তিস্তায় ঝুলে আছে নদী পাড়ের মানুষের ভাগ্য

প্রকাশ | ১৩ জানুয়ারি ২০১৯, ০০:০০

কাউনিয়া (রংপুর) সংবাদদাতা
প্রমত্তা তিস্তা এখন ধু ধু বালুচর। এক সময় পানির প্রবল তোড়ে দুই পাড়ে ভাঙনের আশঙ্কা করত সাধারণ মানুষ, সেই তিস্তার বুকে এখন মানুষের পদচারণা Ñযাযাদি
আলোচনা আর বৈঠকের পর বৈঠকেও সমাধান হচ্ছে না তিস্তার পানি বণ্টন সমস্যা। টানা তৃতীয়বার ও বতর্মান ক্ষমতাসীন সরকারের আমলেও পানি বণ্টন চুক্তি না হওয়ার তিস্তায় বিপযর্য় দেখা দিয়েছে। ভারত গজলডোবায় তিস্তার ওপর যে ব্যারাজ নিমার্ণ করেছে তার ফলে তিস্তার ভারতীয় অংশে পানি থই থই করছে। আর ভাটির বাংলাদেশ অংশে তিস্তার পানি প্রবাহ কমে যাওয়ায় জেগে উঠছে অসংখ্য ধু-ধু বালুচর। পৌষেই একদিকে জলশূন্য তিস্তা, অন্যদিকে পানির লেয়ার (স্তুর) নিচে নেমে যাওয়ায় চলতি মওসুমে বোরো ও রবিশস্য আবাদে সেচ নিয়ে দুচিন্তায় কৃষকরা। অপরদিকে তিস্তায় পানি না থাকায় এখন নদীতে মাছ পাওয়া যায় না। তাই নদী পাড়ের জেলেদের দুশ্চিন্তারও শেষ নেই। শনিবার সরেজমিন উপজেলার পাঞ্চরভাঙ্গা চর এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, তিস্তা নদীর ওপর নিমির্ত তিস্তা রেলসেতু, তিস্তা সড়ক সেতু দঁাড়িয়ে রয়েছে বালুচরের ওপর। পাকা সেতু থাকলেও নদীতে পানি না থাকায় অনেকে হেঁটেই পাড়ি দিচ্ছেন। নদীতে থেমে গেছে মাঝি মাল্লাদের দৌড় ঝঁাপ। শুকনো বালুচরে পড়ে আছে মাছ ধরা নৌকাগুলো। এক সময় তিস্তা নদীতে মাছ আহরণ করে শূঁটকি ও মাছ বিক্রি করে জীবনযাপন করতেন এ অঞ্চলের জেলেরা। তারাও এখন কমর্হীন হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। অনেকেই বাপ-দাদার এই পেশা ছেড়ে অন্য পেশা শুরু করেছেন। আর মাঝি মাল্লারা কমর্হীন হয়ে বেকার জীবনযাপন করছেন। অন্যদিকে তিস্তায় জেগে উঠা চরে ও নদীর তীরবতীর্ গ্রামে সেচের অভাবে ব্যাহত হচ্ছে চাষাবাদ। কেউ কেউ দূর থেকে পানি এনে, কেউবা ডিজেল চালিত সেচযন্ত্রের মাধ্যমে বঁাচিয়ে রেখেছেন ফসল। উপজেলার পাঞ্চরভাঙ্গা গ্রামের কৃষক আব্দুর রহিম, সুলতান মিয়া, সোবহান আলী সহ তিস্তার চরাঞ্চল ২৯টি গ্রামের একাধিক কৃষকদের অভিযোগ, তিস্তার পানি দিন দিন কমে যাওয়ায় তারা জমিতে কোনো ফসল ফলাতে পারছেন না। কিন্তু পরিস্থিতি যদি আরও বাড়তে থাকে তাহলে ভবিষ্যতে তিস্তা পাড়ের কোনো কৃষকই ফসল ফলাতে পারবে না। চরপল্লীমারী গ্রামের শিক্ষিক ও সামথর্্যবান কৃষক কামরুজ্জামান (৪৮) বলেন, আগে আলু ও রবিশষ্য খেতে একদিন পানি দিলে, দুই সপ্তাহ না দিলে চলত। এখন খেতে প্রতি সপ্তাহে সেচ দিতে হচ্ছে। এরপর পানির স্তর কমায় আলু ও রবিশষ্য আবাদে সেচযন্ত্র অচল হয়ে যাওয়ায় নিয়ে দুচিন্তায় আছেন তিনি। স্থানীয় কৃষি অফিসারগন জানান, শুষ্ক মৌসুম শুরু না হতেই জলশূন্য হয়ে পড়েছে তিস্তা। এর প্রভাব পড়ছে কৃষিতে। গত বছরেরও তিস্তার পানি কমে গেলে সেচের অভাবে বোরো আবাদে বিপযর্য় দেখা দেয়। উপজেলা কৃষি বিভাগ সূত্র জানায়, গত কয়েকবছর আগেও এ অঞ্চলে মাটির ৫০ থেকে ৮০ ফিটের মধ্যে পানির লেয়ার (স্তর) ছিল। কিন্তু শুকনো মওসুম শুরুর আগেই তিস্তা নদী ও শাখা নদীগুলো পানিশূন্য হয়ে পড়ায় বতর্মানে পানির লেয়ার (স্তর) নিচে নেমে যাচ্ছে। এভাবে পানির লেয়ার (স্তর) নিচে নেমে গেলে চলতি মওসুমে বোরো ও রবিশষ্য আবাদে সেচ কাজ ক্ষেত্রে এর প্রভাব পড়ছে। তিস্তার পাড়ের রহিম মিয়া, বরকত আলী, জহির জেলেরা জানান, এক সময় তিস্তায় পাওয়া যেত নানা রকমের মাছ। নদী পাড়ের হাজার হাজার জেলেদের সংসার চলত এই নদীতে মাছ ধরে। এখন তিস্তায় পানি নেই, তাই মাছও নেই। বেঁচে থাকার তাগিদে পেশা পরিবতর্ন করে কৃষি শ্রমিক হিসেবে কাজ করে সংসার চালাচ্ছেন তারা। আবার অনেকেই ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে গিয়ে রিকশা চালাচ্ছেন। খেয়াঘাটের মাঝি মোত্তালিব হোসেন (৪৫) বলেন, নদীত পানি নেই, নৌকা চালাবেন ক্যামনে, তাই সবাই হেঁটে নদী পাড় হচ্ছেন। জানা যায়, ভারতের সিকিম রাজ্য থেকে পশ্চিমবঙ্গের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশের নীলফামারী জেলার সীমান্ত হয়ে রংপুরের কাউনিয়া ও গংগাচড়া উপজেলা, লালমনিরহাট, গাইবান্ধা জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে কুড়িগ্রামের চিলমারী বন্দর হয়ে ব্রহ্মপুত্র নদের সঙ্গে মিশেছে এক সময়ের খর¯্রােতা তিস্তা নদী। প্রায় ৩১৫ কিলোমিটার দৈঘ্যর্ নদীটির বাংলাদেশ অংশে রয়েছে প্রায় ১২৫ কিলোমিটার। ডালিয়া ব্যারেজের একশ’ কিলোমিটার উজানে ভারতের গজলডোবায় বঁাধ নিমার্ণ করে সেই দেশের সরকার কয়েক যুগ ধরে একতরফা পানি নিয়ন্ত্রণ করায় এক সময়ের খর¯্রােতা তিস্তা নদীর এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। তাই ফাল্গুনেই বাংলাদেশ অংশে তিস্তা মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। ফলে রংপুর, লালমনিরহাট, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম ও নীলফামারী জেলার ১২৫ কিলোমিটার তিস্তার অববাহিকায় রুক্ষ পরিবেশ বিরাজ করছে। এতে একদিকে দেশের বৃহত্তম তিস্তা ব্যারাজ সেচ প্রকল্প প্রায় অকাযর্কর হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে শুষ্ক মৌসুমে নদীর তীরবতীর্ গ্রামগুলোতে পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় বোরোসহ বিভিন্ন ফসল চাষাবাদে সেচ নিয়ে শঙ্কিত কৃষকরা। নদী ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলেন, ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ ও ভারত যৌথ নদী কমিশন গঠন করলেও আলোচনা আর বৈঠকের পর বৈঠকেও সমাধান হচ্ছে না তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি। বতর্মান ক্ষমতাসীন সরকারের আমলেও পানি বণ্টন চুক্তি না হওয়ার জলশূন্য হয়ে পড়েছে তিস্তা। শুকনো মওসুমে প্রভাব কৃষিখাতে পড়ছে। তারা বলেন, ২০১৫ সালে পশ্চিম বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় বাংলাদেশ সফরে আসেন এবং সোনরগঁাও হোটেলে এক অনুষ্ঠানে পানি চুক্তি নিয়ে আশ্বস্ত করায় তিস্তার পাড়ের মানুষ আশায় বুক বেঁধেছিল। এরপর ওই বছরের ৬ জুন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ সফরে আসেন। ওই সময় মোদির সঙ্গে মমতার আসার কথা থাকলেও পরে তিনি পিছিয়ে যান। ফলে তিস্তায় ঝুলে যায় নদীর পাড়ের কয়েক লক্ষাধিক জেলে ও কৃষকদের ভাগ্য। এদিকে সচেতন মহল মনে করেন, বতর্মান সরকার তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি বিষয়ে দ্রæত পদক্ষেপ গ্রহণ না করে, তাহলে তিস্তার পাড়ের মানুষের দুদর্শার আর শেষ থাকবে না। এখন এ অঞ্চলের মানুষ অধির আগ্রহে তাকিয়ে আছে তিস্তার ন্যায্য হিস্যার জন্য। তারা চায় চুক্তি শুধু আলাপ আলোচনায় এবং কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ না রেখে বাস্তবে প্রয়োগ করা হোক।