বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

দেশের উন্নয়নযজ্ঞে বাড়ছে ক্যাবল শিল্পের বাজার

বর্তমানে বাজার ১২ হাজার কোটি টাকারও বেশি ৫০ হাজারেরও বেশি মানুষের কর্মসংস্থান নিম্নমানের ক্যাবল আমদানির অভিযোগ
আহমেদ তোফায়েল
  ২৭ জানুয়ারি ২০২২, ০০:০০
আপডেট  : ২৭ জানুয়ারি ২০২২, ০৯:১৭

স্বাধীনতার ৫০ বছরে দেশের শিল্প ও অবকাঠামোগত উন্নয়নে ক্যাবল শিল্প সঙ্গী হিসেবে আছে। প্রতিদিনই গড়ে উঠছে নতুন স্থাপনা এবং নতুন নতুন শিল্প কারখানা। গ্রাম হয়ে ওঠছে শহর। চারদিকে রূপান্তরের গল্প। আর এই স্বপ্নময় অগ্রযাত্রায় সমৃদ্ধির প্রতিচ্ছবি হয়ে আছে ক্যাবল শিল্প। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প ও বৃহৎ কারখানার সঙ্গে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পেরও বিকাশ ঘটছে; বড় হচ্ছে আবাসন খাত। আর শহর ও গ্রামীণ পর্যায়ে এসব উন্নয়নযজ্ঞে বছরে প্রায় ২০ শতাংশ হারে বাড়ছে ক্যাবল শিল্পের বাজার। একযুগ আগেও দেশে ক্যাবলের বাজার ছিল দুই হাজার কোটি টাকার। সেখান থেকে বর্তমানে এই বাজারের পরিধি ১২ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। এগিয়ে এসেছে বড় বড় ব্র্যান্ডসহ ১২০টিরও বেশি কোম্পানি। দেশের ক্যাবল খাত ৫০ হাজারেরও বেশি মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে। তবে, সরকারি প্রকল্পে বিদেশি কোম্পানির ক্যাবল ব্যবহার ও ননব্র্যান্ডেড ক্যাবলের কারণে বাজারে অসম প্রতিযোগিতা তৈরি হচ্ছে বলে দাবি করছেন সংশ্লিষ্টরা। দেশের ক্যাবল বাজারে দীর্ঘদিন ধরেই নেতৃত্ব দিয়ে আসছে বিআরবি ক্যাবল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। দেশের বাজারে ৩০ শতাংশের বেশি অংশীদারিত্ব থাকা এই কোম্পানিটিতে সরাসরি কাজ করছে ১০ হাজারেরও বেশি লোক। বৈদু্যতিক সংযোগ, ইন্টারনেট, ডিশ এন্টিনাসহ সব ধরনের সংযোগ ক্যাবল উৎপাদন করছে কোম্পানিটি। বিআরবি ক্যাবলস সূত্রে জানা গেছে, দেশে অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও বিদু্যৎ সংযোগের গতি দেখে অনেকেই বিনিয়োগ করেছেন। ব্যবসা সম্প্রসারণ করেছে বড় বড় সব প্রতিষ্ঠান। ক্যাবলের বাজার এখনো ২০ শতাংশ হারে বাড়ছে। তবে বিদেশ থেকে শুল্কমুক্ত আমদানি অব্যাহত থাকলে দেশীয় উদ্যোক্তারা ধরা খাবেন। জানা গেছে, সরকারি প্রকল্পগুলো যেসব দেশের অর্থায়নে বা তত্ত্বাবধায়নে হয়, তারা নিজেদের দেশ থেকে ক্যাবল নিয়ে আসে। অন্যদিকে শুল্ক পরিশোধ করে চিলি, চীন, ভারত, ওমান, মালয়েশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া এবং সিঙ্গাপুর থেকে তাদের কাঁচামাল নিয়ে আসতে হয়। ফলে তারা প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছেন। বিদেশ থেকে অনেক সময়ই মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে নিম্নমানের ক্যাবল আমদানি করা হয় বলে কোম্পানি সূত্রে জানা গেছে। বিআরবি ক্যাবলসের পরই বাজারে নেতৃত্ব দিচ্ছে বিবিএস ক্যাবল। শেয়ার বাজারের তালিকাভুক্ত কোম্পানি এটি। বিবিএস ক্যাবলে চলতি বছরে প্রবৃদ্ধি ১৫ শতাংশের বেশি রয়েছে বলে জানিয়েছেন এর কর্মকর্তারা। বিবিএস ক্যাবলসের একজন কর্মকর্তা বলেন, 'মাত্র ১০ বছরের ব্যবধানে হাজার কোটি টাকার কোম্পানিতে পরিণত হয়েছে বিবিএস। বর্তমানে কোম্পানিটি সব ধরনের ক্যাবল উৎপাদন করছে। অবকাঠামোগত উন্নয়নের ফলে প্রতিনিয়তই চাহিদা বাড়ছে। সরকারি প্রকল্পেও চাহিদা বাড়ছে ধীরে ধীরে।' খাত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কমপক্ষে সাতটি গ্রেডের বৈদ্যুতিক তার পাওয়া যাচ্ছে বাজারে। দেশের ১২ হাজার কোটি টাকার ক্যাবলের বাজারে চার হাজার কোটি টাকার ক্যাবলই আসছে বিদেশ থেকে। স্থানীয় নির্মাতাদের উৎপাদনের মাধ্যমে পুরো দেশের ক্যাবলের চাহিদা মেটানো সম্ভব হলেও, বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের জন্য বিদেশ থেকে বিপুল পরিমাণে ক্যাবল আদমানি করা হচ্ছে। এতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের অভিযোগ, মিথ্যা ঘোষণার মাধ্যমে কিংবা অনেক ক্ষেত্রে ঘোষণা ছাড়াই ভারত ও চীন থেকে নিম্নমানের ক্যাবল বাজারে নিয়ে আসা হচ্ছে। