শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

দখলদারদের রক্ষায় ব্যস্ত নদী রক্ষা কমিশন

প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ উপেক্ষিত!
যাযাদি রিপোর্ট
  ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০০:০০

নদীমাতৃক বাংলাদেশ থেকে ক্রমেই হারিয়ে গেছে অনেক নদী বা খাল-বিল। নদী খেকোরা গিলে খেয়েছে পানি ও পরিবেশ সংরক্ষণের প্রাকৃতিক এ আধার। ফলে পরিবেশ ধ্বংস হওয়ার পাশাপাশি মানবজীবনে সংকট বেড়েছে। এ সংকট মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বারবার পরিবেশ রক্ষা ও নদী-খালবিল দখলমুক্ত করার নির্দেশ দিলেও তা আমলে নিচ্ছেন না সংশ্লিষ্টরা।

এ পরিস্থিতিতে দেশের নদনদী দখলদারদের তালিকা তৈরিতে একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছিল জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন (এনআরসিসি)। গত ডিসেম্বরে প্রকল্পটির মেয়াদ শেষ হয়েছে। এর মাধ্যমে ৩৭ হাজার ৩৯৬ নদ-নদী দখলদারকে চিহ্নিত করা হয়, যা এনআরসিসির ওয়েবসাইটেও প্রকাশ করা হয়েছিল। কিন্তু ডিসেম্বরেই এক সভায় নেয়া সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে সে তালিকা ওয়েবসাইট থেকে মুছে দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। এমনকি প্রকল্পের প্রতিবেদনও গ্রহণ করেনি কমিশন।

কমিশনের এমন সিদ্ধান্তকে দেশের নদ-নদীর ওপর স্মরণকালের সবচেয়ে বড় আঘাত উলেস্নখ করে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, 'বৈঠকে সিদ্ধান্তের মাধ্যমে দখলদারদের পক্ষ নিয়ে তথ্য মুছে দেয়ার মতো ন্যক্কারজনক ঘটনা এই প্রথম দেখলাম আমরা। হাইকোর্ট জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের রিপোর্ট আমলে নিয়ে উচ্ছেদের নির্দেশ দিয়েছিলেন। সেটি বাস্তবায়ন না করে দখলদারদের বাঁচানোর পাঁয়তারা ভয়াবহ রকম অন্যায় বলে মনে করি। কমিশনের এমন জনবিচ্ছিন্ন কর্মকান্ড যদি আরও বেশি দিন চালু থাকে, তাহলে দেশে নদ-নদীর অস্তিত্ব বিলীন হওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র।'

অভিযোগ উঠেছে, নদী রক্ষা কমিশনের বর্তমান চেয়ারম্যান ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরী নদী রক্ষা না করে বরং নদী খেকোদের রক্ষার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তার আত্মীয়-স্বজনসহ সংশ্লিষ্ট অনেকেই নদী দখলদার। তাদের আড়াল করতে জেলা প্রশাসকদের মাধ্যমে তৈরি নদী দখলদারদের তালিকা সংশোধন বা বাতিল করার উদ্যোগ নিয়েছেন তিনি।

সম্প্রতি ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে (ডিআরইউ) ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশ আয়োজিত এক কর্মশালায় এমন অভিযোগ তুলেছেন নদী রক্ষা কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মুজিবর রহমান হাওলাদার। তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন মনজুর আহমেদ চৌধুরী।

মুজিবর রহমান হাওলাদার বলেন, 'কমিশন থেকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে এবং দেশের আইন মেনে দখলদারদের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু চেয়ারম্যান ওই তালিকা প্রকাশ না করে পুনর্মূল্যায়নের নামে তালিকা থেকে অনেক দখলদারের নাম বাতিল করতে চান। দখলদারের নাম তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার জন্য আর্থিক সুবিধা নেওয়ার কথাও আমরা শুনতে পাচ্ছি।'

তিনি বলেন, সরকারের একজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী আমাকে একদিন বললেন, 'আপনারা মাঠপর্যায়ে গিয়ে তালিকা করার দরকার নেই। ঢাকায় বসে কাজ করলেই চলবে। কিন্তু আমি ওই মন্ত্রীর এলাকায় গিয়ে দেখি তার বাবার আমল থেকে দুটি শিল্পকারখানা নদী দখল করে চালানো হচ্ছে।'

তিনি আরও বলেন, 'অনেক সংসদ সদস্য, উপজেলা চেয়ারম্যান ও প্রভাবশালী নেতা নদী দখল করে আছেন। তাদের নাম বাদ দিতে বর্তমান চেয়ারম্যান দখলদারদের তালিকা সংশোধন করছেন।'

নদী রক্ষা কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান বলেন, 'দেশে নদী যে দখল ও দূষণের শিকার হচ্ছে, তা বুঝতে বিজ্ঞান ও গবেষণার দরকার হয় না। নদীর পাশ দিয়ে হেঁটে গেলেও বোঝা যায়। নদী রক্ষা কমিশনের কাজ ছিল এরই মধ্যে চিহ্নিত হওয়া দখলদারদের উচ্ছেদে উদ্যোগ নেওয়া। যাদের নদী দখলদারদের তালিকা যাচাই-বাছাই করার দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে, তাদের সম্পদের হিসাব নিলে ওই তালিকা সংশোধনের আসল কারণ বেরিয়ে আসবে।'

ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরী নিয়োগপত্রের শর্তও রাখেননি অভিযোগ করে মুজিবর রহমান হাওলাদার বলেছেন, জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন আইন ২০১৩ এর ধারা ৫(২) এবং একই আইনের ধারা ৫(৩) অনুযায়ী ড. মনজুরকে অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের সঙ্গে কর্মসম্পর্ক পরিত্যাগের শর্তে নিয়োগ দেওয়া হলেও তিনি সেই শর্ত ভঙ্গ করে নদী দখল করে আত্মীয়-স্বজনের মাধ্যমে পরিচালিত ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। অন্যদিকে তিনি চেয়ারম্যানের দায়িত্বে বসার পর ক্ষমতার অপব্যবহার করছেন। কমিশনের সুপারিশ করার ক্ষমতা থাকলেও তিনি নিজেই নির্দেশ দিয়ে লিখিত চিঠি পাঠিয়েছেন। এটি নিয়োগবিধির লঙ্ঘন।'

তবে এসব অভিযোগ বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের বর্তমান চেয়ারম্যান মনজুর আহমেদ চৌধুরী বলেন, 'সাবেক চেয়ারম্যানের এসব অভিযোগ মিথ্যা ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। দখলদারদের তালিকা তৈরির প্রক্রিয়ার সঙ্গে তিনি (মুজিবর রহমান হাওলাদার) জড়িত ছিলেন না। তিনি দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়ার পর আমি চেয়ারম্যান থাকা অবস্থায় ওই তালিকা তৈরি করা হয়। কিন্তু তালিকায় বেশ কিছু ভুল-ত্রুটি ধরা পড়ায় আমরা তা সংশোধন করছি। কোনোভাবেই তা বাতিল করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি।'

এ বিষয়ে কমিশনের সদস্যদের বক্তব্য হলো, হাইকোর্টের এক রায়ে সিএস রেকর্ডের ভিত্তিতে অবৈধ দখলদারদের চিহ্নিত করতে বলা হয়েছিল। কিন্তু প্রকল্পে তাদের চিহ্নিত করা হয়েছে পানি আইন ২০১৩-এর ভিত্তিতে। এ কারণে প্রকল্পে চিহ্নিত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নাম ও তালিকা কমিশনে দেয়া প্রতিবেদনে এবং ডাটাবেজে অন্তর্ভুক্ত করা যাবে না এবং তা প্রকাশ করা যাবে না।

কিন্তু ১৯৪০ সালে করা সিএস রেকর্ডে চিহ্নিত সব নদ-নদীর অবস্থান এখন আগের জায়গায় নেই জানিয়ে প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা বলছেন, পানি আইনে নদীর সীমানা ও ফোরশোরকে (তীরবর্তী ভূমি) সুস্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। আবার আলোচিত প্রকল্পটিতে দখলদারদের চিহ্নিত করতে শুধু পানি আইন নয়, বন্দর আইন ও ভূমি আইনেরও সহায়তা নেয়া হয়েছিল। পাশাপাশি দখলদার চিহ্নিত করতে জিপিএস ব্যবহার এবং ুসরেজমিন পরিদর্শনও করা হয়েছিল।

আইনগুলোর সঙ্গে হাইকোর্টের রায়ের কোনো বিরোধ নেই জানিয়ে পরিবেশ আইনবিদরা বলছেন, এগুলো বরং একটি আরেকটির পরিপূরক। আবার সিএস রেকর্ডেও দেশের সব নদ-নদীর সীমানার হালনাগাদ তথ্য নেই। সুতরাং কমিশনের দখলদারদের তালিকা মুছে দেয়ার বিষয়টিকে যৌক্তিক বলা যাচ্ছে না কোনোভাবেই।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে