বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

পাবনায় ৭ লাখ পশু প্রস্তুত

বাজার গরম করছে স্বপ্নরাজ, সোনামণি আর রাজা
আরিফ আহমেদ সিদ্দিকী, পাবনা
  ০৫ জুলাই ২০২২, ০০:০০

পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার করমজা ইউনিয়নের ফকিরপাড়ায় শাহজাহান আলী ফকিরের ৩০ মণ ওজনের ষাঁড় 'সোনামণি'র দাম হাঁকা হচ্ছে ২০ লাখ। সদরের জালালপুরে খামারি রাজুর ৩২ মণ ওজনের ষাঁড় 'রাজা'র দাম হাঁকা হচ্ছে ২০ লাখ আর চাটমোহরের হান্ডিয়াল ইউনিয়নের বাঘলবাড়িয়ায় সাবেক ইউপি সদস্য মোজাম্মেল হক বাবুর খামারে ৩৬ মণ ওজনের ষাঁড় 'স্বপ্নরাজ'র দাম হাঁকা হচ্ছে ২০ লাখ টাকা।

আর ক'দিন বাদেই পবিত্র ঈদুল আজহা। ঈদকে সামনে রেখে পাবনায় প্রায় ২৪ হাজার ছোট বড় খামারে প্রস্তুত করা হয়েছে ৭ লক্ষাধিক কোরবানির পশু। সারা দেশের কোরবানি পশুর জন্য প্রাচীন জেলা পাবনার খ্যাতি রয়েছে। এ জেলায় কোরবানির পশুর চাহিদা পূরণ করেই ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ বেশ কিছু জেলাতে পাঠানো হয়। প্রতিবারের মতো এবারও এ জেলাতে পালন করা বেশ কিছু কোরবানির পশু আলোচনায় এসেছে।

ইতোমধ্যে পাবনা জেলার ১১ থানায় কোরবানি পশুর হাট জমতে শুরু করেছে। তবে হাটে আসা ক্রেতারা বলছেন, বাজার বেশ চড়া আর বিক্রেতা বা খামারিরা বলছেন, গো-খাদ্যের অতিরিক্ত দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় গরু, মহিষ পালনে যে পরিমাণ খরচ হচ্ছে তাতে মূল দাম পাওয়ায় কষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়াবে। কোরবানির পশু হলেও ক্রেতারা ২০ থেকে ২৪ হাজার টাকা মণ মাথায় রেখে পশু খুঁজছেন আর বর্তমান বাজারে ২৪ হাজার থেকে ২৫-২৬ হাজার টাকা মণ হিসেবে পশু ক্রয়-বিক্রয় হচ্ছে। তবে হাটে পশু আমদানি ব্যাপক হলেও কেনাচেনা পুরোপুরি শুরু হয়নি।

সরেজমিন পাবনা সদরের আরিফপুর হাজির হাট, টেবুনিয়া, দাপুনিয়া, আরমবাড়িয়া, আওতাপাড়া, আটঘরিয়া, চাটমোহরের রেলবাজার, ভাঙ্গুড়া, ফরিদপুর, বেড়াসহ বেশ কয়েকটি হাটের খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আমদানি অনেক। কিন্তু ক্রেতাস্বল্পতা রয়েছে। গরু ব্যবসায়ী ও খামারিরা বলছেন, মূল কেনাবেচা শুরু হবে ঈদের দু'এক দিন আগে থেকে। এখন যারা আসছেন তারা কোরবানির পশু পছন্দ করছেন। সুবিধামতো পেলে কিনে নিয়ে যাচ্ছেন।

আরিফপুর হাজিরহাটে কোরবানি পশু ক্রেতা তপু আহমেদ বলেন, 'বেশ কয়েকটি হাট ঘুরেছি। চাহিদামতো মিলছে না। দামটা একটু বেশিই মনে হচ্ছে।' আওতাপাড়া হাটে ক্রেতা হাফিজুর রহমান বলেন, 'ফাইনালি কোরবানির পশু কেনা হয়নি। তবে কয়েকটি হাট ঘুরছি। দামটা বেশি মনে হচ্ছে। হয়তো ঈদের আগেই কিনে ফেলব।' আটঘরিয়া হাটের গরু ব্যবসায়ী সোলায়মান মিয়া বলেন, 'হাট অনুসারে অনেক গরু মহিষের আমদানি হয়েছে। সে তুলনায় ক্রেতা উপস্থিতি কম।' চাটমোহরের রেলবাজারে হাটে শাহিনুর রহমান বলেন, 'খাশির বাজারটা বেশ চড়া মনে হচ্ছে। অবশ্য হাট পুরোপুরি শুরু হয়নি। আরও দু'এক দিন গেলে দামের বিষয়টি বোঝা যাবে।'

আটঘরিয়ার সড়াবাড়িয়ার খামারি বকুল বিশ্বাস বলেন, 'আমার খামারে ১০টি গরু পালন করা হয়। প্রতিটি গরু লাখের ওপরে যাবে। কিন্তু খাবার জোগান দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। পশু খাবারের প্রতিটি জিনিসের দাম অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। যে কারণে ভাবছি লাভের চেয়ে লোকসান গুনতে হয় কি না।'

পাবনা সদরের মনোহরপুর গ্রামের মিরোন হক বলেন, ক্ষুদ্র ও মাঝারি খামারিদের জন্য এবারে পশু পালন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পশু পালন করে লাভের মুখ দেখাটা বড়ই কষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়াবে। তিনি বলেন, যেসব ব্যবসায়ী পাড়া বা খামারে গিয়ে গরু কিনে বিক্রি করছেন মূলত তারাই লাভবান হচ্ছেন।

অতীশ দীপঙ্কর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএসসি সম্পন্ন করে চাকরির জন্য বসে না থেকে নিজ গ্রাম পাবনা সদরের জালালপুরে খামার গড়েছেন তরুণ উদ্যোক্তা রাজু আহমেদ। ২০১০ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত বাণিজ্যিকভাবে গরু পালন করে তাকে আর পিছনে তাকাতে হয়নি। বর্তমানে তার খামারে রয়েছে অর্ধশত কোরবানির পশু। ঈদের আগে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে গরু কিনে নিজ খামারে লালনপালন করেছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে অনলাইনে তিনি কোরবানির পশু বিক্রি করছেন। গত বছরে পাবনার আলোচিত গরু 'রাজা'র মালিক রাজু এবারে তৈরি করেছেন বাদশা। তার খামারের আলোচিত গরুর নাম রাজা ও বাদশা। এবারে বড় আকৃতির ব্রাহামা ও অস্ট্রেলিয়ান ক্রস জাতের বিশাল ষাঁড় তৈরি করেছেন। বাদশার ওজন মিটার স্কেলের হিসাব মতে, ১২০০ কেজি। রাজাও ঠিক এমনটি। এই খামারে ব্রাহামা, অস্ট্রেলিয়ান, ইন্ডিয়ান, শাহীয়াল, ফিজিয়াম, ভুটান থেকে আনা ভুট্টি জাতের গরু রয়েছে। এবারে কোটি টাকার পশু বিক্রির টার্গেট এই খামারির। ইতোমধ্যে অনলাইনে ও সরাসরি ৪০টি বিক্রি করেছেন।

পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার করমজা ইউনিয়নের ফকিরপাড়া গ্রামের শাহজাহান আলী ফকির জানান, 'আমি গরু ব্যবসায়ী বা খামারি নই। তবে সৌখিনতা থেকে প্রতি কোরবানির ঈদে একটি করে গরু প্রস্তুত করি। এবারে প্রস্তুত করেছি সোনামণি নামের একটি ষাঁড়। গরুটির প্রাথমিক ওজন নির্ধারণ হয়েছে ৩০ মণ। দাম চেয়েছি ২০ লাখ টাকা। ৩ বছর ধরে গরুটি পালন করছি। আশা করছি ভালো দামে গরুটি বিক্রি করতে পারব। সখের তাড়নায় সোনামণি লালনপালন করছি। যদিও গো-খাদ্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। তারপরও কোরবানির পশু। তাকে তো না খাইয়ে রাখা যায় না। যে কারণে টাকার দিকে না তাকিয়ে ওকে কীভাবে সুস্থ ও সবল রাখা যায় সেদিকটাই আমি ভেবেছি।'

পাবনার চাটমোহরের হান্ডিয়াল ইউনিয়নের বাঘলবাড়িয়া গ্রামের সাবেক ইউপি মেম্বার মোজাম্মেল হক বাবু তার নিজ খামারে প্রস্তুত করেছেন স্বপ্নরাজ নামে একটি ষাঁড়। এটির ওজন ৩৬ মণের কাছে। তিনি মূল্য হাঁকছেন ২০ লাখ টাকা। ইতোমধ্যে গরুটি দেখতে প্রতিদিনই খামারে মানুষের আনাগোনা বৃদ্ধি পেয়েছে। তিনি আশাবাদী যথার্থ মূল্যে গরুটি বিক্রি করতে পারবেন।

স্বপ্নরাজের লালনকারী গৃহকর্তি আঞ্জুয়ারা খাতুন বলেন, 'চার বছর ধরে সন্তানের মতোই স্বপ্নরাজকে পালন করছি। একটি সন্তানকে যেমন সময় দিয়ে ভালোবাসা দিয়ে মানুষ করতে হয়। বড় করতে হয়। তার এতটুকু কমতি করিনি স্বপ্নরাজের জন্য। বিক্রি করা হবে স্বপ্নরাজকে এমনটি ভাবতেই কষ্ট লাগছে। কিন্তু কী আর করার। বিক্রি তো করতেই হবে।'

প্রাণিসম্পদ দপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, আমরা প্রতিটি গ্রাম ও মহলস্নায় খোঁজ-খবর নিয়ে খামারিদের সব সময় ভালো পরামর্শ দিয়ে থাকি। পশুর চিকিৎসা দিয়ে থাকি। সুন্দর সুন্দর পশুর ছবি ও তথ্য অনলাইনে আপলোড করা হয়। যাতে ঝামেলা ছাড়া সহজেই ক্রেতারা ছবি দেখে তথ্য জেনে খামার থেকে তাদের পছন্দের পশু ক্রয় করতে পারেন।

পাবনা জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) ডা. কৃষ্ণ মহন হাওলাদার বলেন, কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে জেলায় চলতি বছরে প্রায় ২৪ হাজার খামারে প্রায় ৭ লাখ পশু প্রস্তুত রয়েছে। এর মধ্যে ১ লাখ ৭৭ হাজার গরু ও মহিষ আর ৩ লাখ ৭১ হাজার ছাগল-ভেড়া। জেলাতে সব মিলিয়ে ৩ লাখ কোরবানি পশুর চাহিদা রয়েছে। আর সাড়ে ৩ লাখ পশু জেলার বাইরে বিভিন্ন জেলাতে সরবরাহ হবে। তিনি বলেন, বিগত দুই বছর অনলাইনে পশু কেনাবেচা হলে এই বছরে করোনার সংক্রমণ কম থাকায় হাটবাজারে পশু বিক্রি বেশি হবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে