রাঙ্গার হলফনামায় পুরনো মামলার তথ্য গায়েব

প্রকাশ | ০৬ ডিসেম্বর ২০১৮, ০০:০০

যাযাদি রিপোটর্
মশিউর রহমান রাঙ্গা
‘ঋণখেলাপি’ রুহুল আমিন হাওলাদারের মনোনয়নপত্র বাতিল হয়ে যাওয়ার পর জাতীয় পাটির্র মহাসচিবের দায়িত্ব পাওয়া পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী মসিউর রহমান রাঙ্গার হলফনামায়ও তথ্যের গরমিল পাওয়া গেছে। একাদশ জাতীয় সংসদ নিবার্চন সামনে রেখে নিবার্চন কমিশনে যে হলফনামা তিনি জমা দিয়েছেন, এতে পুরনো একটি মামলার তথ্য পুরো গায়েব করে দেয়া হলেও তার মনোনয়নপত্র বৈধ ঘোষণা করেছেন রংপুরের রিটানির্ং কমর্কতার্ জেলা প্রশাসক এনামুল হাবীব। রংপুর জেলা ও মহানগর জাতীয় পাটির্র সভাপতি রাঙ্গা এবারও রংপুর-১ আসনে জাতীয় পাটির্র লাঙ্গলের প্রাথীর্। জোটসঙ্গী আওয়ামী লীগ এই আসনে কোনো প্রাথীর্ দেয়নি। ২০১৪ সালের নিবার্চনের আগে জমা দেয়া হলফনামায় রাঙ্গা জানিয়েছিলেন, দুনীির্ত দমন কমিশন আইনে কোতোয়ালি থানায় ২০০৯ সালের ২১ জানুয়ারি দায়ের করা একটি মামলায় তিনি অভিযুক্ত। ওই মামলা প্রত্যাহারের সুপারিশ হয়েছে এবং এর কপি তিনি যুক্ত করে দিয়েছেন। আর এবারের হলফনামায় তিনি বলেছেন, বতর্মানে কোনো ফৌজদারি মামলায় তিনি অভিযুক্ত নন। অতীতেও তার বিরুদ্ধে কোনো ফৌজদারি মামলা দায়ের করা হয়নি। অতীতের মামলার বিষয়ে বিস্তারিত তথ্যের ঘরে তিনি লিখেছেন ‘প্রযোজ্য নহে’। রাঙ্গার মনোনয়নপত্রে তথ্যের এই গরমিল নিয়ে কথা বলতে চাননি নিবার্চন কমিশনের কমর্কতার্রা। ইসি সচিবালয়ের একজন কমর্কতার্ বলেন, মনোনয়নপত্র নিয়ে সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বুধবার পযর্ন্ত আপিল করার সুযোগ রয়েছে। তাই আপাতত তারা এ বিষয়ে কোনো কথা বলবেন না। কারও আপত্তি থাকলে তিনি আপিল করতে পারেন। নিবার্চন কমিশনের আরেকজন কমর্কতার্ হলফনামার তথ্য বাছাই ও মনোনয়নপত্র গ্রহণের বিষয়ে গত নভেম্বরে ইসির জারি করা একটি পরিপত্রের কথা বলেছেন। সেখানে বলা হয়েছে, অতীতে প্রাথীর্র বিরুদ্ধে দায়েরকৃত কোনো ফৌজদারি মামলার রেকডর্ আছে কিনা, থাকলে তার রায় কি ছিল, এ বিষয়ে প্রাথীর্ সব তথ্য দেবেনÑ এটাই প্রত্যাশিত। তবে অতীতের মামলা-সংক্রান্ত, বিশেষ করে অনেক পুরনো মামলা হলে, বিশদ তথ্য প্রাথীর্র কাছে সঙ্গত কারণে নাও থাকতে পারে। ‘তাই চ‚ড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়া হয়ে গেছে বা খালাস পেয়েছেনÑ এমন ক্ষেত্রে বিশদ তথ্য না দিতে পারার কারণে মনোনয়নপত্র বাতিল করা হবে না। তবে দÐিত হয়ে থাকলে এবং সেটা উল্লেখ না করার বিষয় প্রমাণিত হলে মনোনয়নপত্র গ্রহণযোগ্য হবে না।’ আগের হলফনামায় যে মামলার তথ্য দেয়া হয়েছিল, সেটা বাতিল হয়েছিল কিনা বা তিনি খালাস পেয়েছিলেন কিনা, সে তথ্য না দিয়ে রাঙ্গা এবার সরাসরি দাবি করেছেন, অতীতে কোনো ফৌজদারি মামলা তার বিরুদ্ধে হয়নি। এর কারণ জানতে টেলিফোনে যোগাযোগ করা হলে জাতীয় পাটির্র মহাসচিব টেলিফোনে বলেন, ‘দুদকের একটি মামলা হয়েছিল, ওটা তো ওয়ান ইলেভেনের সময়ের মামলা। এটা অব্যাহতি হয়ে গেছে, তাই এটার তথ্য না দিলেও চলবে। এ জন্য আমি দিইনি।’ স্ত্রীর সম্পদের ঘর এবার ফঁাকা দশম জাতীয় সংসদ নিবার্চনের আগে স্ত্রীর নামে দুই লাখ ৮০ হাজার টাকার সম্পদ থাকার তথ্য দিয়েছিলেন জাতীয় পাটির্র প্রেসিডিয়াম সদস্য রাঙ্গা। তবে এবার স্ত্রীর আয় ও সম্পদের ঘর পুরো ফঁাকা রেখেছেন তিনি। গতবারের হলফনামার তথ্য অনুযায়ী, রাঙ্গার স্ত্রীর হাতে চার লাখ ২০ হাজার ৩২৪ টাকা, ব্যাংকে ১৫ লাখ ২০ হাজার টাকা, ১৭ লাখ ৯০ হাজার টাকা দামের বাস বা মোটরগাড়ি, ৬০ হাজার টাকা দামের গহনা, ৬০ হাজার টাকা দামের ইলেক্ট্রনিক সামগ্রী এবং ২০ হাজার টাকার আসবাবপত্র ছিল। এ ছাড়া স্ত্রীর নামে থাকা স্থাবর সম্পদের তালিকায় ৯৩ হাজার টাকা দামের কৃষিজমি এবং ১৬ লাখ টাকা দামের অকৃষিজমির তথ্য দিয়েছিলেন রাঙ্গা। হলফনামার তথ্য বাছাই ও মনোনয়নপত্র গ্রহণের বিষয়ে ইসির নিদের্শনায় বলা হয়েছিল, কোনো প্রাথীর্ আয়করদাতা হলে তিনি তার রিটানর্ ও সম্পদের বিবরণী দাখিল করলে হলফনামায় স্ত্রীর বা নিভর্রশীলদের আয় ও সম্পদের ঘরে বিস্তারিত তথ্য না দিলেও মনোনয়নপত্র গ্রহণযোগ্য হবে, কেননা আয়কর রিটানের্ই এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য থাকে। স্ত্রীর নামে সম্পদের ঘর ফঁাকা রাখার কারণ জানতে চাইলে মসিউর রহমান রাঙ্গা বলেন, ‘আমি নিয়ম মেনেই সব দিয়েছি। আমার মনোনয়নপত্র বৈধ ঘোষিত হয়েছে। কোনো সমস্যা থাকলে তো প্রশ্ন উঠত, বৈধ ঘোষণা হতো না। তা তো হয়নি’। রাঙ্গার সম্পদ বেড়ে দ্বিগুণ বতর্মান সরকারের প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনের পঁাচ বছরে মসিউর রহমান রাঙ্গার আয় বেড়েছে ছয়গুণ, আর সম্পদের পরিমাণ বেড়ে হয়েছে দ্বিগুণের বেশি। হলফনামা অনুযায়ী, মসিউর রহমান রাঙ্গার বাষির্ক আয় ৮৭ লাখ ৫৪ হাজার ২৫৫ টাকা। কৃষি, বাড়িভাড়া, ব্যবসা, চাকরি এবং অন্যান্য উৎস থেকে এই টাকা আয় হয় তার। দশম জাতীয় সংসদ নিবার্চনের আগে দেয়া হলফনামায় তার বাষির্ক আয় দেখানো হয়েছিল ১৪ লাখ আট হাজার ৩৪ টাকা। এই হিসাবে পঁাচ বছরে তার আয় বেড়ে ছয়গুণ হয়েছে। রাঙ্গা এবারের হলফনামায় পঁাচ কোটি ৬৩ লাখ ১৮ হাজার টাকার সম্পদের হিসাব দিয়েছেন। দশম জাতীয় সংসদ নিবার্চনের আগে তিনি দুই কোটি ৮০ লাখ ৫৯ হাজার টাকার তথ্য দিয়েছিলেন। অথার্ৎ, এ সময় তার সম্পদ বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। গত নিবার্চনের হলফনামায় রাঙ্গা পেশা হিসেবে শুধু পরিবহন ব্যবসার তথ্য দিয়েছিলেন। এবার পরিবহন ব্যবসা ছাড়াও ফিলিং স্টেশনের মালিকানা এবং কমিশন এজেন্ট হিসেবে ব্যবসা করার তথ্য দিয়েছেন তিনি। জাতীয় পাটির্র এই নেতার এক কোটি ৮৮ লাখ ৮৫ হাজার টাকার অস্থাবর সম্পদের মধ্যে ব্যাংকে জমা আছে ২৩ লাখ ১৪ হাজার ১২৪ টাকা এবং আর বৈদেশিক মুদ্রায় আছে তিন লাখ ৯৪ হাজার ৪২২ টাকা। স্থায়ী আমানত হিসেবে ৮৯ লাখ ৫৬ হাজার টাকার বিনিয়োগ রয়েছে তার। ২০১৪ সালের নিবার্চনের আগে এক কোটি ৯ লাখ ৪০ হাজার ৮৫৫ টাকার অস্থাবর সম্পদের মালিক ছিলেন মসিউর রহমান রাঙ্গা। যার মধ্যে ৯ লাখ ৪০ হাজার ৩৪২ টাকা নগদ, ৯০ লাখ ৫৮ হাজার ৭৩৪ টাকা ব্যাংকে এবং দুই লাখ ৮১ হাজার ৭৭৯ টাকা স্থায়ী আমানতে বিনিয়োগ হিসাবে ছিল। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি রাঙ্গা এবার জানিয়েছেন, তার মালিকানায় মোট ৬৪ লাখ টাকা দামের বাস ও মোটরগাড়ি রয়েছে। গতবারের হলফনামায় রাঙ্গার নামে তিন লাখ এবং স্ত্রীর নামে ১৭ লাখ ৯০ হাজার টাকা দামের যানবাহন থাকার তথ্য দেয়া হয়েছিল। পঁাচ বছরে এক লাখ ৭০ হাজার টাকার ইলেকট্রনিক্স সামগ্রী এখন বেড়ে পঁাচ লাখ ৯০ হাজার টাকার হয়েছে। তবে আগের মতই ১৬ হাজার টাকার স্বণার্লঙ্কার, এক লাখ ২০ হাজার টাকার আসবাবপত্র এবং ৫৪ হাজার টাকার অন্যান্য অস্থাবর সম্পত্তি থাকার তথ্য দিয়েছেন তিনি। হলফনামা অনুযায়ী, রাঙ্গা এখন তিন কোটি ৭৪ লাখ ৩২ হাজার টাকার স্থাবর সম্পদের মালিক। পঁাচ বছর আগে যা ছিল এক কোটি ৭১ লাখ ১৮ হাজার টাকা। বতর্মানে ৮৬ লাখ ১৬ হাজার ৭০০ টাকার কৃষি ও ৫৯ লাখ চার হাজার ৪৬৩ টাকার অকৃষিজমি, এক কোটি ৪৫ লাখ ৩৬ হাজার ৩৩০ এবং ৭৩ লাখ ৬২ হাজার ৭৮২ টাকা দামের দুটি দালান এবং ১০ লাখ ১২ হাজার ৫০০ টাকার ফিলিং স্টেশনের মালিক তিনি। দশম জাতীয় সংসদ নিবার্চনের আগে দেয়া হলফনামায় ছয় লাখ ৭৫ হাজার টাকার কৃষিজমি, ছয় লাখ ৩৬ হাজার ৫০০ টাকার অকৃষিজমি, এক কোটি ১৫ লাখ ১০ হাজার ৫৭৪ টাকার দালান এবং ৪২ লাখ ৯৬ হাজার ১৯০ টাকার বাড়ি দেখিয়েছিলেন রাঙ্গা। আয় আর সম্পদের সঙ্গে দায়ও বেড়েছে এই সাংসদের। বতর্মানে ৯৩ লাখ ৫৩ হাজার ৪১৫ টাকার ব্যাংক ঋণ রয়েছে তার। যা পঁাচ বছর আগে ছিল ৭৩ লাখ ২৪ হাজার ৩১৬ টাকা।