তিনজন আটক
নবীগঞ্জে ইউনিয়ন পরিষদকে দূতাবাস বানিয়ে প্রতারণা
প্রকাশ | ০৮ আগস্ট ২০২২, ০০:০০
নবীগঞ্জ (হবিগঞ্জ) প্রতিনিধি
হবিগঞ্জের নবীগঞ্জে প্রতারণার মাধ্যমে একটি ইউনিয়ন পরিষদ অফিসকে 'সৌদি দূতাবাস' বানিয়ে সৌদি যেতে আগ্রহী নারীদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগে তিনজনকে আটক করেছে পুলিশ। শনিবার বিকালে উপজেলার বাউসা ইউনিয়ন পরিষদ থেকে তাদের আটক করা হয়। ভোটার হালনাগাদ কার্যক্রমের ফাঁকে এই প্রতারণা চালানো হয় বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
আটকরা হলেন- নির্বাচন কমিশনের ভোটার হালনাগাদের প্রজেক্টের কম্পিউটার অপারেটর বানিয়াচং উপজেলার জমশেদ মিয়া (৩০), সুনামগঞ্জ পৌরসভার ইকড়ছই গ্রামের আবু সুফিয়ান (৩৫), মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার ফাহিম চৌধুরী (২৮)। এ সময় তাদের কাছ থেকে নির্বাচন কমিশনের আঙুলের ছাপ গ্রহণ পরবর্তী নতুন ভোটার হওয়ার ৬৫টি স্স্নিপসহ বিভিন্ন জাতীয় পরিচয়পত্র জব্দ করা হয়।
প্রত্যক্ষদর্শী ও ভুক্তভোগীরা জানান, গত ৪ আগস্ট থেকে নবীগঞ্জের বাউসা ইউনিয়নে চলছিল নতুন ভোটার হালনাগাদ কার্যক্রম। শনিবার ৬ আগস্ট কার্যক্রমের শেষদিনে নতুন ভোটার হওয়ার ফরমে ঠিকানা জন্মনিবন্ধন নাম্বারসহ প্রয়োজনীয় তথ্য দেওয়ার পর আঙুলের ছাপ দিচ্ছিলেন ওই ইউনিয়নের নতুন ভোটাররা। এ সময় নির্বাচন কমিশনের ভোটার হালনাগাদের প্রজেক্টের কম্পিউটার অপারেটর জমশেদ মিয়া নতুন ভোটার হওয়ার ফরমে ঠিকানা, জন্ম নিবন্ধন নাম্বারের তথ্য অপূরণ রেখেই সুনামগঞ্জের সুলতানা আক্তার সুমীকে নবীগঞ্জ উপজেলার বাউসা ইউনিয়নের নতুন ভোটার করার জন্য আঙুলের ছাপ গ্রহণ করেন। এরপর নেত্রকোনার ফাহিমা ও বিশ্বনাথের রিমা বেগমের আঙুলের ছাপ দেওয়ার সময় অপরিচিত দেখে স্থানীয়দের সন্দেহ হলে আবু সুফিয়ান, ফাহিম চৌধুরী ও ৩ মহিলাকে আটক করা হয়। এ সময় মোফাজ্জল নামে এক ব্যক্তি ২২ জন নারীসহ পালিয়ে যায়।
খবর পেয়ে নবীগঞ্জ থানার ওসি ডালিম আহমেদ, উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানসহ একদল পুলিশ শনিবার সন্ধ্যা ৭টার দিকে ঘটনাস্থলে পৌঁছে জমশেদ মিয়া (৩০), সুনামগঞ্জ পৌরসভার ইকড়ছই গ্রামের আবু সুফিয়ান (৩৫), মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার ফাহিম চৌধুরীকে (২৮) আটক করে থানায় নিয়ে যায়।
সুনামগঞ্জের সুলতানা আক্তার সুমী জানান, 'আমি ৩ বছর সৌদি আরবে ছিলাম। ১ বছর আগে দেশে এসেছি। আবার আমাকে সৌদি আরব পাঠানোর কথা বলে চলতি বছরের এপ্রিল মাসে আবু সুফিয়ান নামে এক দালাল ১৫ হাজার টাকাসহ পাসপোর্ট নেয়। সুফিয়ান জানায় সৌদি যেতে হলে অ্যাম্বাসিতে আঙুলের ছাপ দিতে হবে। তাই সুফিয়ান তার সহযোগী মোফাজ্জল মিয়া ও ফাহিম চৌধুরীর মাধ্যমে সৌদি আরবে যেতে ইচ্ছুক আমিসহ সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা, সিলেটসহ বিভিন্ন স্থান থেকে ২৫ জন নারীকে আঙুলের ছাপ দেওয়ার জন্য সৌদি অ্যাম্বাসিতে নিয়ে যাওয়ার জন্য দুটি মাইক্রোবাসে করে এখানে নিয়ে এসেছে। আমি আঙুলের ছাপও দিয়েছি।'
নেত্রকোনার ফাহিমা আক্তার বলেন, 'আমি চট্টগ্রামে একটি গার্মেন্টসে চাকরি করি, সৌদি আরবে নেওয়ার নাম করে সুফিয়ান নামে এক দালাল আমার কাছ থেকে ১২ হাজার টাকা নেয়। শনিবার সৌদি আরবে যাওয়ার জন্য আঙুলের ছাপ দেওয়ার শেষদিন এমন কথা বলে চট্টগ্রাম থেকে আমাকে আঙুলের ছাপ দেওয়ার জন্য এখানে নিয়ে এসেছে। ঝামেলার জন্য আমি আঙুলের ছাপ দিইনি।'
রিমা বেগম বলেন, 'সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা, সিলেটসহ বিভিন্ন স্থান থেকে আমিসহ ২৫ জন মহিলা সৌদি আরবে যাওয়ার জন্য ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা করে কয়েক লাখ টাকা সুফিয়ান তার সহযোগী মোফাজ্জল মিয়া ও ফাহিম চৌধুরীর কাছে দিয়েছি। আজ আঙুলের ছাপ দেওয়ার জন্য এখানে নিয়ে এসেছে। আমরা গ্রামের মানুষ আমরা তো আর বুঝিনি যে বিদেশের জন্য আঙুলের ছাপ দিতে এনে এখানে আমাদের নতুন ভোটার করাচ্ছে।'
আজিজুর রহমান নামে স্থানীয় এক যুবক জানান, গত তিন দিন ধরে চলছে নতুন ভোটার হালনাগাদ কার্যক্রম। আজকে শেষদিনে অন্যান্য জেলার বাসিন্দাদের বাউসা ইউনিয়নের ভোটার করার জন্য নিয়ে আসা হলে প্রতারণা একপর্যায়ে ধরা পড়ে। বাইরের জেলার কয়জন আঙুলের ছাপ দিয়ে বাউসা ইউনিয়নের নতুন ভোটার হিসেবে সার্ভারে তথ্য গিয়েছে তা কীভাবে নির্ণয় করবে নির্বাচন কমিশন। এ ঘটনায় জড়িতদের শাস্তির দাবি জানান তিনি।
বাউসা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাদিকুর রহমান শিশু মিয়া বলেন, বিভিন্ন জেলা থেকে তথ্য গোপন করে বাউসা ইউনিয়নে ভোটার করার জন্য কয়েকজন দালাল ও নির্বাচন অফিসের কর্মকর্তাদের যোগসাজসে আমার ইউনিয়নে নিয়ে আসা হয়। আঙুলের ছাপ দেওয়ার সময় গ্রাম পুলিশ ও স্থানীয় লোকজন অপরিচিত মুখ দেখে তাদের আটক করে।
এ প্রসঙ্গে নবীগঞ্জ উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান বলেন, ভোটার হালনাগাদ কার্যক্রমের ফাঁকে অন্যান্য উপজেলার নাগরিকদের নবীগঞ্জের বাউসা ইউনিয়নে নাগরিক করার জন্য ভোটার করা হচ্ছে- এমন সংবাদে ঘটনাস্থলে এসে প্রাথমিক সত্যতা পেয়েছি। আমাদের কেউ জড়িত থাকলে অবশ্যই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
তিনি আরও বলেন, যারা আজকে ভোটার হয়েছেন তাদের তথ্য অফলাইনে রয়েছে। উদ্ধার হওয়া স্স্নিপের সিরিয়াল নাম্বার অনুযায়ী তথ্য যাচাই-বাছাই করে এগুলো বাদ দেওয়া হবে। তাদের দ্বিতীয়বার ভোটার হওয়ার সুযোগ নেই।
নবীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ডালিম আহমেদ বলেন, সৌদি যাওয়ার জন্য দূতাবাসে আঙুলের ছাপ দেওয়ার নাম করে একটি চক্র বিভিন্ন জেলা থেকে মহিলাদের বাউসা ইউনিয়ন অফিসের চলমান নতুন ভোটার হালনাগাদ কার্যক্রমে নিয়ে আসে। এখানে নতুন ভোটার হওয়ার ফরমে পর্যাপ্ত পরিমাণ প্রয়োজনীয় তথ্য না দিয়েই অন্যান্য জেলার মহিলাদের আঙুলের ছাপ গ্রহণ করা হয়। এ ঘটনায় কম্পিউটার অপারেটরসহ ৩ জন প্রতারককে আটক করা হয়েছে। এ ব্যাপারে রাতেই থানায় মামলা হয়েছে।