'রাজস্ব হারানোর অজুহাতে তামাকে কর বাড়ে না'

প্রাক-বাজেট সংবাদ সম্মেলনে বক্তারা

প্রকাশ | ১৮ মে ২০২২, ০০:০০

ম যাযাদি রিপোর্ট
রাজস্ব হারানোর অজুহাতে তামাকে শক্তিশালী কর কাঠামো নীতি বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না বলে অভিযোগ করে তামাকবিরোধী সংগঠনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, তামাক উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো সরকারকে রাজস্ব হারানোর 'জুজুর ভয়' দেখানোর চেষ্টা করে। যে কারণে তামাকে কর বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। আর এভাবে চলতে থাকলে ২০৪০ সালের মধ্যে তামাক নিয়ন্ত্রণে প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যেতে পারে। মঙ্গলবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে গবেষণা ও অ্যাডভোকেসি প্রতিষ্ঠান প্রজ্ঞা (প্রগতির জন্য জ্ঞান) এবং অ্যান্টি টোব্যাকো মিডিয়া এলায়েন্স আত্মা আয়োজিত 'কেমন তামাক কর চাই' শীর্ষক প্রাক-বাজেট সংবাদ সম্মেলনে বক্তারা এসব কথা বলেন। তারা বলেন, ব্যবসার প্রসার এবং তামাক পণ্যের ওপর সরকার যাতে কর বাড়াতে না পারে সে জন্য তামাক কোম্পানিগুলো নানাভাবে প্রভাব বিস্তার করছে। এদিকে রাজস্ব হারানো ও রাজস্ব ফাঁকির ভয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) তামাকের কর কাঠামোয় পরিবর্তন করে না। অথচ জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের ওপর তামাক ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার করছে। এদিকে, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, দেশে প্রতিনিয়ত চাল, ডাল, তেলসহ নিত্যপণ্যের দাম বাড়ানো হলেও তামাকজাত পণ্যের ওপর সেই হারে দাম বাড়ানো হয়নি। এতে উপেক্ষিতই থেকে যাচ্ছে জনস্বাস্থ্যের বিষয়টি। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ জাতীয় তামাকবিরোধী মঞ্চের আহ্বায়ক ডক্টর কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ। এ সময় তিনি বলেন, তামাক নিয়ন্ত্রণে আমরা যখন জোর দাবি জানাচ্ছি, তখন তামাক কোম্পানিগুলোও আরও তৎপর হয়ে উঠেছে। তারা সরকারকে রাজস্ব হারানোর ভয় দেখাচ্ছে। তামাক নিয়ন্ত্রণে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা থাকার পরও সরকারের নীতিনির্ধারকরা যথাযথভাবে কাজ করছে না। কারণ তামাকে নীতিনির্ধারকদেরও স্বার্থ জড়িত রয়েছে। তিনি আরও বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৬ সালে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার কৌশল হিসেবে তামাকের ওপর বিদ্যমান তামাক কর কাঠামো সহজ করে একটি শক্তিশালী তামাক করনীতি গ্রহণের নির্দেশনা প্রদান করেছেন। কিন্তু ৬ বছর পেরিয়ে গেলেও সেই নির্দেশনা বাস্তবায়নে কোনো পদক্ষেপই গ্রহণ করা হয়নি। অথচ কার্যকরভাবে করারোপের অভাবে বাংলাদেশে তামাকপণ্য অত্যন্ত সস্তা এবং সহজলভ্য হয়ে যাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, তামাক নিয়ন্ত্রণে কৃষক পর্যায়ে তামাক চাষ বন্ধ করতে হবে। কৃষকরা যেন তামাক পণ্য চাষে অনুৎসাহিত হন, সে জন্য আমাদের কাজ করতে হবে। ক্যাম্পেইন ফর টোব্যাকো ফ্রি কিডস (সিটিএফকে) বাংলাদেশের লিড পলিসি অ্যাডভাইজর মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, তামাক কোম্পানিগুলো সরকারকে রাজস্ব হারানোর ভীতি, জুজুর ভয় দেখানোর চেষ্টা করে। কিন্তু উল্টো তামাকের প্রভাবে আমরা তার চেয়েও বেশি পরিমাণ ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ডক্টর রুমানা হক বলেন, তামাকের চাহিদা ও যোগান কমানোর সবচেয়ে বড় কৌশল সঠিকভাবে তামাকের ওপর করারোপ করে সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে নিয়ে যাওয়া। কিন্তু সমস্যা হলো কৌশলগত আমরা কর বসাতে পারছি না। যে কারণে তামাক নিয়ন্ত্রণেও আসছে না। তিনি আরও বলেন, তামাক করের বড় অংশ সিগারেট থেকে পাই, কিন্তু ধোঁয়াহীন তামাক এর বাইরে থেকে যায়। তাই আমাদের সেদিকেও নজর দিতে হবে। শুধু কাগজে-কলমে নয়, যথাযথভাবে কর আহরণ করাও নিশ্চিত করতে হবে। সংবাদ সম্মেলনে আসন্ন ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে নিম্ন স্তরে প্রতি ১০ শলাকা সিগারেটের খুচরা মূল্য ৫০ টাকা নির্ধারণ করে ৩২.৫০ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক আরোপ, মধ্যম স্তরে ১০ শলাকা সিগারেটের খুচরা মূল্য ৭৫ টাকা নির্ধারণ করে ৪৮.৭৫ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক আরোপ, উচ্চ স্তরে ১০ শলাকা সিগারেটের খুচরা মূল্য ১২০ টাকা নির্ধারণ করে ৭৮ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক আরোপ এবং প্রিমিয়াম স্তরে প্রতি ১০ শলাকা সিগারেটের খুচরা মূল্য ১৫০ টাকা নির্ধারণ করে ৯৭.৫০ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা। পাশাপাশি মধ্য মেয়াদে (২০২২-২৩ থেকে ২০২৭-২৮) সিগারেটের মূল্য স্তরের সংখ্যা ৪টি থেকে ২টিতে নামিয়ে আনার সুপারিশ করা হয়। এ ছাড়াও ফিল্টারবিহীন ২৫ শলাকা বিড়ির খুচরা মূল্য ২৫ টাকা নির্ধারণ করে ১১.২৫ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক আরোপ এবং ফিল্টারযুক্ত ২০ শলাকা বিড়ির খুচরা মূল্য ২০ টাকা নির্ধারণ করে ৯.০০ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক আরোপের প্রস্তাব করা হয়। প্রতি ১০ গ্রাম জর্নার খুচরা মূল্য ৪৫ টাকা নির্ধারণ করে ২৭.০০ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক আরোপ এবং প্রতি ১০ গ্রাম গুলের খুচরা মূল্য ২৫ টাকা নির্ধারণ করে ১৫.০০ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক আরোপের প্রস্তাব করা হয়। এছাড়া সব তামাকপণ্যের খুচরা মূল্যের ওপর ১৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) এবং ১ শতাংশ স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জ বহাল রাখার প্রস্তাব করা হয়। বক্তারা জানান, উলিস্নখিত তামাক-কর ও মূল্য বৃদ্ধির প্রস্তাব বাস্তবায়ন করা হলে প্রায় ১৩ লাখ প্রাপ্তবয়স্ক ধূমপান থেকে বিরত থাকতে উৎসাহিত হবে, দীর্ঘমেয়াদি ৪ লাখ ৪৫ হাজার প্রাপ্তবয়স্ক এবং ৪ লাখ ৪৮ হাজার তরুণ জনগোষ্ঠীর অকাল মৃতু্য রোধ করা সম্ভব হবে এবং সিগারেট খাত থেকে সরকারের ৯ হাজার ২০০ কোটি টাকা অতিরিক্ত রাজস্ব আয় হবে। সংবাদ সম্মেলনে সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি)-এর রিসার্চ ফেলো সৈয়দ ইউসুফ সাদাত, আত্মার কনভেনর মর্তুজা হায়দার লিটন এবং প্রজ্ঞার নির্বাহী পরিচালক এবিএম জুবায়েরসহ বিভিন্ন তামাকবিরোধী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ বক্তব্য রাখেন।