বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

নদী দখল আর দূষণে সুপেয় পানির সংকট

নদী দখল আর দূষণে সুপেয় পানির সংকট
আলতাব হোসেন
  ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০০:০০

শুষ্ক মৌসুমের শুরুতেই বাংলাদেশের দক্ষিণের খুলনা, বরিশাল, ঝালকাঠি, পিরোজপুরসহ উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষ সুপেয় পানির তীব্র সংকটে পড়েছে। জলবায়ুর প্রভাবে সবখানেই লবণজলের আগ্রাসন। উপকূলের মানুষকে ১০ কিলোমিটার দূরে গিয়ে এক কলসি পানি কিনে আনতে হচ্ছে। উপকূলীয় এলাকায় এক কলসি পানির দাম ৫০ থেকে ৮০ টাকা। উপকূলের নারীদের পানির সন্ধানে পাড়ি দিতে হয় দীর্ঘপথ। বিশুদ্ধ যাচাই-বাছাই তো দূরের কথা, কোনোমতে খাওয়া যায় এমন খাবার পানি জোগাড় করতেই উপকূলের নারীদের দিন চলে যায়। দেশের উত্তরের বরেন্দ্র অঞ্চলেও সুপেয় খাবার পানি এখন দুষ্প্রাপ্য।

দেশের অন্যান্য এলাকার মতো ঢাকাতেও ভূগর্ভস্থ পানির স্তর দ্রম্নত নিচে নেমে যাচ্ছে। ঢাকা মহানগরীতে ১৯৭০ সালে ৪৯টি গভীর নলকূপ ছিল। ঢাকার চারপাশের নদীগুলোর দূষিত পানি ব্যবহারের অনুপযোগী হওয়ায় ওয়াসা সুপেয় পানির চাহিদার শতকরা ৭৮ ভাগ ৯০০টি গভীর নলকূপের মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ থেকে উত্তোলন করছে। নদীর পানি দূষিত হওয়ার অজুহাতে ওয়াসা একের পর এক গভীর নলকূপ বসিয়ে যাচ্ছে। অথচ ওয়াসাকে নদীর পানি দূষণরোধে পয়ঃবর্জ্য পরিশোধনে কার্যকর তেমন কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করতে দেখা যাচ্ছে না।

এদিকে, ভূগর্ভস্থ পানি অধিক উত্তোলনের ফলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর প্রতি বছর ১০ ফুট করে নিচে নেমে যাচ্ছে। শিল্পকারখানার অপরিশোধিত বর্জ্য সরাসরি নদীতে ফেলা হচ্ছে। ফলে নদী দূষণের মাত্রা বেড়েই চলেছে। অন্য দিকে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে লবণাক্ত পানি উজানে প্রবাহিত হচ্ছে। নদী দূষণমুক্ত ও পানি প্রবাহ বৃদ্ধি করা না হলে এবং বর্তমান অবস্থা চলতে থাকলে আগামী ১৫ বছরের মধ্যে পানির অভাবে ঢাকা বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়বে বলে হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।

বাংলাদেশ নিরাপদ পানি আন্দোলনের সভাপতি

আনোয়ার হোসেন জানান, বছরে উজানের দেশগুলোর তিন বিলিয়ন টন পলি নদীবাহিত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। পলি পড়ে দেশের নদীগুলোর তলদেশ ক্রমান্বয়ে ভরাট হয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়াও নদীগুলো দখল, ভরাট ও দূষণের শিকার। ফলে নদীর পানি ধারণ ক্ষমতা প্রতিনিয়ত কমে যাচ্ছে, নৌ-চলাচল বিঘ্নিত হচ্ছে এবং নদীর পানি ব্যবহারের অনুপযোগী পড়ছে। ভাটির দেশ হিসেবে অভিন্ন নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা না পাওয়ায় আমাদের দেশে পানি সংকট আরো ঘনীভূত হচ্ছে এবং নৌ-চলাচল, সেচ ব্যবস্থা ও জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়ছে। এতে বর্ষা মৌসুমে বড় বড় বন্যায় দেশের অধিকাংশ এলাকা পানিতে তলিয়ে যায়। আবার শুষ্ক মৌসুমে পানির ঘাটতির অভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে।

এদিকে নদী নব্যতা হারিয়ে হাজার হাজার কিলোমিটার নৌপথ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ভাটির দেশ হিসেবে অভিন্ন নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা না পাওয়ায় দেশে পানি সংকট ঘনীভূত হচ্ছে। উত্তরাঞ্চলের নদীসমূহ শুষ্ক বালুচরে পরিণত হচ্ছে। লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিদ্যমান পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ ভয়াবহ পানি বিপর্যয়ের মুখোমুখি হবে।

পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন পবার চেয়ারম্যান আবু নাসের খান বলেন, পরিবেশ, প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষা এবং খাবার পানি সরবরাহ, নৌ-চলাচল, কৃষি ও শিল্প উৎপাদনে নদীর গুরুত্ব অপরিসীম। এ দেশে রয়েছে ছোট বড় ৪০৫টি নদী। যার মধ্যে অভিন্ন নদীর সংখ্যা ৫৭টি। ৫৪টি ভারতের এবং ৩টি মিয়ানমারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। দেশের নদীগুলোর ৪৮টি সীমান্ত নদী, ১৫৭টি বারোমাসি নদী, ২৪৮টি মৌসুমি নদী। মানুষের অত্যাচারে নদীগুলো আজ মৃতপ্রায়। দখল, ভরাট, আর বর্জ্যে নদীগুলো এখন নিস্তব্ধ স্রোতহীন এবং দূষণের ভারে পানি ব্যবহারের অযোগ্য এবং জীববৈচিত্র্য শূন্য হয়ে পড়ছে। ফলে পরিবেশ, প্রতিবেশ ও জীবন-জীবিকা আজ মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন। দেশের নদীগুলোর প্রায় প্রতিটিরই একই দশা।