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলা শহরে ছোট ছোট প্রতিষ্ঠান নিম্নমানের ননব্র্যান্ডেড ক্যাবল উৎপাদন করছে। স্থানীয় পর্যায়ে এসব ননব্র্যান্ডেড ক্যাবলের বাজার এক হাজার কোটি টাকারও বেশি। আর ব্র্যান্ডেড ক্যাবলের বাজার প্রায় আট হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশ ইলেকট্রিক্যাল কেবলস ম্যানুফ্যাকচারার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. আনিসুর রহমান বলেন, 'দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর উদ্ভাবনী উদ্যোগের পরও অনুমোদনহীন বৈদু্যতিক ক্যাবলের উৎপাদন এবং আমদানি কমানো যাচ্ছে না। মানুষও যাচাই-বাছাই ছাড়াই কম দামের ক্যাবল কিনছে। কিছু ব্যবসায়ীর কারণে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই প্রয়োজন বুঝে পণ্য কিনতে পারেন না ক্রেতারা।' বিআরবি এবং বিবিএস ক্যাবলসের পরই দেশের বাজারে ভালো অবস্থানে রয়েছে চার বছর আগে বাজারে আসা প্রাণ আরএফএল গ্রম্নপের বিজলী ক্যাবলস। কয়েক বছরের মধ্যেই বাজারের ৫ শতাংশ দখলে নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। বিজলী ক্যাবলসের মতোই বাজারে অবস্থান প্যারাডাইস ক্যাবলসের। বিদেশি নিম্নমানের ক্যাবলসের সঙ্গে নিজেদের প্রতিযোগিতা করতে হয় বলে অভিযোগ করছে এই কোম্পানিগুলোও। দেশীয় উদ্যোক্তরা বলছেন, সরকারের বড় বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে শুরু করে মেগা প্রকল্পগুলোতে বিদেশি তার ব্যবহার না করে দেশে তৈরি তার ব্যবহারের সুযোগ দিতে হবে। তাহলে কোম্পানিগুলো টিকে থাকবে, বৈদেশিক মুদ্রার বিশাল সাশ্রয় হবে। সরকার শহরাঞ্চলের ক্যাবলের জঞ্জাল কমাতে সব শহরে নতুন সংযোগে ভূগর্ভস্ত ক্যাবল স্থাপনের ঘোষণা দিয়েছে। সরকারের ঘোষণার পরপরই প্রায় ১৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে হাইভোল্টেজের মেরিন ক্যাবল উৎপাদনে নতুন কারখানা স্থাপন করেছে বিবিএস ক্যাবল। ইউনিট-টু নামের ওই কারখানা ২০১৮ সালে উৎপাদন শুরু করে। ওই ঘোষণার পর নতুন ইউনিট স্থাপন করে মেরিন ক্যাবল উৎপাদন শুরু করে বিআরবি ক্যাবলস। সাম্প্রতিক সময় একই সেগমেন্ট দিয়ে বাজারে আসছে ওয়ালটন গ্রম্নপও। ধীরে ধীরে সব ধরনের ক্যাবল উৎপাদনের লক্ষ্য রয়েছে দেশীয় ইলেকট্রিক জায়ান্ট ওয়ালটনের। ওয়ালটন সূত্রে জানা গেছে, 'শতভাগ বিদু্যতায়নের ফলে ক্যাবলের চাহিদা বাড়ছে। ওয়ালটনের নিজেদেরই বিপুল পরিমাণ ক্যাবলের প্রয়োজন। তাই এই খাতে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তাদের লক্ষ্য হলো- শিগগিরই রপ্তানি বাজারের জন্য ক্যাবল উৎপাদন করা।' ওয়ালটন ছাড়াও বাজারে নতুন করে বিনিয়োগ নিয়ে আসছে পারটেক্স গ্রম্নপ এবং অ্যালকো গ্রম্নপ। বাংলাদেশে বৈদু্যতিক তার শিল্পের সম্ভাবনা নিয়ে বাংলাদেশ ইলেকট্রিক্যাল মার্চেন্ডাইজ ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিইএমএমএ) সাবেক সভাপতি মোশারফ হোসেন ভূঁইয়া বলেন, 'দেশে বৈদু্যতিক তারের বাজার অনেক বড়। বিদু্যতের চাহিদা ও উৎপাদন বাড়ার কারণে বৈদু্যতিক তারের বাজারও বাড়ছে। এই শিল্পের সম্ভাবনার ক্ষেত্র অনেক। সরকারকে এই ক্ষেত্রটিতে আরও গুরুত্ব দিতে হবে। দেশীয় উৎপাদন যাতে বাড়ে এবং আন্তর্জাতিক পণ্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে পারে, সেই সুবিধা বাড়াতে হবে। কাঁচামাল আরও সহজলভ্য করতে হবে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে- এখন তার উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ বাংলাদেশ। অভ্যন্তরীণভাবে দরকারি সব ধরনের ক্যাবল বা তার সরবরাহ করার জন্য বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোই যথেষ্ট। এখানে সব ধরনের তারই তৈরি হচ্ছে। শুধু তাই নয়, তার বিদেশে রপ্তানিও হচ্ছে।'

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে