নিজেই আদালতের রায় বানালেন বাউবি'র যুগ্ম পরিচালক

প্রকাশ | ২৬ মে ২০২২, ০০:০০

ম আরিফ আহমেদ সিদ্দিকী, পাবনা
জালিয়াতির নতুন পথ দেখিয়েছেন বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাউবি) যুগ্ম পরিচালক মনসুর আলম। সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন তার ছোটভাই মাহমুদ এ হাসান। আদালতের ভুয়া রায় বানিয়ে সরকারি চাকরির পাশাপাশি দীর্ঘদিন এলাকার মানুষকে নানাভাবে হয়রানি করে অন্যের জমি নিজের নামে বেহাত করে নিয়েছিলেন তিনি। দুর্নীতি দমন কমিশন, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন স্থানে অভিযোগ দেওয়ার পরও অজ্ঞাত কারণে বহালতবিয়তে রয়েছেন সরকারি এই প্রভাবশালী কর্মকর্তা। অন্যের জমি জাল জালিয়াতির অভিযোগের পাশাপাশি আদালতের রায় বানিয়ে এলাকার মানুষকে হয়রানি করার অভিযোগের প্রেক্ষিতে উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) আদালতের কাছে রায়ের বিষয়ে জানতে চান। আদালত সংশ্লিষ্ট দপ্তর ওই রায় ভুয়া ও জাল জালিয়াতি করা হয়েছে বলে সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। এদিকে অভিযোগ তদন্ত করে ঘটনার প্রমাণও পেয়েছেন স্থানীয় ভূমি কর্মকর্তা। অভিযুক্ত মনসুর আলমের বাড়ি পাবনার সাঁথিয়া উপজেলায়। জালিয়াতির ঘটনা প্রমাণিত হলেও তিনি চাকরিতে বহালতবিয়তে রয়েছেন। জালিয়াতির ঘটনায় অভিযুক্ত মনসুর আলমের শাস্তির দাবি জানিয়েছেন ভুক্তভোগী এলাকাবাসী। জালিয়াতি প্রমাণিত হওয়ার পরও, সব অভিযোগ অস্বীকার করে সংবাদ প্রকাশ না করার জন্য অনুরোধ জানিয়েছেন মনসুর আলম। মামলার আইনজীবী বলছেন, যেহেতু আদালতের রায় জালিয়াতি করার ঘটনা প্রমাণিত হয়েছে, সেক্ষেত্রে তার সর্বোচ্চ শাস্তি হওয়া উচিত। অভিযোগ, তদন্ত প্রতিবেদন, এলাকাবাসী ও পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার গোপালপুর গ্রামের বাসিন্দা মৃত রিয়াজ উদ্দিন শেখের ছেলে মনসুর আলম বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের যুগ্ম পরিচালক হিসেবে কর্মরত। ১৯৯৭ সালে তিনি চাকরিতে যোগদান করেন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, তিনি ও তার ভাই আদালতের রায় জালিয়াতি করে গ্রামের অন্তত দশ ব্যক্তির সাড়ে ১৮ বিঘা জমি দখলের অপচেষ্টা করেছেন। মামলা সূত্রমতে, ২০০৫ সালের ৩১ অক্টোবর পাবনা যুগ্ম জজ-২য় আদালতে ওই গ্রামের কয়েকজন সহ সরকারি বেশকিছু জমিতে নিজের স্বত্ব দাবি করে মামলা করেন মনসুর আলমের পিতা রিয়াজ উদ্দিন শেখ। ২০১৬ সালের শেষেরদিকে মারা যান রিয়াজ উদ্দিন। তদবিরের অভাবে ২০১৩ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর মামলাটি খারিজ করে দেন আদালত। অথচ একই মামলার বিষয়ে ২০০৮ সালের ৫ সেপ্টেম্বর মনসুর আলমদের পক্ষে আদালত ডিগ্রি দিয়েছে উলেস্নখ করে মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে একটি ভুয়া রায় তৈরি করেন মনসুর আলম ও তার ভাই মাহমুদ এ হাসান। ২০২১ সালের ২০ জুন সাঁথিয়া উপজেলা ভূমি অফিসে দাখিল করে জমি খারিজের আবেদন করেন মনসুর আলম গং। যেখানে বিবাদীদের অনেকের নাম আগের ওই মামলায় ছিল না, তাদের নামও ওই ভুয়া রায়ে বিবাদী হিসেবে উলেস্নখ করেন। আদালতের ওই ভুয়া রায় দেখে সেটি যাচাই বাছাই না করেই, ২০২১ সালের ৩১ মে মনসুর আলম ও মাহমুদ এ হাসান গংদের পক্ষে জমি খারিজের নির্দেশ দেন তৎকালীন অতিরিক্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত এসি ল্যান্ড ও সাঁথিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এস এম জামাল আহমেদ। এমন পরিস্থিতিতে জালিয়াতির ঘটনা জানতে পেরে জমির মালিকরা ভূমি কর্মকর্তার কাছে মনসুর আলমের খারিজ বাতিলের আবেদন করেন। তার প্রেক্ষিতে সাঁথিয়া উপজেলা সহকারি কমিশনার (ভূমি) মনিরুজ্জামান চলতি বছরের ১০ ফেব্রম্নয়ারি পাবনা আদালতের সরকারি কৌঁসুলির কাছে রায়ের বিষয়ে মতামত চেয়ে চিঠি দেন। ১৪ মার্চ সরকারি কৌঁসুলি ওই চিঠির জবাবে জানান ২০০৮ সালে এমন কোনো মামলার রায় হয়নি। বরং ওই মামলাটি ২০১৩ সাল পর্যন্ত চলমান থাকে এবং তদবিরের অভাবে খারিজ হয়ে যায় মনসুর গংদের বিপক্ষে। আদালতের নথি যাচাই-বাছাই ও তদন্তে মনুসর আলমদের দাখিল করা আদালতের রায়টি ভুয়া বলে নিশ্চিত হন এসি ল্যান্ড। তিনি মূলত জমি দখল করতে জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছিলেন। পরে চলতি বছরের ৩০ মার্চ মনসুর গংদের খারিজ বাতিল করে প্রতিবেদন দেন ভূমি কর্মকর্তা। মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের যুগ্ম পরিচালক মনসুর আলমের সঙ্গে। সব অভিযোগ অস্বীকার করেন। তদন্ত প্রতিবেদনে আদালতের রায় জালিয়াতির প্রমাণ মিলেছে তারপরও কেন অস্বীকার করছেন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, এসব মিথ্যা কথা, আমি কোনো ভুয়া রায় তৈরি করিনি। কে করেছে তাও জানি না। এখানে একটি রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র আমাদের বিরুদ্ধে কাজ করছে। তিনি ক্ষমতাসীন দলের জেলা পর্যায়ের বিভিন্ন নেতাদের নাম উলেস্নখ করে বলেন, তাদের সঙ্গে তার সুসম্পর্ক রয়েছে। সবাই তাকে চেনেন। মামলার আইনজীবী অ্যাডভোকেট সাজাদ ইকবাল লিটন বলেন, মনসুর আলম-মাহমুদ এ হাসান গং একটি চক্র। তারা জালিয়াতি করে এলাকার নিরীহ মানুষকে হয়রানি করেছেন। ইতোমধ্যে আদালত থেকে প্রমাণিত হয়েছে পুরো ঘটনা। সাঁথিয়া উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. মনিরুজ্জামান বলেন, আদালতে মামলা চলমান থাকা অবস্থায় মনসুর পক্ষ ২০০৮ সালের একটি ভুয়া রায় দাখিল করে প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছিলেন। আদালতের রায় জালিয়াতির প্রমাণ পাওয়ার পর তার খারিজ বাতিল করা হয়েছে।