তিনি আরও বলেন, তিস্তার পানি প্রবাহ ব্যাপক হারে কমে গেছে। পদ্মা, তিস্তা এখন মৃতপ্রায়, যমুনায় পড়েছে চর। বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু ও শীতলক্ষ্যা দখল, ভরাট ও দূষণের ভারে বিষাক্ত নিঃশ্বাস ফেলছে। যে পানির অপর নাম ছিল জীবন আজ সেই বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষ্যার পানির ওপর নাম বিষ হিসাবে পরিলক্ষিত হয়। যেখানে এখন জলজ ও প্রাণী বসবাসের অনুপযোগী হয়ে গেছে।

পরিবেশ আন্দোলন মঞ্চের সভাপতি আমির হাসান মাসুদ বলেন, রাজধানী ঢাকার চারদিকে নদী দ্বারা বেষ্টিত। প্রাকৃতিক পরিবেশসমৃদ্ধ এ ধরনের শহর পৃথিবীতে বিরল। এক গবেষণায় দেখা যায় যে, ঢাকায় জলাশয় ও নিম্নাঞ্চলের পরিমাণ ছিল ১৯৬০ সালে যথাক্রমে ২৯৫২ ও ১৩৫২৮ হেক্টর, ১৯৮৮ সালে যথাক্রমে ২১০৪ ও ১২৭১৮ হেক্টর এবং ২০০৮ সালে যথাক্রমে ১৯৯১ ও ৬৪১৫ হেক্টর। ইতিমধ্যে প্রায় ৭০ শতাংশ নিম্নাঞ্চল ভরাট করা হয়েছে। সরকারি ও বেসরকারিভাবে পালস্না দিয়ে চলছে ভরাট কার্যক্রম। ভরাটের এ গতি অব্যাহত থাকলে ২০৩০ সাল নাগাদ ঢাকার শতভাগ নিম্নাঞ্চল হারিয়ে যাবে।

এ বিষয়ে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেইঞ্জ অ্যান্ড অ্যানভায়রনমেন্ট রিসার্সের ইমেরিটাস অধ্যাপক আইনুন নিশাত বলেন, নদীর অবয়ব নির্ভর করে পানি ও পলল প্রবাহের ওপরে। এসবের পরিবর্তন হলে স্বাভাবিকভাবেই নদীর ভৌগোলিক পরিবর্তন আসে যার কারণে নদী ভাঙন দেখা দেয়। নদী ভাঙনের ফলে মানুষের বসতি ও ফসলি জমি তলিয়ে যাচ্ছে। ভাঙন রোধে নদী শাসনের কথা আসে, আর এই নদী শাসন করতে গেলে নদীর স্বাভাবিক অবস্থা ও প্রবাহগত চরিত্রের পরিবর্তন আসে। তাই এসব বিষয় বিবেচনা করে টেকসই সমাধানের পথ বের করতে হবে।

পরিবেশবিদ অ্যাডভোকেট নজরুল ইসলাম বলেন, পানি ও জলাধার সংরক্ষণের জন্য বাংলাদেশে প্রায় ২৩টি মতো আইন রয়েছে। ঢাকার চারপাশের চার নদী বাঁচাতে ২০০৯ সালের ২৫ জুন হাইকোর্ট ১২ দফা নির্দেশনা দেন। নদী তীরবর্তী অবৈধ স্থায়ী ও অস্থায়ী স্থাপনা উচ্ছেদে এসব নির্দেশনা দেওয়া হয়। নদীর সীমানা নির্ধারণ করে সীমানায় পাকা খুঁটি বসানো, নদীর তীরে হাঁটার পথ নির্মাণ, নদীর তীরে বনায়ন করা, নদীগুলো খনন করা, নদীর তীরের জমি সিএ ও আরএস অনুসারে জরিপ করা, যমুনার সঙ্গে ঢাকার চারপাশের বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষ্যা ও বালু নদের পানিপ্রবাহ বাড়ানোর জন্য নিয়মিত খনন কাজ পরিচালনা করাসহ ওই নির্দেশনা দেন হাইকোর্ট। এ জন্য ভূমি, স্বরাষ্ট্র, অর্থ, নৌ-পরিবহণ, বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের সচিব, ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও মুন্সীগঞ্জের জেলা প্রশাসক, পরিবেশ অধিদপ্তর, ঢাকা সিটি করপোরেশন, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহণ কর্তৃপক্ষ ও ভূমি জরিপ অধিদপ্তরকে এই নির্দেশনাগুলো বাস্তবায়নের নির্দেশ দেওয়া হয়। হইকোর্টের নির্দেশনা অমান্য করে দখল বাণিজ্য অব্যাহত আছে। বিগত সময়ে অপর এক নির্দেশনা দেশের সব পুকুরগুলোকে সংরক্ষণের জন্য আদালত নির্দেশনা প্রদান করেন। সেই নির্দেশনায় সরকারি ছাড়াও ব্যক্তিগত পুকুরও ভরাট করা যাবে না বলে নির্দেশনা দেওয়া হয়। অথচ প্রকাশ্যে সরকারি-বেসরকারি পুকুর-জলাশয় ভরাট করা হচ্ছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে