আসছে বাজেট

স্বস্তি দিতে ভর্তুকি নির্ভরতা

প্রকাশ | ২৬ মে ২০২২, ০০:০০ | আপডেট: ২৬ মে ২০২২, ০৯:১৯

আহমেদ তোফায়েল

যুদ্ধের ডামাঢোলে অনেকটাই টালমাটাল বিশ্ব অর্থনীতি। যার প্রভাব পড়েছে দেশের জিনিসপত্রে। এমন বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে সরকারকে হাঁটতে হচ্ছে বড় ব্যয়ের পথে। দিতে হচ্ছে বড় বাজেট। যার মধ্যে দিয়ে অর্থনীতির আকার বাড়াতে চায় সাড়ে সাত শতাংশ হারে। লক্ষ্য অচেনা চ্যালেঞ্জের সঙ্গে নিজেদের খাপ খাওয়ানো। সরকার যখন তার তৃতীয় মেয়াদের বাজেট দিচ্ছে তার আগেই বাড়তি জ্বালানি, সার আর জিনিসপত্রের দাম। তাই জনগণকে কিছুটা স্বস্তি দিতে নির্ভরতা বাড়ছে ভর্তুকির ওপর। ভর্তুকি বাড়ছে আগের চেয়েও প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকা। সুবিধাবঞ্চিত মানুষের জন্য বাড়াতে হচ্ছে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতাও। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডির) সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান যায়যায়দিনকে বলেন, নতুন যে চ্যালেঞ্জগুলো অর্থনীতিতে যোগ হয়েছে বাজেটে তার একটি প্রতিফলন থাকতে হবে। এবং তা থাকতে হবে ভর্তুকি ব্যবস্থাপনায়। সরকারের ব্যয়ের মধ্যে এটি থাকবে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার চেষ্টায় সরকার আগামী অর্থবছরের জন্য ৮২ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকার ভর্তুকি প্যাকেজ দিতে যাচ্ছে। যা আগের অর্থ বছরের ৬৬ হাজার ৮২৫ কোটি টাকার চেয়ে ২১ দশমিক ১ শতাংশ বেশি। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাবে গত মার্চে তেলের দাম ১৪ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে এবং সার ও প্রাকৃতিক গ্যাস রেকর্ড দামে গিয়ে ঠেকে। এমন পরিস্থিতিতে ভর্তুকির জন্য বরাদ্দ বাড়ানো ছাড়া সরকারের আর কোনো উপায় নেই বলে মনে করেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সিপিডির বিশিষ্ট ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা এমনিতেই কমে গেছে। এ বছরটাকে ব্যতিক্রম হিসেবেই দেখতে হবে। কারণ, আন্তর্জাতিক বাজারের এমন অস্থিতিশীল পরিস্থিতি খুব বেশি দিন থাকবে না।' আগামী অর্থবছরে সবচেয়ে বেশি ভর্তুকি বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে বিদু্যৎ উৎপাদনে। বিদু্যতে ভর্তুকি দেওয়া হবে ১৮ হাজার কোটি টাকা, যা এই খাতে আগামী অর্থবছরের মূল বাজেটের দ্বিগুণ এবং সংশোধিত বাজেট থেকে ৫০ শতাংশ বেশি। সারেও পর্যাপ্ত ভর্তুকি দিচ্ছে সরকার। এই খাতে ভর্তুকি দিতে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরের মূল বাজেটের চেয়ে এর পরিমাণ ৫৭ দশমিক ৯ শতাংশ এবং সংশোধিত বাজেটের চেয়ে ২৫ শতাংশ বেশি। তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস ও তেল আমদানির পাশাপাশি সরকারের কর্মকর্তা কর্মচারীদের বেতনের জন্য ভর্তুকি এই বছরের মূল বাজেট থেকে প্রায় ৬৮ শতাংশ বেড়ে ১৭ হাজার ৩০০ কোটি টাকায় দাঁড়াবে। এত ভর্তুকির পরেও তা মুদ্রাস্ফীতির লাগাম টানতে এবং সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ কমাতে যথেষ্ট নাও হতে পারে। এ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হুসেইন মনে করেন, তেল, সার, গ্যাস ও বিদু্যতের উচ্চমূল্য এবং মূল্যস্ফীতির প্রভাব পুরোপুরি কমানোর জন্য ভর্তুকি বরাদ্দ যথেষ্ট নয়। তেল, গ্যাস ও সারের দাম সহজে কমবে না, তবে এগুলোর দাম আরও বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও খুব বেশি নেই বলে মনে করেন তিনি। জাহিদ হুসেইন আরও বলেন, বিদ্যমান অনিশ্চয়তা অব্যাহত থাকলে সরকার দাম কমিয়ে রাখতে পারবে না। তখন মূল্য সমন্বয় করতেই হবে এবং মুদ্রাস্ফীতির চাপ থাকবে। তিনি জানান, সরকার রপ্তানি ভর্তুকি ও রেমিট্যান্সের জন্য ২ দশমিক ৫ শতাংশ নগদ প্রণোদনা প্রত্যাহার করে নিতে পারত। এতে মুদ্রাস্ফীতির চাপ কিছুটা নিয়ন্ত্রণে থাকত। এই ২ খাতে প্রায় ১৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে, যা মূল বাজেটের চেয়ে ৩৩ দশমিক ৯ শতাংশ বেশি। জাহিদ হুসেইন বলেন, 'রেমিট্যান্সের জন্য নগদ ভর্তুকির কোনো প্রয়োজন নেই। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ডলারের অফিসিয়াল বিনিময় হার ও হুন্ডি বাজারের হারের মধ্যে প্রায় ৫ টাকার পার্থক্য হয়ে গেছে। যা অফিসিয়াল চ্যানেলের মাধ্যমে অর্থ প্রেরণের জন্য দেওয়া নগদ প্রণোদনার চেয়েও বেশি। তিনি বলেন, 'টাকার অনেক অবমূল্যায়ন হয়েছে। কাজেই বিনিময় হারটাও নমনীয় হতে হবে। জাহিদ হুসেইনের মতে, এতে করে সরকারি চ্যানেলের মাধ্যমে রেমিট্যান্স বাড়বে এবং আমদানিতে লাগাম টানা যাবে। রপ্তানিকারকরাও এতে করে উপকৃত হবেন, কারণ তারা তাদের ডলারের বিপরীতে বেশি পরিমাণে টাকা পাবেন। তিনি বলেন, রপ্তানিতে ভর্তুকির প্রয়োজন নেই। রপ্তানি ভর্তুকির পুরো বিষয়টি ছিল পণ্য ও দেশীয় বৈচিত্র্যকে উৎসাহিত করা। কিন্তু তা একেবারেই হয়নি। এটা প্রমাণ করে যে ভর্তুকি নীতি কার্যকর হয়নি। প্রশ্ন ওঠে, কেন আমরা সমস্যার মূলে পৌঁছাতে পারছি না এই ভর্তুকির অর্থ নগদ সহায়তা হিসেবে সমাজের সেই সব মানুষের কাছে যাওয়া প্রয়োজন- যাদের পক্ষে মুদ্রাস্ফীতির প্রভাব মোকাবিলা করা সম্ভব নয় বলে মনে করেন তিনি। তিনি বলেন, ভর্তুকি থেকে সবাই লাভবান হয়, কিন্তু মূল্যবৃদ্ধি সবাইকে সমানভাবে প্রভাবিত করে না। ধনীরা মূল্যবৃদ্ধির ধাক্কা সহজেই সামলে নিতে পারলেও দরিদ্র বা অর্থনৈতিকভাবে দুর্বলরা তা পারেন না। কৃত্রিমভাবে দাম কমানোর জন্য ভর্তুকি দেওয়ার পরিবর্তে সরকারকে দরিদ্র ও অর্থনৈতিকভাবে দুর্বলদের জন্য আয় সহায়তার জন্য ব্যয় করার সুপারিশ করেন এই অর্থনীতিবিদ। তিনি বলেন, এই নগদ অর্থ অবশ্যই মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের (এমএফএস) মাধ্যমে তাদের কাছে পৌঁছাতে হবে। সরকারের সহায়তা পাওয়ার ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত এটিই সবচেয়ে কার্যকর চ্যানেল হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। স্বল্পমূল্যে খাদ্যদ্রব্য বিতরণ কর্মসূচিতে অনেক অনিয়ম রয়েছে। যাদের এটা দরকার তারা সব সময় পায় না। এই খাতে প্রায় ৬ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে, যা মূল বাজেটের চেয়ে ২২ দশমিক ৬ শতাংশ বেশি। সব মিলিয়ে এবারে সাড়ে সাত শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটের আকার ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। এটি সরকারের ব্যয় পরিকল্পনা। আগামী ৯ জুন বাজেট প্রস্তাব জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করবেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।