মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

কেরানীগঞ্জে কিশোর গ্যাং আতঙ্ক

চক্রের সদস্যরা খুনাখুনিসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে
মাসুম পারভেজ, কেরানীগঞ্জ (ঢাকা)
  ০৪ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:০০

অলিগলি-রাস্তার মোড় ও ফুটপাতে আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজি, চুরি-ছিনতাই থেকে শুরু করে খুনাখুনিসহ নানা অপরাধে রাজধানীর কেরানীগঞ্জে কিশোর গ্যাং আতঙ্ক দিন দিন বেড়েই চলেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ধারাবাহিক অভিযানের পরও থামছে না কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা।

জানা যায়, এই গ্যাংয়ের সদস্যরা ছোটখাটো নানা বিষয় নিয়েও জড়িয়ে পড়ছে সহিংসতায়। পাড়া-মহলস্নায় দল বেঁধে ঘুরে বেড়ানো, স্কুল-কলেজের সামনে আড্ডা, মোটরসাইকেল নিয়ে মহড়া, তরুণীদের উত্ত্যক্ত করা, মাদকসেবনসহ বিভিন্ন অপকর্ম করতে গড়ে তোলা হচ্ছে নিত্যনতুন 'কিশোর গ্যাং'। দিন দিন তারা হয়ে উঠছে ভয়ংকর। এক গ্রম্নপের দেখাদেখি জন্ম নিচ্ছে আরেক গ্রম্নপ। চুরি-ছিনতাই থেকে শুরু করে হত্যাকান্ডে পর্যন্ত জড়াচ্ছে ১৪ থেকে ২০ বছর বয়সি কিশোররা। অস্ত্র হিসেবে তারা ব্যবহার করছে ছুরি বা চাকু অথবা চাপাতির মতো ধারালো অস্ত্র। আধিপত্য বিস্তার, সিনিয়র-জুনিয়র বা নারীঘটিত ঘটনাকে কেন্দ্র করে ঘটাচ্ছে হত্যাকান্ড।

গত ২৭ জুলাই উপজেলার শাক্তা ইউনিয়নের নুরুন্ডি এলাকায় প্রকাশ্যে মুরাদ আহমেদকে কুপিয়ে হত্যা করে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। নিহতের

বাবা মজিবুর রহমান কেরানীগঞ্জ মডেল থানায় মামলা করলে গত ১১ আগস্ট পটুয়াখালী থেকে কিশোর ইমন হোসেনকে গ্রেপ্তার করা হয়। অপর আসামি সায়েব আলী, রায়হান আহমেদ, সাগর আহমেদ, মিলন হোসেন, সিয়াম উদ্দিন ও অজয় মোদক এখনো অধরা।

গত ৫ জুলাই ভোরে কেরানীগঞ্জের শাক্তা ইউনিয়নের খোলামোড়া মডেল টাউন আদর্শ স্কুলের পাশে নাদিম আহমেদকে ছুরিকাঘাত করে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিলে তাকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক। নিহতের পরিবার ১৫ থেকে ২০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে। পুলিশ প্রধান আসামি কিশোর গ্যাংয়ের লিডার রাকিব হোসেনকে রংপুর থেকে গ্রেপ্তার করে। বাকিরা এলাকায় ঘুরলেও পুলিশ গ্রেপ্তার করছে না।

সাবেক ইউপি সদস্য মনির হোসেন বলেন, রাকিবের নেতৃত্বে ৪০ থেকে ৫০ জনের বাহিনী রয়েছে। খোলামোড়া ও জিয়ানগর এলাকায় তারা মাদক বিক্রি, ছিনতাই, ডাকাতিসহ নানা অপকর্মে জড়িত। অভিযোগ দিলেও পুলিশ রহস্যজনকভাবে তাদের বিষয়ে নীরব। তিনি আরও বলেন, কিশোর অপরাধীদের একটা বড় অংশ উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ভাসমান জীবনযাপন করে। শুভাঢ্যা, আগানগর, জিনজিরা, বাস্তা, শাক্তা, কোন্ডা, তেঘরিয়া এলাকায় বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কর্মকান্ডের সঙ্গে তারা জড়িত।

গত ২ মে রাতে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার গোলামবাজার এলাকায় চারজনকে ছুরিকাঘাত করে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। এতে ঘটনাস্থলেই মারা যায় রুবেল আহমেদ। নিহতের মা মনোয়ারা বেগম ও বাবা আব্দুল খালেক বলেন, গোলামবাজার এলাকার মানুষ কিশোর গ্যাংয়ের অত্যাচারে অতিষ্ঠ। পুলিশ সব জেনেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয় না। ছেলে হত্যায় মামলা করলেও পুলিশ কাউকে ধরতে পারেনি। 

এ বিষয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক তৌহিদুল হক বলেন, 'কিশোরদের একত্রিত করে কতিপয় ব্যক্তি বিভিন্ন ধরনের অপরাধে সম্পৃক্ত করছেন। কোনো কোনো রাজনৈতিক নেতা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে কিশোর গ্যাং তৈরি করছে। তিনি বলেন, অস্ত্রবাজি, মাদক ও হত্যাসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকান্ডে তারা কিশোরদের ব্যবহার করে।'

অধ্যাপক তৌহিদুল হক বলেন, 'অপরাধে জড়িয়ে পড়া কিশোরদের স্বাভাবিক জীবনে ফেরাতে যে ধরনের কার্যক্রম দরকার তার কিছুই নেওয়া হচ্ছে না। আমাদের দেশে শিশুদের লালনপালন করার ক্ষেত্রে পরিবারগুলো শিক্ষা, চিকিৎসা এবং অন্যান্য বিষয়ে যথাযথভাবে দায়িত্বপালন করছে না। নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তানরা অপরাধে জড়ায় এমন একটি কথা সমাজে প্রচলিত আছে। কিন্তু এখন উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানরাও অপরাধে জড়াচ্ছে।'

ঢাকা জেলা পুলিশ সুপার আসাদুজ্জামান পিপিএম (বার) জানান, বিভিন্ন স্থানে এ ধরনের কিশোর গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। তারপরও জামিনে বেরিয়ে এসে পুনরায় একই রকম কাজে সম্পৃক্ত হওয়ার প্রবণতা রয়েছে। তবে এই অপরাধ দমনে পুলিশ চেষ্টা করছে। কেবলমাত্র আইন প্রয়োগ করে এই সমাধান সহজ নয়।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে