বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১
যশোর জেলা বিএনপি

'হামলা-মামলা' সঙ্গী করে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা

ব্রিটিশ ভারতের প্রথম জেলা এবং দেশের প্রথম শত্রম্নমুক্ত জেলা যশোর। ইতিহাস, ঐতিহ্যের পাশাপাশি রাজনীতিতেও সমৃদ্ধ এই জেলা। আওয়ামী লীগ, বিএনপি যে দলই সরকার গঠন করুক; এই জেলার ৬টি আসনই তাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। প্রত্যেক সরকারের মন্ত্রিপরিষদে যশোরের প্রতিনিধিত্ব থাকে। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে যশোরের রাজনীতিতেও নানা মেরুকরণ হচ্ছে। আওয়ামী লীগের টার্গেট গ্রম্নপিং-লবিং সরিয়ে ঘর গোছানো; আর 'হামলা-মামলা' সঙ্গে নিয়ে বিএনপির সংগ্রাম ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য। যশোরের আওয়ামী লীগ-বিএনপি নিয়ে রাজনৈতিক প্রতিবেদন তৈরি করেছেন যশোরের স্টাফ রিপোর্টার মিলন রহমান
নতুনধারা
  ২০ মে ২০২২, ০০:০০

এক যুগেরও বেশি সময় অতিবাহিত হলেও সম্মেলনের দেখা মেলেনি যশোর জেলা বিএনপিতে। আহ্বায়ক কমিটিতেই পার হয়ে গেছে তিন বছর। তবে নেতৃবৃন্দ বলছেন, একেবারে তৃণমূল পর্যায় থেকে নেতাকর্মীদের সংগঠিত করে প্রতিটি ইউনিটের কমিটি করা হচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় দ্রম্নততম সময়ের মধ্যে জেলা সম্মেলন ও কমিটি গঠন করা হবে। শক্তিশালী সাংগঠনিক ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আন্দোলন সংগ্রামে রাজপথে থাকবে জেলা বিএনপি। যদিও 'হামলা-মামলায়' জেরবার যশোর জেলা বিএনপি। নেতাকর্মীদের রাজপথে কতটুকু ধরে রাখতে পারবে তা নিয়ে দলের মধ্যেই সংশয় রয়েছে। যশোরে 'সরকারবিরোধী ষড়যন্ত্র, নাশকতা, হামলা' ইত্যাদি অভিযোগে বিএনপি নেতাকর্মীদের নামে ৮ শতাধিক মামলা রয়েছে। আর এসব মামলায় আসামির সংখ্যা ৫ সহস্রাধিক।

যশোর জেলা বিএনপি সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, সর্বশেষ ২০০৯ সালে যশোর জেলা বিএনপির কমিটি গঠন করা হয়। ১৪০ সদস্যবিশিষ্ট কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন প্রয়াত শহিদুল ইসলাম নয়ন ও সাধারণ সম্পাদক হন অ্যাডভোকেট সৈয়দ সাবেরুল হক সাবু। প্রায় দশ বছর ওই কমিটি বহাল থাকা অবস্থায় দলীয় সভাপতি শহিদুল ইসলাম নয়নসহ কমিটির ১৮ সদস্য মৃতু্যবরণ করেন। বহিষ্কার হন ৩ জন।

দীর্ঘদিন সম্মেলন না হওয়ায় এবং সাংগঠনিক ভীত দুর্বল হয়ে পড়ায় ২০১৯ সালে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা কমিটি ভেঙে দেয়ার দাবি তোলেন। সে সময় তৃণমূল নেতাকর্মীরা অভিযোগ করেছিলেন, দীর্ঘ এক দশক জেলা কমিটির সম্মেলন না হওয়ার কারণে যশোরে সরকার বিরোধী আন্দোলন হয়নি। কোনো মিছিল-মিটিং ছিল না বললেই চলে। বেশির ভাগ নেতারা মামলার ভয়ে নিজেদেরকে আড়াল করে রেখেছেন।

এর প্রেক্ষিতে ২০১৯ সালের ২০ এপ্রিল যশোর জেলা বিএনপির কমিটি বিলুপ্ত করে আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির আহ্বায়ক হন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সাবেক মন্ত্রী প্রয়াত তরিকুল ইসলামের স্ত্রী নার্গিস বেগম এবং সদস্য সচিব হন বিলুপ্ত জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ সাবেরুল হক সাবু। ৫৩ সদস্যের এই আহ্বায়ক কমিটিকে তিন মাসের মধ্যে সম্মেলনের মাধ্যমে জেলা কমিটি গঠনের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কেন্দ্র থেকে ২০১৯ সালের ৯ মে এই কমিটির অনুমোদন দেওয়া হয়।

কিন্তু তিন মাসের দায়িত্ব পাওয়া কমিটি তিন বছরেও জেলা সম্মেলন করতে পারেনি। তবে এর মধ্যে করোনাকালের দু'বছরও রয়েছে। দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা বলছেন, একেবারে তৃণমূল পর্যায় থেকে নেতাকর্মীদের সংগঠিত করে প্রতিটি ইউনিটের কমিটি করা হচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় দ্রম্নততম সময়ের মধ্যে জেলা সম্মেলন ও কমিটি গঠন করা হবে।

বিএনপির খুলনা বিভাগীয় ভারপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক তরিকুলপুত্র অনিন্দ্য ইসলাম অমিত বলেন, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নেতৃত্বে সারাদেশে বিএনপিকে পুনর্গঠিত করা হচ্ছে। এর অংশ হিসেবে যশোরেও বিএনপি এবং অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলো পুনর্গঠন করা হচ্ছে। এই পুনর্গঠন কার্যক্রম একেবারে তৃণমূল থেকে করা হচ্ছে। ওয়ার্ড পর্যায়ে প্রাথমিক সদস্য সংগ্রহ করে যাচাই-বাছাই করে সম্মেলন ও নির্বাচনের মাধ্যমে ওয়ার্ড কমিটি; একইভাবে ইউনিয়ন কমিটি গঠন করা হচ্ছে। ধারাবাহিকভাবে থানা ও জেলা কমিটি গঠন করা হবে।

অনিন্দ্য ইসলাম অমিত আরও বলেন, ঘরে বসে বা পকেট কমিটি গঠন করতে সময় লাগে না। কিন্তু বিএনপি গণতন্ত্রের চর্চা করে তৃণমূল থেকে নেতৃত্ব নির্বাচন করছে। ফলে সময় একটু বেশি লাগলেও তৃণমূল থেকে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে নেতৃত্ব মনোনীত হওয়ায় সংগঠন শক্তিশালী হচ্ছে।

আর দলীয় কর্মসূচি বা সম্মেলন করতে গিয়ে প্রতিনিয়ত হামলা, মামলা, হুমকি ও প্রশাসনিক বাধার মুখোমুখি হতে হচ্ছে উলেস্নখ করে অনিন্দ্য ইসলাম অমিত বলেন, সম্মেলন বা কর্মসূচিতে প্রশাসনিক অনুমতি দেওয়া হয় না; ভেনু্য নির্ধারণে বাধা দেওয়া হয়। আর হামলা, মামলা তো রয়েছেই।

যশোর জেলা বিএনপির সদস্য সচিব সাবেক সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট সৈয়দ সাবেরুল হক সাবু বলেন, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় প্রত্যেক ইউনিটের কমিটি গঠন করে আসতে সময় লাগছে। এজন্য কেন্দ্র থেকে সময়ও বৃদ্ধি করা হয়েছে। আগামী জুলাইয়ের মধ্যে জেলা সম্মেলন করে কমিটি গঠন সম্ভব হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।

এদিকে, দীর্ঘদিন বিএনপিতে বিরোধ বা গ্রম্নপিংয়ের অস্তিত্ব থাকলেও এখন সেটি অনেক কমে এসেছে। দলীয় সূত্র মতে, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সাবেক মন্ত্রী তরিকুল ইসলামের জীবদ্দশায় যশোর জেলা বিএনপিতে দুটি ধারার অস্তিত্ব ছিল। একটি তরিকুল ইসলাম পক্ষের, অন্যটি তার বিরোধী শিবির। এই পক্ষের নেতৃত্বে তার ভাইপো যশোর পৌরসভার সাবেক মেয়র এবং নগর বিএনপির সভাপতি মারুফুল ইসলাম। তরিকুল ইসলামের মৃতু্যর পর তরিকুল পক্ষের নেতৃত্বে আসেন প্রয়াত তরিকুল ইসলামের সহধর্মিণী অধ্যাপক নার্গিস বেগম ও ছেলে কেন্দ্রীয় বিএনপি নেতা অনিন্দ্য ইসলাম অমিত। তবে অনিন্দ্য ইসলাম অমিত কেন্দ্রীয় বিএনপির খুলনা বিভাগীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক (পরবর্তীতে ভারপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক) হওয়ার পর ঘর গোছানোয় মনোনিবেশ করেন। এর প্রেক্ষিতে নামে বিএনপিতে 'মারুফ পক্ষ' থাকলেও এই পক্ষে নেতাকর্মীদের সংখ্যা অনেক কম।

গ্রম্নপিং প্রসঙ্গে অনিন্দ্য ইসলাম অমিত বলেন, জেলা বিএনপিতে কোনো গ্রম্নপিং নেই। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নেতৃত্বে দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে জেলা বিএনপি ঐক্যবদ্ধ।

এদিকে বিএনপি সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, হামলা-মামলায় জেরবার অবস্থা জেলা বিএনপির। গত দশ বছরে হামলা মামলার শিকার হয়ে অনেক নেতাকর্মীই রাজপথ ত্যাগে বাধ্য হয়েছেন। বিএনপির ভাষায় যশোরে 'সরকারবিরোধী ষড়যন্ত্র, নাশকতা, হামলা ইত্যাদি নাম দিয়ে গায়েবি মামলা' হয়েছে ৮ শতাধিক। এসব মামলায় আসামির সংখ্যা ৫ হাজারের বেশি।

যশোর জেলা বিএনপির সদস্য সচিব সাবেক সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট সৈয়দ সাবেরুল হক সাবু বলেন, প্রশাসনিক বাধা, হামলা, মামলা দিয়ে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও প্রশাসন বিএনপি নেতাকর্মীদের দমিয়ে রাখার চেষ্টা করছে। জেলায় ৮ শতাধিক 'গায়েবি' মামলায় ৫ হাজারের বেশি নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়েছে। মণিরামপুরে বিএনপির এক নেতার নামে ১০৩টি মামলা রয়েছে।

হামলা-মামলা প্রসঙ্গে বিএনপির খুলনা বিভাগীয় ভারপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক অনিন্দ্য ইসলাম অমিত বলেন, তার নিজের নামে ৪৫টির বেশি মামলা রয়েছে। দলের এমন কোনো নেতা নেই যার নামে ২০/২৫টি মামলা নেই। তবে গত ১৩ বছরে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও প্রশাসনের সীমাহীন অত্যাচার নির্যাতন নিপীড়নেও বিএনপির একটি নেতাকর্মীও দল ছেড়ে যায়নি। বরং দৃঢ়তার সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। এই ঐক্যবদ্ধ নেতাকর্মীদের শক্ত সাংগঠনিক ভিত্তির উপর নিয়ে এসে যশোরের রাজপথে বিএনপি কঠোর আন্দোলন সংগ্রাম গড়ে তুলবে বলে আশাবাদ ব্যক্তি করেন তিনি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে