শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে 'সতর্ক' মুদ্রানীতি ঘোষণা

হ বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধির সীমা কমানো হয়েছে হ নীতিনির্ধারণী সুদহার ৫% থেকে বাড়িয়ে ৫.৫০% শতাংশ করা হয়েছে হ পুঁজিবাজারকে স্থিতিশীল রাখতে সচেষ্ট থাকবে বাংলাদেশ ব্যাংক
যাযাদি রিপোর্ট
  ০১ জুলাই ২০২২, ০০:০০

টাকার বিপরীতে ডলারের মূল্য বেড়ে গেছে। পাশাপাশি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং নতুন করে করোনা প্রাদুর্ভাবের প্রভাব। সঙ্গে বিদু্যৎ ও জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে আছে তারও চাপ। এমন বাস্তবতায় মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে বৃহস্পতিবার আগামী অর্থবছরের (২০২২-২৩) জন্য নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বিকাল ৩টায় বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির তার মেয়াদের শেষ মুদ্রানীতি ঘোষণা করেন। নিজের মেয়াদের শেষ কর্মদিবসে এই মুদ্রানীতি ঘোষণা করেন তিনি। অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

মূল্যস্ফীতির চাপ সামাল দিতে এই মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংক একে নতুন অর্থবছরের জন্য 'সতর্ক' ও 'সংকোচনমুখী' মুদ্রানীতি বলছে।

মুদ্রানীতি ঘোষণাকালে ফজলে কবির বলেন, 'বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির সর্বশেষ পরিস্থিতি এবং সম্প্রতি সংঘটিত দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বন্যার অর্থনৈতিক প্রভাব পর্যালোচনা করে প্রতীয়মান হয় যে, ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য মুদ্রানীতির মূল চ্যালেঞ্জ হবে টাকার অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক মান অর্থাৎ মূল্যস্ফীতি ও বিনিময় হারকে স্থিতিশীল রাখা। একই সঙ্গে, কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে চলমান অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার কার্যক্রমে সমর্থন অব্যাহত রাখাও আসন্ন মুদ্রানীতির জন্য অপরিহার্য বলে বিবেচিত হয়েছে। সে বিবেচনায় মূল্যস্ফীতি ও টাকার বিনিময় হারের ঊর্ধ্বমুখী চাপকে নিয়ন্ত্রণে রেখে কাঙ্ক্ষিত জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনে সহায়তা করার নিমিত্তে ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য সতর্কতামূলক মুদ্রানীতি ভঙ্গি অনুসরণ করা হয়েছে, যা কিছুটা সংকোচনমুখী। সে আলোকে পুরো অর্থবছরের জন্য অর্থ ও ঋণ কর্মসূচি প্রণয়ন করা হয়েছে।'

নতুন মুদ্রানীতিতে ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধির সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে ১৪.১ শতাংশ। বিদায়ী (২০২১-২২) অর্থবছরে এই লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৪.৮ শতাংশ।

নতুন অর্থবছরের মুদ্রানীতির অংশ হিসেবে নীতিনির্ধারণী সুদহার বাড়িয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাজারে অর্থপ্রবাহে কড়াকড়ি আরোপ করে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রাও কমানো হয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর

জানান, নয়া মুদ্রানীতিতে নীতিনির্ধারণী সুদহার বা রেপো রেট ৫% থেকে বাড়িয়ে ৫.৫০% শতাংশ করা হয়েছে। তারল্য প্রবাহ সতর্কভাবে সংকোচনের নীতিগত সিদ্ধান্ত হলো এই পদক্ষেপ।

আমদানি-নির্ভরতা কমিয়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সুরক্ষিত রাখতে আমদানি বিকল্প পণ্যের উৎপাদন বাড়ানোর জন্য নতুন পুনঃঅর্থায়ন স্কিমও চালু করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

বিলাস দ্রব্য, বিদেশি ফল, অপ্রয়োজনীয় পণ্য যেমন- অশস্য খাদ্যপণ্য, টিনজাত ও প্রক্রিয়াজাত পণ্যের আমদানি নিরুৎসাহিত করার লক্ষ্যে এগুলোর এলসি মার্জিন উলেস্নখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করা হবে।

দেশের অর্থনীতিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং কোভিড-১৯ মহামারির প্রতিকূল প্রভাব মোকাবিলায় বাংলাদেশ ব্যাংক নিজস্ব পুনঃঅর্থায়ন স্কিমগুলোর পাশাপাশি সরকারের চলমান প্রণোদনা প্যাকেজগুলোর বাস্তবায়ন অব্যাহত রাখবে।

পুঁজিবাজারকে আর্থিক খাতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ উলেস্নখ করে বাজারের সার্বিক স্থিতিশীলতা এবং দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক সচেষ্ট থাকবে বলে আগামী অর্থবছরের জন্য ঘোষিত মুদ্রানীতিতে বলা হয়েছে।

মহামারির কারণে মাঝে দুই বছর মুদ্রানীতি প্রকাশ করা হয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওয়েবসাইটে, কোনো আনুষ্ঠানিকতা ছিল না। এবার আবার পুরনো রীতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান কার্য়ালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে মুদ্রানীতি ঘোষণা করেন গভর্নর।

তিনি বলেন, 'টাকার অভ্যন্তরীণ বাহ্যিক মান, অর্থাৎ মূল্যস্ফীতি ও বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখা' হবে নতুন অর্থবছরের জন্য মূল চ্যালেঞ্জ।

২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে ঘোষিত সরকারের লক্ষ্যমাত্রার ভিত্তিতে নতুন মুদ্রানীতিতে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে এক লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা ঋণ জোগানোর ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এতে সরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৩৯. ৪ শতাংশ, যা গতবার ৩৬ দশমিক ৬ শতাংশ ছিল। আর বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ১৪.১ শতাংশ, যা গতবার ছিল ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ।

সব মিলিয়ে মোট অভ্যন্তরীণ ঋণের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ১৮.২ শতাংশ, যা ২০২১-২২ অর্থবছরে ১৭ দশমিক ৮০ শতাংশ র্নিধারণ করা হয়েছিল।

এর মানে হলো, নতুন অর্থবছরে সরকারি খাতের ওপর ভর করে অভ্যন্তরীণ ঋণ প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।

সরকার বাজেটে যে নীতি ও উন্নয়ন কর্মসূচি ঠিক করে, তা বাস্তবায়নের জন্য সহায়ক আর্থিক পরিবেশ সৃষ্টি এবং নির্দিষ্ট সময় বাজারে অর্থের প্রবাহ ঠিক রাখাই মুদ্রানীতির লক্ষ্য।

এমনভাবে এই নীতি সাজানো হয়, যাতে অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য পূরণের পাশাপাশি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং দারিদ্র্য বিমোচনে সরকারের প্রত্যাশা পূরণ সম্ভব হয়। ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট বাস্তবায়নে বছরের পুরো সময়টায় বাজারে অর্থপ্রবাহ ও আঙ্গিক কেমন হবে, তাও মুদ্রানীতিতে ঠিক করে দেওয়া হয়।

আগামী অর্থবছরের জন্য মুদ্রানীতিতে ব্যাপক মুদ্রা (এম২) প্রবৃদ্ধি কিছুটা কমিয়ে ধরা হয়েছে ১২.১ শতাংশ, গতবার এই সীমা নির্ধারণ করা হয়েছিল ১৫ শতাংশ; চলতি জুন পর্যন্ত এর ৯.১ শতাংশ অর্জিত হয়েছে।

২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য জাতীয় বাজেটে সরকার মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ৭.৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি এবং মূল্যস্ফীতি ৫.৬ শতাংশে ধরে রাখার পরিকল্পনা নিয়েছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে