প্রায়ই দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে গার্মেন্টের পণ্য চুরি করে একটি চক্র। তাও সব পণ্য নয়, রপ্তানির জন্য প্রস্তুত করা উন্নমানের পণ্য। এতে স্বাভাবিক কারণেই সময়মতো বিদেশে পণ্য সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না। যা দেশের গার্মেন্ট শিল্পের জনপ্রিয়তাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। চলমান বৈশ্বিক মন্দার মধ্যে রপ্তানির পথে গার্মেন্ট পণ্য চুরির কারণে দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। বিপুল অঙ্কের রেমিট্যান্স হারাচ্ছে দেশ। গার্মেন্ট পণ্য চুরির সঙ্গে জড়িত চক্রের চারজনকে গ্রেপ্তার করেছের্ যাব। তাদের মধ্যে রয়েছে চোরচক্রের মূলহোতা শাহেদ ওরফে সাঈদ ওরফে বদ্দা। তাদের কাছে পাওয়া গেছে কোটি কোটি টাকার গার্মেন্ট পণ্য। পণ্যগুলো ব্রাজিলে পাঠিয়ে বিপুল অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা
পাওয়ার কথা ছিল।
শনিবার ঢাকার কারওয়ান বাজারর্ যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বাহিনীটির আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন আরও জানান, দেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি তৈরি পোশাক শিল্প। যা দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বাংলাদেশ তৈরি পোশাক শিল্প রপ্তানিতে বিশ্বে দ্বিতীয়। দেশের মোট রপ্তানি আয়ের ৮২ শতাংশই আসে তৈরি পোশাক রাপ্তানি খাত থেকে।
বিগত কয়েক বছর ধরে কয়েকটি চক্র বেপরোয়াভাবে গার্মেন্টস পণ্য চুরি করে চোরাইপথে বিক্রি করছিল। চুরির ঘটনাটি জানা যায় গার্মেন্টস পণ্য রপ্তানির শেষ ধাপে।
তিনি বলছেন, বিক্রেতা গার্মেন্টস পণ্য বিদেশে পাঠানোর সময় পণ্যের ঘাটতি দেখে বুঝতে পারেন, পণ্য চুরি হয়ে গেছে। আর বিদেশিরা পণ্য গ্রহণের সময় বুঝতে পারেন নির্ধারিত চাহিদার বিপরীতে মালমাল কম এসেছে। এমন পরিস্থিতিতে ক্রেতা বিক্রেতার মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়। ক্রেতা ধরে নেন, বিক্রেতা ইচ্ছে করেই মালামাল কম দিয়েছেন, অধিক লাভের জন্য। এতে ওই ক্রেতা আর বিক্রেতার কাছ থেকে কোনো দিনই পণ্য কেনেন না। এমনকি ক্রেতার পরিচিতজনদেরও বিষয়টি বলে দেন। এমন পরিস্থিতিতে বিদেশে ক্রেতার পাশাপাশি দেশের ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়। অনেক সময়ই ক্রেতা এমন পরিস্থিতিতে ক্ষিপ্ত হয়ে বিক্রেতাকে দ্বিগুণ বা তিনগুণ বেশি টাকা দিতে বলেন বা জরিমানা করেন। এমন বহু অভিযোগর্ যাবের কাছে রয়েছে।
র্
যাব কর্মকর্তা জানান, বছরের পর বছর ধরে এমন পরিস্থিতির কারণে দেশকে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি আয় থেকে বঞ্চিত হতে হয়েছে। এমনকি গার্মেন্ট শিল্পকে ধ্বংসের পথে নিয়ে গেছে এই চোরাই চক্র। এমন পরিস্থিতি থেকে রেহাই পেতে ২০২১ সালে বিজিএমইএ ও বিকেএমইএর একটি যৌথ দল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেন।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা মোতাবেক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট গার্মেন্টস পণ্য চুরি ঠেকাতে জোরালোভাবে কার্যক্রম শুরু করেন। তারই ধারাবাহিকতায় ২০২১ সালের আগস্ট থেকে অদ্যাবধি গাজীপুর, আশুলিয়া, মিরপুর, আমিনবাজার, কুমিলস্না, নারায়ণগঞ্জ ও ডেমরা এলাকা থেকে গার্মেন্টস পণ্য চোরাই চক্রের কয়েকটি দলের অন্তত ৫০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের কাছে পাওয়া গেছে চুরি করা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৫০ লাখ টাকার গার্মেন্টস পণ্য।
