শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বজ্রপাতে ৮৬ শতাংশ মৃতু্য হয় ফসলের মাঠে

হ নিহতদের ৭০ শতাংশ কৃষক ও জেলে হ তালগাছ রোপণ প্রকল্প বাতিল হ ভাবা হচ্ছে আর্লি ওয়ার্নিংয়ের কথা
আলতাব হোসেন
  ২৫ মে ২০২২, ০০:০০

বজ্রপাতের সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তন ও উষ্ণায়নের সম্পর্ক রয়েছে। এপ্রিল থেকে জুন মাস পর্যন্ত তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়। এ সময় অসহনীয় গরমে বজ্রপাতের আশঙ্কা ১২ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। তাপমাত্রা বৃদ্ধি, বাতাসে সিসার পরিমাণ বাড়া, অধিক ধাতব পদার্থের ব্যবহার, মোবাইল ফোনের অতি ব্যবহার, মোবাইল ফোনের টাওয়ারের সংখ্যার আধিক্য, বনভূমি বা গ্রামাঞ্চলে উঁচু গাছের সংখ্যা কমে যাওয়া, জলাভূমি ভরাট ও নদী শুকিয়ে যাওয়ার কারণে বজ্রপাতের সংখ্যা বাড়ছে। বজ্রপাতে ৮৬ শতাংশ মৃতু্য হয় ফসলের মাঠে। এতে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের ৭০ শতাংশ কৃষক ও জেলে।

জাপানের জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সিস্টেমে দেখে গেছে, বজ্রপাতে বেশি মানুষ মারা যায় বাংলাদেশের ঠাকুরগাঁও, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, লালমনিরহাট, বগুড়া, ফরিদপুর, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জ জেলায়। নিহতদের মধ্যে কৃষক ও জেলের সংখ্যাই বেশি। মাঠে ফসলের ক্ষেতে কাজ করা বা মাছ ধরার সময় বেশি মানুষ মারা যাচ্ছেন বজ্রপাতে।

অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীদের গবেষণায় দেখা যায়, দেশে সারা বছরে যত বজ্রপাত হয় তার অর্ধেকেরও বেশি এপ্রিল থেকে মে মাসের মধ্যে। আর এককভাবে মে মাসে হয় মোট বজ্রপাতের ২৭ শতাংশ। দেশে বর্ষা আসার আগের এই সময় কৃষকেরা মাঠে ব্যস্ত থাকেন। দেশে বজ্রপাতে মৃতু্যর ৮৬ শতাংশ ঘটনা ঘটে কৃষিকাজ করার সময়। এছাড়া বাড়ি ফেরার পথে ৬ শতাংশ এবং গোসল করা ও মাছ ধরার সময় ৮ শতাংশ মৃতু্যর ঘটনা ঘটে। বজ্রপাত প্রতিরোধে শহরের বেশির ভাগ ভবনে প্রতিরোধক দন্ড থাকায় মানুষের মৃতু্য অনেক কম। কিন্তু গ্রামে বিশেষ করে ফসলের মাঠে বা হাওড়াঞ্চলে বড় গাছ নেই। বৃক্ষহীন হাওড় এলাকায় কৃষকের শরীরই মাটির ওপর থাকে, তাই মৃতু্য হয় বেশি।

দেশে প্রতি বছর গড়ে ২ হাজার ৪০০ বজ্রপাতের ঘটনা ঘটে। আগে তালগাছ বজ্রপাত ঠেকাত। এখন তালগাছ ও উঁচু গাছ নেই। বিশ্বে বছরে বজ্রপাতে যত মানুষ মারা যাচ্ছে, তার অর্ধেকই বাংলাদেশে। বজ্রপাতে বিপুলসংখ্যক গাছপালা ও গবাদিপশু মারা যায়। মৃতু্যর চেয়ে বেশি মানুষ আহত হন। আহতদের চিকিৎসা বা ওষুধ নেই দেশের হাসপাতালগুলোতে। বজ্রপাতে একজনের মৃতু্য হলে অন্তত দশ থেকে পনেরজন আহত হয়ে থাকেন। আহতদের প্রতিবন্ধী জীবনযাপন করতে হয়। বজ্রপাতকে আবহাওয়া সম্পর্কিত দ্বিতীয় বৃহত্তম ঘাতক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে একটি অস্বাভাবিক বছর ছিল ২০১৬ সাল। ওই বছর প্রায় ৪৩ লাখ বজ্রপাত হয়। মারা যায় ২৬৩ জন মানুষ।

বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে বাংলাদেশে দশমিক ৭৪ শতাংশ তাপমাত্রা বেড়েছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্যই বাড়ছে বজ্রপাত। এপ্রিল থেকে জুনের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত সিলেটের হাওর অঞ্চল, যশোর ও সিরাজগঞ্জ এলাকায় জলীয় বাষ্প বেশি থাকে। তাই এই সময়টায় এসব অঞ্চলে বেশি বজ্রপাত হয়।

বর্ষা আসার আগমুহূর্তে মে মাস থেকে তাপমাত্রা বাড়তে থাকে। এ সময় আসে কালবৈশাখী ঝড়। ঝড়ের এই সময় বেশি বজ্রপাত ঘটে। বায়ুদূষণ, নিরোধক প্রস্তুতি ও সচেতনতার অভাবে বজ্রপাতে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি মানুষের মৃতু্য হচ্ছে বাংলাদেশে। বাংলাদেশে বজ্রপাতকে জাতীয় দুর্যোগ ঘোষণা করা হয়েছে। বজ্রপাতপ্রবণ এলাকায় এক কোটি তালগাছ লাগিয়ে ঠেকানোর পরিকল্পনা নেওয়া হলেও তা কার্যকর হয়নি। কোথাও কোথাও তাল গাছের চারা ও বীজ রোপণ করা হলেও তা রক্ষণাবেক্ষণ না করায় গরু-ছাগলে তা খেয়ে নিয়েছে। রাস্তা সম্প্রসারণের নামে তালগাছসহ বড় বড় গাছ কাটা হচ্ছে।

পরিবেশ বিশেষজ্ঞ ডক্টর মঞ্জুরুল হান্নান জানান, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব ছাড়াও ভৌগোলিক অবস্থান, উঁচু গাছ কাটা, পাহাড় কাটাসহ নানা কারণে দেশে প্রতি বছরই বজ্রপাত আতঙ্ক দেখা দিচ্ছে। বজ্রপাতে মৃতু্য রোধে আগাম সতর্কতার জন্য লাইটনিং ডিটেকটিভ সেন্সর বসানোসহ নানা উদ্যোগের পরও কমছে না মৃতু্য। মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি না পেলে মৃতু্য আরও বাড়বে। সরকার ২০ কোটি টাকা ব্যয়ে আট জেলায় বজ্রপাতের গতি-প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ যন্ত্রস্থাপন করছে। দক্ষ জনবলের অভাবে যা কাজে আসছে না। জেলেদের জন্য ছাউনি ও উপকূলীয় এলাকায় বজ্রপাত নিরাপদ আশ্রয় কেন্দ্র করার করার কথা থাকলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি।

এ বিষয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান বলেন, বজ্রপাত ঠেকাতে সারাদেশে এক কোটি তালগাছের চারা লাগানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। ২০১৭ সালে ৩৮ লাখ তালগাছ লাগানোর পর দেখা যায়, তালগাছের চারা রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে গরু-ছাগল খেয়ে নিয়েছে। নিয়মিত যত্ন না নেওয়ার কারণেও অনেক গাছ নষ্ট হয়। একটি তালগাছ বড় হতে ৪০ থেকে ৫০ বছর পর্যন্ত সময় লাগে। এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। তাই তালগাছ লাগানোর প্রকল্প বাতিল করা হয়েছে। বজ্রপাতে প্রাণহানি কমাতে লাইটনিং অ্যারেস্টার স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। মৃতু্য কমাতে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে প্রচারণা ও আর্লি ওয়ার্নিং সিস্টেম চালু করা হবে।

ডিজাস্টার ফেরামের তথ্য মতে, চলতি ২০২২ সালের ২০ মে পর্যন্ত বজ্রপাতে মৃতু্য হয়েছে ৫৪ জনের। ২০২১ সালে ২৭২ জনের মৃতু্য হয়। এর মধ্যে শিশু ৫৪ জন, নারী ৩৯ এবং পুরুষ ১৭৯ জন। ২০২০ সালে মারা যান ৩৮০ জন। এর মধ্যে শিশু ৮০, নারী ২৯, এবং পুরুষ ২৭১ জন। ২০১৯ সালে সারাদেশে নিহত হন ২৪৬ জন। বজ্রপাতে সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি ঘটে ২০১৮ সালে। ওই বছর মারা যান ৩৫৯ জন। ২০১৭ সালে মারা যান ৩০১ জন। ২০১৬ সালে মৃতের সংখ্যা ছিল ২৬৩। এছাড়া ২০১৫ সালে ১৬০, ২০১৪ সালে ১৭০, ২০১৩ সালে ১৮৫, ২০১২ সালে ২০১, ২০১১ সালে ১৭৯ এবং ২০১০ সালে ১২৩ জনের মৃতু্য ঘটে বজ্রপাতে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে