবে প্রতিদিনই সড়কে দুর্ঘটনায় প্রাণ যাচ্ছে মানুষের। এ নিয়ে গণমাধ্যম কিংবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যতই ঝড় উঠুক, যত প্রাণহানিই হোক- কোনো পক্ষেরই বিচার হচ্ছে না। যাত্রীদের অভিযোগ, ট্রাফিক পুলিশের সামনেই প্রতিটি স্ট্যান্ডে বাসচালকরা বিশৃঙ্খলভাবে গাড়ি রাখছেন, যাত্রী তুলছেন। আসন পূরণ না হওয়া পর্যন্ত কেউ স্ট্যান্ড ছাড়তে চাইছেন না। করোনা মহামারির এ সময়েও গাদাগাদি করে যাত্রী নিয়ে বাসটি যখন অপর স্ট্যান্ডের দিকে ছুটে যায়, তখন এর গতি হয়ে ওঠে বেপরোয়া। আর এ সময় একই রুটের অন্য কোনো বাস এলে, তা নিয়ে ভয়ংকর প্রতিযোগিতা চলতে থাকে। পথচারী পারাপার, মোড়, ফ্লাইওভার এবং স্কুল-কলেজ-হাসপাতালের সামনেও বেপরোয়া গতির প্রতিযোগিতায় লাগাম টানা যাচ্ছে না। রাজধানীর সাইনবোর্ড, শনিরআখড়া, যাত্রাবাড়ী, শাহবাগ, প্রেস ক্লাব, মৎস্যভবন, শাহবাগ, কারওয়ান বাজার, পান্থপথ, ফার্মগেট, মৌচাক, মালিবাগ, মগবাজার, সায়েদাবাদ, মুগদা, বাসাবো, মালিবাগ, রামপুরা, বাড্ডাসহ বিভিন্ন স্পট পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, সব বাসের চালকই বেপরোয়া। কে কার আগে যাবে- এমন প্রতিযোগিতায় লিপ্ত সবাই। শুক্রবার সাইনবোর্ড এলাকায় দেখা গেছে, মৌমিতা পরিবহণের (ঢাকা মেট্রো ব ১৫-৪১৩১) বাসটি এলেই ঠিকানা পরিবহণের (ঢাকা মেট্রো ব ১৫-১০১৮) বাসটি ডানে চেপে যাত্রী উঠাতে বাধা দেয়। এরপর দুই বাসের রেষারেষি শুরু হয়। একই এলাকায় অনাবিল পরিবহণের (ঢাকা মেট্রো ব ১৫-৩৮৪৯) বাসটিকে যাত্রী উঠাতে বাধা দেয় অনাবিলের (ঢাকা মেট্রো ব ১৫-১৮৯৫) বাসটি। বাসাবো গ্রেট তুরাগ পরিবহণের (ঢাকা মেট্রো ব ১৪-১৫৫৭) বাসটি এলাকায় খিলগাও ফ্লাইওভারে ওঠার মুখ বন্ধ করে দিয়ে যাত্রী উঠাতে থাকে। প্রায় ৩-৪ মিনিট পর বাসটি ফ্লাইওবারে উঠলে অন্য গাড়িগুলো চলতে শুরু করে। ঢাকার রাস্তায় যে কোনো স্টপেজে কয়েক মুহূর্ত দাঁড়ালে দেখা যাচ্ছে পরিবহণ কোম্পানির বাসগুলো একটি আরেকটির সঙ্গে 'রেসিং' করছে। একই মালিক বা কোম্পানির গাড়ি হলেও একটি অপরটিকে পেছনে ফেলতে মরিয়া হয়ে উঠছে। এক্ষেত্রে সামনের বাস না সরলে পেছনের বাস সজোরে ধাক্কাও মারছে। আবার একটি বাস আরেকটির সঙ্গে গা-ঘেঁষে এমনভাবে চলছে, কোনোটি খানিক চাপ দিলেই ঘটে যেতে পারে বড় রকমের দুর্ঘটনা। বুধবার রাতে পল্টনে আজমেরী পরিবহণের (ঢাকা মেট্রো-ব-১৫ ৭৭২০) বাসটি অপর একটি বাসকে চাপ দিলে পেছন দিকের কয়েকটি জানালার গস্নাস ভেঙে যাত্রীরা আহত হন। এ নিয়ে যাত্রীরা প্রতিবাদ করলে হেলপার ও চালক যাত্রীদের উল্টো কথা শোনান। এক যাত্রী ৯৯৯ এ ফোন দিয়ে প্রতিকার চাইলে প্রতিকারও মেলেনি। শুক্রবার শাহবাগ মোড়ে সিগন্যাল ছাড়তেই একেক দিক থেকে হুমড়ি খেয়ে পড়তে দেখা যায় একই রুটের কয়েকটি বাস। এর মধ্যে খাজাবাবা পরিবহণ (ঢাকা মেট্রো-ব-১১৮৬৩৮) ও হিমাচল পরিবহণের (ঢাকা মেট্রো-ব-১১-৮১৩৮) দুটি বাস এমনভাবে ঘষা খায় যাতে বেশ জোরে শব্দ হয়। অপেক্ষমাণ ও বাসের যাত্রীরা প্রাণভয়ে চিৎকার করেন। কিন্তু দুই বাসের চালক ও সহকারীরা বিষয়টিতে কোনো ভ্রূক্ষেপই করেননি। রাজধানীতে চলা আজমেরী, গাজীপুর পরিবহণ, তুরাগ, শিকড়, বোরাক, মক্কা, বলাকা, রাইদা, মনজিল, মেঘলা, হিমাচল, নীলাচল, সময়, মৌমিতা, ঠিকানা, মিডওয়ে, আনন্দ পরিবহণের বাসগুলোর বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি শৃঙ্খলা ও নিয়ম লঙ্ঘনের অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। তারা রাস্তায় এমনভাবে দাঁড়াচ্ছে যেন সিরিয়ালে পেছনের গাড়িটা আগে চলে যেতে না পারে, কিন্তু এতে দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। পরিবহণ শ্রমিকরা জানান, রাজধানীর অধিকাংশ গাড়িই চলে দৈনিক চুক্তিতে। ড্রাইভার-মালিক চুক্তি অনুযায়ী দিনে বাসের মালিককে দিতে হয় ২-৩ হাজার টাকা। স্বাভাবিক গতিতে গাড়ি চালালে যানজটের কবলে পড়ে যে কয়টা ট্রিপ হয়, তাতে জমার টাকাই তোলা যায় না। তাই ট্রিপ বাড়াতে প্রতিযোগিতা করছে তারা। এছাড়া রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশ, স্থানীয় নেতাদের চাঁদাবাজির জন্যও তাদের বেশি ইনকাম করতে রেষারেষি করতে হচ্ছে। তুরাগ পরিবহণের বাসের চালক শহিদুল ইসলাম জানান, 'ভোর রাত থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত বাস চালান তারা। তারপরও কোনো কোনো দিন রোড খরচা (পরিবিহণ মালিক সমিতি, পুলিশ, স্থানীয় নেতাদের বিভিন্ন চাঁদা) দিয়ে মালিকের জমার টাকা উঠাতেই কষ্ট হয়ে যায় তাদের। যানজটে ট্রিপ কমে গেলে সেদিন তাদের লোকসানে পড়তে হচ্ছে। এজন্যই তারা একে অপরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে বাস চালাচ্ছেন।' নিরাপদ সড়ক চাইয়ের (নিসচা) চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন মুঠোফোনে যায়যায়দিনকে বলেন, 'সারাদেশের বাসের চালকরা বেপরোয়া গাড়ি চালান বলেই সড়কে এত দুর্ঘটনা। এত মৃতু্য। তারা কাউকেই মানছে না। চালকেরা যাত্রী ধরতে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ে মানুষ মারছেন। এদের অনেকেরই নেই লাইসেন্স। হেলপার দিয়ে গাড়ি চালানোর জন্যও দুর্ঘটনা বাড়ছে।' তিনি আরও বলেন, 'সড়কে দুর্ঘটনা কমাতে সরকারের কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেই।' ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, 'গত বছরের চেয়ে সাড়ে ২৮ শতাংশ দুর্ঘটনা বেড়েছে। আইন থাকলেও তা বাস্তবায়ন করার জন্য কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না। একের পর এক যাত্রী প্রাণ হারালেও কয়টা চালকের শাস্তি হয়েছে- প্রশ্ন রাখেন তিনি। সড়ক পরিবহণ সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ যায়যায়দিনকে বলেন, 'অসুস্থ প্রতিযোগিতা করে কোনো পরিবহনের চালক গাড়ি চালাক- এটা আমরা কখনো চাই না।' দেশে ৩৫ লাখ গাড়ির বিপরীতে লাইসেন্সধারী চালক মাত্র ১৫ থেকে ১৬ লাখ। বর্তমানে দক্ষ ও লাইসেন্সধারী চালকের অভাব প্রকট উলেস্নখ করে তিনি বলেন, 'দক্ষ চালকদের হাতে গাড়ি দিলে দুর্ঘটনা কম ঘটে। অদক্ষ ও লাইসেন্সবিহীন চালকেরা কার আগে কে যাবে এই ভাবনা থেকেই প্রতিযোগিতা করে থাকে। যারা নিয়ম না মেনে এলোমেলোভাবে সড়কে বাস চালাচ্ছে তাদেরকে আমরা আইনের আওতায় আনতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সহযোগিতা করছি। তিনি বলেন, 'অধিকাংশ চালকই রোজভিত্তিক গাড়ি চালাচ্ছেন, তাতে চালকরা আয় বাড়াতে বেপরোয়া হচ্ছেন। আমরা চালকদের বেতনের নিশ্চয়তা ও নিয়োগপত্র দিতে পরিবহণ মালিকদের বলেছি। কেউ কেউ চুক্তি বাতিল করে চালকদের নিয়োগ দিয়েছেনও।' বুয়েটের অধ্যাপক ও পরিবহণ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডক্টর এম শামসুল হক জানান, দিনের পর দিন শুধু রাজধানী নয়, সারাদেশেই গণপরিবহণ চালক-মালিকরা বেপরোয়া হয়ে উঠছে। এদেরকে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাও নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। সড়কে গণপরিবহণকে শৃঙ্খলাবদ্ধ না করতে পারলে দিন দিন এমন ভয়ংকর দুর্ঘটনা বাড়বে। তিনি বলেন, 'পুরো রাজধানীতে একটি শক্তিশালী সংস্থার মাধ্যমে যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ-চালানোর ব্যবস্থা নিতে হবে। এ জন্য আলাদা একটি সংস্থা করা দরকার। সেখানে প্রশাসন, ইঞ্জিনিয়ারসহ বিভিন্ন সেক্টরের লোক কাজ করবে। তারাই কঠোরভাবে পুরো ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করবে।'