র্
যাব কর্মকর্তা কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানান, গত বছরের ২৯ অক্টোবর গাজীপুর জেলার কোনাবাড়ীর একটি তৈরি পোশাক কারখানা থেকে বিপুল গার্মেন্ট পণ্য ব্রাজিলে রপ্তানির জন্য পাঠানো হয় কাভার্ড ভ্যানযোগে। কাভার্ডভ্যানগুলো চট্টগ্রাম বন্দরে যাচ্ছিল। পরদিন প্রায় ৯০০ কার্টনভর্তি সোয়েটার চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছায়। পণ্যগুলো একটি জাহাজে ব্রাজিলে যাবে। এজন্য বিদেশি ক্রেতা জাহাজ কোম্পানিকে ভাড়া বাবদ ১ কোটি ২৫ হাজার মার্কিন ডলার পরিশোধ করেন। জাহাজটি যথারীতি মালামাল নিয়ে ব্রাজিলে রওনা হয়।
চলতি বছরের ৬ জানুয়ারি ব্রাজিলের ওই ক্রেতা বাংলাদেশের ওই বিক্রেতার কাছে একটি ভিডিও পাঠায়। ভিডিওতে দেখা যায় কিছু কার্টন সম্পূর্ণ খালি। অনেক কার্টন থেকে প্রচুর পণ্য চুরি হয়ে গেছে। পরে ক্রেতা চুরি হওয়া পণ্যের সমপরিমাণ অর্থ জরিমানা করেন বিক্রেতাকে। বিক্রেতা নিজের ব্যবসা ও দেশের সুনাম রক্ষায় তা দিয়ে দেন। এ ঘটনায় গত ২ জানুয়ারি গাজীপুরের গাছা থানায় একটি জিডি করেন ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী।
গত ৩ ফেব্রম্নয়ারির্ যাব-৪ এর গোয়েন্দারা মৌলভীবাজার, গোপালগঞ্জ ও ঢাকার আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালায়। অভিযানে গ্রেপ্তার করা হয় আলোচিত ওই গার্মেন্টস পণ্য চুরির সঙ্গে জড়িত মূলহোতা শাহেদ ওরফে সাঈদ ওরফে বদ্দা (৫২), তার সহযোগী ইমারত হোসেন সজল (৩৭), শাহজাহান ওরফে রাসেল ওরফে আরিফ (৩০) ও হৃদয়কে (২৮)।
গ্রেপ্তার শাহেদের বরাত দিয়ের্ যাব কর্মকর্তা জানান, শাহেদের অন্তত ৫০ জনের একটি চক্র রয়েছে। এই চক্রে চালক, হেলপার, গোডাউন মালিক, গোডাউন এলাকার আশ্রয়দাতা, কুলি সর্দার ও লেবার। তারা প্রথমে ট্রান্সপোর্টে গার্মেন্টের মালামাল বহন শুরু করে। এক পর্যায়ে তারা গার্মেন্ট পণ্য পরিবহণের সঙ্গে জড়িত কাভার্ডভ্যানের ড্রাইভার, হেলপার দলে ভেড়ায়। তাদের গার্মেন্ট পণ্য চুরি করতে উৎসাহিত করে। প্রত্যেকটি চুরির ঘটনা ঘটানোর আগে চালকের মাধ্যমে রপ্তানিকৃত গার্মেন্ট পণ্যের স্যাম্পল সংগ্রহ করত তারা। স্যাম্পলের ছবি তুলে ক্রেতার কাছে পাঠাত। ছবি দেখে দরদাম ঠিক হতো।
ঘটনার দিন পণ্যবাহী কাভার্ডভ্যান ডেমরা থানাধীন মিরপাড়ার আয়েশা প্যাকেজিং ভবনের গোডাউনে নিয়ে যায়। সেখানে কার্টন থেকে পণ্য চুরি করা হয়। চুরির পর আবার প্যাকিং করে কার্টনগুলো চট্টগ্রাম বন্দরে পাঠিয়ে দেয়। চুরির সঙ্গে জড়িত কাওছার, নাজিম ও মাসুম গত বছরের ২৪ ডিসেম্বরর্ যাব-৪ এর হাতে অন্য মামলা গ্রেপ্তার হয়। তারা জেলহাজতে রয়েছে। তাদেরও এ মামলায় আসামি করা হয়েছে।
র্
যাব কর্মকর্তা জানান, শাহেদ চট্টগ্রামে থাকাকালে ১৯৯৬ সালে ২টি ট্রাক কিনে লোকাল ব্যবসা শুরু করে। ২০০৪ সালে ট্রাক দুটি বিক্রি করে ৪টি কাভার্ডভ্যান কিনে গার্মেন্ট পণ্য পরিবহণ শুরু করে। কাভার্ডভ্যানের ড্রাইভার ও হেলপারদের নিয়ে গার্মেন্ট পণ্য চুরির সিন্ডিকেট গড়ে তুলে। ২০১৮ সাল পর্যন্ত নিজেই চুরিতে অংশ নিত। এরপর থেকে সে নিজেকে আড়াল করে চুরি সংঘটিত করছিল। গত ১৮ বছর ধরে শাহেদ গার্মেন্ট পণ্য চুরির মাস্টারমাইন্ড হিসেবে কাজ করছিল। মৌলভীবাজার শহরে শাহেদ প্রায় ২০ কোটি টাকা খরচ করে বাড়ি করেছে। মৌলভীবাজারের দুর্লভপুরে তার প্রায় ২০ একর জমির ওপর মাছের খামারসহ বিশাল দুটি হাঁস-মুরগির খামার গড়ে তুলেছে। তার ৪টি কাভার্ডভ্যানসহ তার সহযোগীদের আরও ১৫টি কাভার্ডভ্যান আছে। তার বিরুদ্ধে অন্তত ১৮টি গার্মেন্ট পণ্য চুরির মামলা আছে। অধিকাংশ মামলায় সে কারাভোগ করেছে। ৬টি মামলার বিচার চলছে।
গ্রেপ্তার ইমারত হোসেন সজল ২০১২ সাল থেকে ঢাকার উত্তরায় গার্মেন্ট পণ্যের স্টকলটের ব্যবসা শুরু করে। ব্যবসার সুবাদে গার্মেন্ট পণ্য চুরি জগতের গডফাদার শাহেদ, কাউছারসহ অনন্য সদস্যদের সঙ্গে তার পরিচয়। শাহেদের মাধ্যমে কমদামে চোরাইকৃত গার্মেন্টস পণ্য কিনে স্টক করে সুবিধাজনক সময়ে বেশি দামে স্থানীয় মার্কেটসহ বিভিন্নভাবে বিক্রয় করত। গত ২ বছরে সে শাহেদের মাধ্যমে প্রায় ২০০টি গার্মেন্ট পণ্য চুরির ঘটনা ঘটিয়েছে। বিপুল অবৈধ টাকার মালিক হয়েছে সে।
গ্রেপ্তার শাহজাহান কাভার্ডভ্যানের হেলপার ছিল। ৭ বছর আগে চোর চক্রের মাস্টারমাইন্ড শাহেদের মাধ্যমে এই চক্রে জড়িয়ে পড়ে। পরে সে চালক হয়। ব্রাজিলে রপ্তানীকৃত চুরি হওয়া গার্মেন্টস পণ্য বহনকারী কাভার্ডভ্যানের চালক ছিল সে। ৭ বছরে সে অন্তত শতাধিক চুরির ঘটনা ঘটিয়েছে। তার বিরুদ্ধে গার্মেন্ট পণ্য চুরির ২টি মামলা আছে।
গ্রেপ্তার হৃদয় এই চক্রের মাস্টারমাইন্ড শাহেদের নিজস্ব কাভার্ডভ্যানের হেলপার। ৭ বছর ধরে সে চোর চক্রের সঙ্গে জড়িত। অন্তত শতাধিক চুরির ঘটনার সঙ্গে জড়িত। তার বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে ১টি মামলা আছে।
র্
যাব কর্মকর্তা জানান, কার্ভাডভ্যান থেকে চুরি করা গার্মেন্ট পণ্যের স্যাম্পল দেখিয়ে দেশীয় ক্রেতাদের সঙ্গে দাম দর ঠিক করত। নূ্যনতম ১০ থেকে ১২ লাখ টাকার নিচের মূল্যমানের গার্মেন্ট পণ্য চুরি করত না তারা। পণ্য চুরির জন্য চালক পেত ৩০ হাজার, হেলপার ২০ হাজার, গোডাউনের মালিক ৫০ হাজার, গোডাউন এলাকার আশ্রয়দাতা ৬০ হাজার, কার্টন প্যাকেজিং এক্সপার্ট ১০ হাজার, অন্যান্য লেবার প্রত্যেকে ২ থেকে ৩ হাজার টাকা পেত।
বাকি টাকা দলের সদস্যরা নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিত। চালক ও হেলপার পণ্যবাহী কাভার্ডভ্যানটি নির্দিষ্ট গোডাউনে নিয়ে যেত। সেখানে কার্টন কেটে গার্মেন্ট পণ্যগুলো আলাদা করে রাখত। প্রথমে তারা ১০ পিসের কার্টন থেকে ৪ পিস এবং ২০ পিসের কার্টন থেকে ৬ থেকে ৮ পিস গার্মেন্ট পণ্য সরিয়ে রাখত। এরপর আবার প্যাকেট করত। যাতে না বোঝা যায়। এরপর সেসব কার্টন বন্দরে পাঠানো হতো। চুরি করা পণ্য কাভার্ড ভ্যানযোগে অন্য একটি গোডাউনে নিয়ে রাখত। এক বা দেড় মাস পরে সেগুলো বিক্রি করত। চোরাই পণ্যগুলো রাজধানীর উত্তরাসহ বিভিন্ন অসাধু বায়িং হাউসের কাছে বিক্রি করত।