এক বছরে ৫৬২৯ সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ৭৮০৯

যাত্রী কল্যাণ সমিতির বার্ষিক দুর্ঘটনা প্রতিবেদন

প্রকাশ | ২৪ জানুয়ারি ২০২২, ০০:০০

ম যাযাদি রিপোর্ট

করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে ২০২১ সালে ৮৫ দিন গণপরিবহণ বন্ধ ছিল। এরপরও এই এক বছরে ৫ হাজার ৬২৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৭ হাজার ৮০৯ জন নিহত হয়েছেন। এ সময় আহত হয়েছেন ৯ হাজার ৩৯ জন। সড়ক দুর্ঘটনার উলেস্নখযোগ্য কারণগুলোর মধ্যে বেপরোয়া গতি, বিপজ্জনক ওভারটেকিং, রাস্তাঘাটে ত্রম্নটি, ফিটনেসবিহীন যানবাহন, যাত্রী ও পথচারীদের অসতর্কতা, চালকের অদক্ষতাকে দায়ী করা হয়েছে। দুর্ঘটনায় বার্ষিক ক্ষয়ক্ষতি জিডিপির প্রায় ১.৫ শতাংশ। এসব হতাহতদের ৭৮.৩৯ শতাংশ ১৫ থেকে ৪৫ বছরের কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির বার্ষিক সড়ক দুর্ঘটনা পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। রোববার রাজধানীর সেগুনবাগিচায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর-রুনি মিলনায়তনে 'বার্ষিক সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিবেদন-২০২১ প্রকাশ' শীর্ষক এক সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনের মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী এক বছরে সড়ক দুর্ঘটনার চিত্র তুলে ধরেন। দেশের বিভিন্ন জাতীয়, আঞ্চলিক ও অনলাইন সংবাদপত্রে প্রচারিত সড়ক দুর্ঘটনার সংবাদ মনিটরিং করে প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি। প্রতিবেদনের তথ্য থেকে জানা গেছে, ২০২১ সালে রেলপথে ৪০২টি দুর্ঘটনায় ৩৯৬ জন নিহত, ১৩৪ জন আহত হয়েছে। নৌ-পথে ১৮২টি দুর্ঘটনায় ৩১১ জন নিহত, ৫৭৮ জন আহত এবং ৫৪৪ জন নিখোঁজ হয়েছে। সড়ক, রেল, নৌ-পথে সর্বমোট ৬ হাজার ২১৩টি দুর্ঘটনায় ৮ হাজার ৫১৬ জন নিহত এবং ৯ হাজার ৭৫১ জন আহত হয়েছেন। আগের বছর ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে সড়ক দুর্ঘটনা বেড়েছে ১৩.১১ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনার কবলে পড়েছে ট্রাক, পিকআপ, লরি ও কাভার্ডভ্যান ৩০.৪২ শতাংশ। এরপরই মোটর সাইকেল দুর্ঘটনার হার ২৫.৫৯ শতাংশ। প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২১ সালে সারাদেশে দুর্ঘটনার কবলে পড়েছেন ২ হাজার ৩৫০ জন চালক। এছাড়া ১ হাজার ৭১৫ জন পথচারী, ১ হাজার ১৭ জন পরিবহণ শ্রমিক, ৪৩০ জন শিক্ষার্থী, ১১১ জন শিক্ষক, ২৩৭ জন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, ১ হাজার ৭৬ জন নারী, ৬৩৮ জন শিশু, ৪২ জন সাংবাদিক, ২৭ জন চিকিৎসক, ১৪ জন আইনজীবী ও ১৮ জন প্রকৌশলী এবং ১৬১ জন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী ও ১০ জন মুক্তিযোদ্ধা দুর্ঘটনার শিকার হন। প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে ৫৫৪টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৫৭১ জন নিহত, ৯২২ জন আহত হয়েছে। ফেব্রম্নয়ারি মাসে ৪৯৫টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৫৫৬ জন নিহত, ৭৫০ জন আহত হয়েছে। মার্চ মাসে ৫০৬টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৫৪৬ জন নিহত, ৮৫৬ জন আহত হয়েছে। এপ্রিল মাসে ৪৩২টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৪৬৮ জন নিহত, ৫০৭ জন আহত হয়েছে। মে মাসে ৫৯৮টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৬১৫ জন নিহত, ১০০৮ জন আহত হয়েছে। জুন মাসে ৪৫২টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৪৬৬ জন নিহত, ৭৬২ জন আহত হয়েছে। জুলাই মাসে ৪১৬টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৪৬৫ জন নিহত, ৬৬৯ জন আহত হয়েছে। আগস্ট মাসে ৪০৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৪৩২ জন নিহত, ৬১৬ জন আহত হয়েছে। সেপ্টেম্বর মাসে ৪০৫টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৪৪১ জন নিহত, ৭৩৫ জন আহত হয়েছে। অক্টোবর মাসে ৪৭৪টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৫০৬ জন নিহত, ৭৫৮ জন আহত হয়েছে। নভেম্বর মাসে ৪৩২টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৪৬৩ জন নিহত, ৭০৫ জন আহত হয়েছে। ডিসেম্বর মাসে ৪৫৬টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৪৭৩ জন নিহত, ৭৫১ জন আহত হয়েছে। দেখা গেছে, সংঘটিত মোট দুর্ঘটনার ৫৪.০৭ শতাংশ পথচারীকে গাড়ি চাপা দেওয়ার ঘটনা, ২২.১৭ শতাংশ মুখোমুখি সংঘর্ষ, ১৬.১৩ শতাংশ খাদে পড়ে, ৬.২১ শতাংশ বিবিধ কারণে, ০.৫৩ শতাংশ চাকায় ওড়না পেঁচিয়ে এবং ০.৮৭ শতাংশ ট্রেন-যানবাহন সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় সংঘটিত যানবাহনের ০.৭৯ শতাংশ মোটর সাইকেলে, ০.৭৬ শতাংশ কার-জিপ-মাইক্রোবাসে ০.২১ শতাংশ সিএনজিচালিত অটোরিকশা দুর্ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে। পরিসংখ্যানের তুলনামূলক বিশ্লেষণে আরও দেখা গেছে, ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে পথচারীকে গাড়ি চাপা দেওয়ার ঘটনা ১.১১ শতাংশ, ট্রেন যানবাহন সংঘর্ষের ঘটনা ০.০৬ শতাংশ, মুখোমুখি সংঘর্ষের ঘটনা ০.১১ শতাংশ, চাকায় ওড়না পেঁচিয়ে নিহতের ঘটনা ০.১৯ শতাংশ বেড়েছে। নিয়ন্ত্রণ হায়িয়ে খাদে পড়ার ঘটনা ০.৯৫ শতাংশ ও অন্যান্য বিবিধ ঘটনা ০.৫ শতাংশ কমেছে। দুর্ঘটনার ধরন বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এই বছর মোট সংঘটিত দুর্ঘটনার ৩১.৫১ শতাংশ জাতীয় মহাসড়কে, ৩৯.২৯ শতাংশ আঞ্চলিক মহাসড়কে, ২০.৩৪ শতাংশ ফিডার রোডে সংঘটিত হয়েছে। এছাড়া সারাদেশে সংঘটিত মোট দুর্ঘটনার ৫.৩১ শতাংশ ঢাকা মহানগরীতে, ২.৬৬ শতাংশ চট্টগ্রাম মহানগরীতে ও ০.৮৭ শতাংশ রেলক্রসিংয়ে সংঘটিত হয়েছে। মোজাম্মেল হোসেন জানান, দীর্ঘ প্রায় ৩ মাস গণপরিবহণ বন্ধ থাকার পরেও বিগত বছরের চেয়ে বিদায়ী বছরে জাতীয় মহাসড়কে ২.৫৮ শতাংশ, ফিডার রোডে ১.২৩ শতাংশ, রেলক্রসিংয়ে ০.০৬ শতাংশ দুর্ঘটনা বেড়েছে, তবে আঞ্চলিক মহাসড়কে ৫.৪ শতাংশ দুর্ঘটনা কমেছে। সংবাদ সম্মেলনে সমিতির পক্ষ থেকে সড়ক দুর্ঘটনা রোধে ১২টি সুপারিশ করা হয়েছে। এর মধ্যে সড়ক নিরাপত্তায় বর্তমান সরকারের নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবায়ন করা, আইনের ত্রম্নটি চিহ্নিত করে সংস্কারপূর্বক ডিজিটাল পদ্ধতিতে সিসি ক্যামেরা স্থাপন করে সড়ক পরিবহণ আইন ২০১৮ কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা, সড়ক নিরাপত্তায় বাজেট বাড়ানো, সড়ক মন্ত্রণালয়ে আলাদা সড়ক নিরাপত্তা ইউনিট গঠন, সড়ক নিরাপত্তায় ইতোমধ্যে প্রণীত যাবতীয় সুপারিশমালা বাস্তবায়নে উদ্যোগ নেওয়া, দেশের সড়ক-মহাসড়কে রোড সাইন (ট্রাফিক চিহ্ন) স্থাপন করা, জেব্রা ক্রসিং আঁকা, চালকদের পেশাদার ট্রেনিং ও নৈতিক শিক্ষার ব্যবস্থা করা, সড়ক পরিবহণ সেক্টরে অনিয়ম-দুর্নীতি ও চাঁদাবাজি বন্ধ করা উলেস্নখযোগ্য। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন বুয়েট দুর্ঘটনা গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক ডক্টর হাদিউজ্জামান, গণপরিবহণ বিশেষজ্ঞ ও এফবিসিসিআইয়ের পরিচালক আবদুল হক, বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী নুর খান লিটন, নাগরিক সংহতির সাধারণ সম্পাদক শরীফুজ্জামান শরীফ, বিশিষ্ট সাংবাদিক মনজুরুল আলম পান্না, সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতা আনোয়ার হোসেন প্রমুখ। এ সময় অধ্যাপক ডক্টর হাদিউজ্জামান বলেন, 'দেশে প্রতি বছরই সড়ক দুর্ঘটনা বাড়ছে, শুধু কারিগরি সমস্যার কারণেই নয় রাজনৈতিক সমস্যাও রয়েছে এ ক্ষেত্রে।' তিনি বলেন, 'জাপানে মোটর সাইকেল চলাচল নিয়ন্ত্রণ করায় সেখানে সড়কে নিহত কমেছে ৫০ ভাগ। অথচ আমাদের দেশে নিহতের ৩ ভাগের ১ ভাগ মোটর সাইকেলে হচ্ছে। আমরা গণপরিবহণ নিয়ন্ত্রণ যেমন করতে পারি না, আবার মোটর সাইকেল চলাচলেও কোনো মানদন্ড দেখি না।'