একুশে গ্রন্থমেলা আজ শুরু এবার বেড়েছে পরিসর

প্রকাশ | ০১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০০:০০ | আপডেট: ০১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০০:১৩

যাযাদি রিপোটর্
অমর একুশে গ্রন্থমেলা উপলক্ষে বৃহস্পতিবার বাংলা একাডেমি আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন একাডেমির মহাপরিচালক হাবিবুল্লাহ সিরাজী Ñআমিনুল ইসলাম শাহীন

বছর ঘুরে আবার আসছে ভাষার মাস ফেব্রæয়ারি, ঢাকার বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ আর সোহরাওয়াদীর্ উদ্যানে চলছে অমর একুশে গ্রন্থমেলার শেষ মুহূতের্র প্রস্তুতি। আয়োজকরা জানান, বইমেলা এবার পরিসরে বেড়েছে; সে সঙ্গে বেড়েছে অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা। সোহরাওয়াদীর্ উদ্যানে গতবার ২ লাখ ৭৫ হাজার বগর্ফুট জায়গাজুড়ে বইমেলার আয়োজন হয়েছিল, এবার তা বিস্তৃত হয়েছে ৩ লাখ বগর্ফুটে। এবারের গ্রন্থমেলার প্রতিপাদ্য ঠিক হয়েছে ‘বিজয় : ১৯৫২ থেকে ১৯৭১ নবপযার্য়’। এ প্রতিপাদ্য সামনে রেখে সোহরাওয়াদীর্ উদ্যানের স্বাধীনতা স্তম্ভকেও এবার মেলা প্রাঙ্গণের ভেতরে রাখা হয়েছে। অমর একুশে গ্রন্থমেলায় এবার অংশ নিচ্ছে ৪৯৯টি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান; গতবার যার সংখ্যা ছিল ৪৬৫টি। ছুটির দিন ছাড়া প্রতিদিন বিকাল ৩টা থেকে রাত ৯টা বইমেলা সবার জন্য খোলা। এছাড়া শুক্র ও শনিবার বেলা ১১টা থেকে রাত ৯টা এবং একুশে ফেব্রæয়ারি সকাল ৮টা থেকে রাত সাড়ে ৮টা পযর্ন্ত মেলা চলবে। বৃহস্পতিবার সকালে বাংলা একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ মিলনায়তনে এক সংবাদ সম্মেলনে অমর একুশে গ্রন্থমেলা-২০১৯ এর আয়োজনের বিস্তারিত তুলে ধরে একাডেমি কতৃর্পক্ষ। আজ বিকাল ৩টায় বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে অমর একুশে গ্রন্থমেলার উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের সভাপতিত্বে এ অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি থাকবেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ বাবু, ভারতীয় কবি শঙ্খ ঘোষ, মিশরীয় লেখক-গবেষক মোহসেন আল আরিশি। স্বাগত ভাষণ দেবেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হাবিবুল্লাহ সিরাজী। বেড়েছে পরিসর: গ্রন্থমেলা কমিটির সদস্য সচিব ও বাংলা একাডেমির পরিচালক (বিপণন) জালাল আহমেদ সংবাদ সম্মেলনে জানান, বাংলা একাডেমি ও সোহরাওয়াদীর্ উদ্যান মিলিয়ে এবার গ্রন্থমেলার বিস্তৃতি বেড়েছে ২৫ হাজার বগর্ফুট। সোহরাওয়াদীর্ উদ্যানে মেলার অংশকে এবার চারটি চত্বরে বিন্যস্ত করা হয়েছে। সব মিলিয়ে ৪৯৯টি প্রতিষ্ঠানকে ৭৭০টি ইউনিট এবং বাংলা একাডেমিসহ ২৪টি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানকে ২৪টি প্যাভিলিয়ন বরাদ্দ দেয়া হয়েছে এবার। এর মধ্যে একাডেমি প্রাঙ্গণে ১০৪টি প্রতিষ্ঠান ১৫০টি ইউনিট নিয়ে তাদের বইয়ের পসরা সাজাবে। আর সোহরাওয়াদীর্ উদ্যানে ৬২০টি ইউনিট নিয়ে হবে ৩৯৫টি প্রতিষ্ঠানের স্টল। বহেরা তলায় লিটল ম্যাগাজিন চত্বরে ১৮০টি লিটল ম্যাগাজিনকে ১৫৫টি স্টল দেয়া হয়েছে এবার। এর মধ্যে ২৫টি স্টলে দুটি করে লিটল ম্যাগাজিনকে জায়গা দেয়া হয়েছে। অন্য ১৩০টি ম্যাগাজিন একক স্টল পেয়েছে। একক ক্ষুদ্র প্রকাশনা সংস্থা এবং ব্যক্তি উদ্যোগে যারা বই প্রকাশ করছেন, তাদের বই বিক্রি বা প্রদশের্নর ব্যবস্থা থাকবে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের স্টলে। বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে তিনটি ইউনিট বরাদ্দ পেয়েছে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র। একাডেমি প্রাঙ্গণ ও সোহরাওয়াদীর্ উদ্যানে বাংলা একাডেমির একটি প্যাভিলিয়ন এবং চারটি ইউনিটের দুটি স্টল থাকবে। এবারও মেলার সোহরাওয়াদীর্ উদ্যান অংশে থাকবে ‘শিশু চত্বর’। এই কনার্রকে শিশুকিশোর বিনোদন ও শিক্ষামূলক অঙ্গসজ্জায় সাজানো হচ্ছে। মাসব্যাপী গ্রন্থমেলায় এবারও প্রতি শুক্র ও শনিবারে একটি সময়কে ঘোষণা করা হবে ‘শিশু প্রহর’। খুদে লেখকদের জন্য এবার শিশু চত্বরে ‘তারুণ্যের বই’ নামে একটি নতুন আয়োজন থাকছে, যেখানে খুদে লেখকরা তাদের বইয়ের প্রচারণা করতে পারবে। বই কিনলে ছাড় গ্রন্থমেলায় বাংলা একাডেমি ও মেলায় অংশগ্রহণকারী অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ২৫ শতাংশ কমিশনে বই বিক্রি করবে। বিকাশের চিফ মাকেির্টং অফিসার মীর নওবাত আলী সংবাদ সম্মেলনে জানান, বিকাশে বইয়ের মূল্য পরিশোধ করলে ওই ২৫ শতাংশ ছাড়ের পর আরও ১০ শতাংশ মূল্য ছাড় পাবেন ক্রেতারা। প্রবেশ ও নিরাপত্তা টিএসসি ও দোয়েল চত্বরের দিকে হচ্ছে গ্রন্থমেলার মূল দুই প্রবেশপথ। বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে ঢোকা আর বের হওয়া যাবে তিনটি পথ দিয়ে। আর সোহরাওয়াদীর্ উদ্যানে প্রবেশ ও বের হওয়ার জন্য মোট ছয়টি পথ থাকবে। বিশেষ দিনগুলোতে লেখক, সাংবাদিক, প্রকাশক, বাংলা একাডেমি ফেলো এবং রাষ্ট্রীয় সম্মাননাপ্রাপ্ত নাগরিকদের জন্য প্রবেশের বিশেষ ব্যবস্থা করা হবে। গ্রন্থমেলায় প্রবেশ ও বের হওয়ার পথে থাকবে আচর্ওয়ের ব্যবস্থা। এছাড়া ৩ শতাধিক ক্লোজড সাকির্ট ক্যামেরায় মেলা প্রাঙ্গণ ও আশপাশের এলাকায় চলবে নজরদারি। সমগ্র মেলা প্রাঙ্গণ ও দোয়েল চত্বর থেকে টিএসসি হয়ে শাহবাগ, মৎস্য ভবন, ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউট হয়ে শাহবাগ, দোয়েল চত্বর থেকে শহীদ মিনার হয়ে টিএসসি, দোয়েল চত্বর থেকে চানখারপুল, টিএসসি থেকে নীলক্ষেত পযর্ন্ত সড়কে পযার্প্ত আলোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। সোহরাওয়াদীর্ উদ্যানের স্বাধীনতা স্তম্ভ এবং আশপাশের এলাকাকে এবার গ্রন্থমেলার সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। এর ফলে স্বাধীনতা স্তম্ভের আলোক বিচ্ছুরণে মেলা প্রাঙ্গণও আলোকিত হবে। বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হাবিবুল্লাহ সিরাজী বলেন, ‘এবার বইমেলা আয়োজনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে স্বাধীনতা অজের্নর ৫০ বছর পূতির্ ও বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবষের্র আয়োজন। মহান দুই আয়োজন নিয়ে এই বইমেলা থেকেই জাতিকে বাতার্ দিতে চাই আমরা। তাই মেলার নান্দনিক ব্যবস্থাপনায় পরিবতর্ন এসেছে।’ এবারও মেলার নান্দনিক দিক দেখভাল করছে নিরাপদ মিডিয়া। ইলিয়াস কাঞ্চনের এই ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে প্রতিবারই অব্যবস্থাপনার অভিযোগ ওঠে। তবে বাংলা একাডেমি টানা তৃতীয়বারের মতো তাদের ওপরই ভরসা রাখছে। গ্রন্থমেলায় নানা পুরস্কার ২০১৮ সালে প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্য থেকে ‘মান বিচারে’ সেরা গ্রন্থের জন্য প্রকাশককে ‘চিত্তরঞ্জন সাহা স্মৃতি পুরস্কার’ এবং ২০১৮ সালে গ্রন্থমেলায় প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে থেকে ‘ শৈল্পিক বিচারে’ সেরা বই প্রকাশের জন্য তিনটি প্রতিষ্ঠানকে ‘মুনীর চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার’ দেবে বাংলা একাডেমি। এছাড়া ২০১৮ সালে মান বিচারে সবাির্ধক বই প্রকাশের জন্য একটি প্রতিষ্ঠানকে ‘রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই স্মৃতি পুরস্কার’ এবং স্টলের নান্দনিক শৈলীর বিচারে ‘শ্রেষ্ঠ’ বিবেচিত প্রতিষ্ঠানকে ‘কাইয়ুম চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার’ দেয়া হবে। মেলা মঞ্চের নানা আয়োজন এ বছর থেকেই গ্রন্থমেলায় শুরু হচ্ছে নতুন মঞ্চ ‘লেখক বলছি’। সোহরাওয়াদীর্ উদ্যানে জলাধারের পাশে এই মঞ্চে প্রতিদিন পঁাচজন লেখক যোগ দেবেন। তারা কথা বলবেন তাদের প্রকাশিত বই নিয়ে; পাঠকের প্রশ্নের জবাবও দেবেন। মেলার বাংলা একাডেমি অংশ একজন ভাষা শহীদের নামে, এবং সোহরাওয়াদীর্ উদ্যানে চারজন ভাষা শহীদের নামে মোপ পঁাচটি চত্বর থাকছে। এছাড়া বঙ্গবন্ধুর সাতই মাচের্র ভাষণ এবং স্বাধীনতা স্তম্ভ নিয়ে বিভিন্ন তথ্য সম্বলিত প্ল্যাকাডর্ বসানো হয়েছে মেলা প্রাঙ্গণে। গ্রন্থমেলা কমিটির সদস্য সচিব জালাল আহমেদ বলেন, ‘এতে গ্রন্থমেলার মূল থিম যেমন প্রতিফলিত হবে, তেমনি নব প্রজন্মের তরুণ-তরুণীরা মেলায় আরও বেশি করে নিজেদের যুক্ত করতে এবং বায়ান্ন ও একাত্তরের চেতনায় ঋদ্ধ হওয়ার সুযোগ পাবেন।’ ২ ফেব্রæয়ারি থেকে ২৮ ফেব্রæয়ারি প্রতিদিন বিকাল ৪টায় গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে হবে সেমিনার। শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতি, রাজনীতি, সমকালীন প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা হবে সেখানে। এছাড়া বাঙালি মনীষার জন্ম শতবাষির্কীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি এবং তাদের জীবন ও কমর্ নিয়ে আলোচনা হবে মূলমঞ্চে। প্রতিদিন সন্ধ্যায় থাকবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, কবি কণ্ঠে কবিতা পাঠ। পাশাপাশি শিশু-কিশোর চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, সাধারণ জ্ঞান ও উপস্থিত বক্তৃতা এবং সংগীত প্রতিযোগিতারও আয়োজন করেছে বাংলা একাডেমি। কঠোর নিরাপত্তা, নজরদারি বৃহস্পতিবার বেলা ১১টার দিকে সোহরাওয়াদীর্র উদ্যানে মেলার নিরাপত্তা প্রস্তুতি দেখতে যান ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়া। তিনি মেলার সাবির্ক নিরাপত্তা ব্যবস্থা পরিদশর্ন করেন। ডিএমপির কন্ট্রোল রুমেও যান। পরে ডিএমপি কমিশনার সাংবাদিকদের বলেন, ‘বাংলা একাডেমির সহায়তায় সুদৃঢ় নিরাপত্তাবলয় তৈরি করেছি। যা যা করণীয়, তা সকলের সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে সুচারুভাবে দেখা হবে। মেলার প্রতিটি ইঞ্চি সিসিটিভির মাধ্যমে মনিটর করা হবে। তিনি বলেন, মেলার বাংলা একাডেমি অংশে দুটি প্রবেশপথ থাকবে, বের হওয়ার জন্য থাকবে একটি পথ। সোহরাওয়াদীর্ উদ্যানে মেলার যে অংশ আছে, সেখানে তিনটি প্রবেশপথ ও তিনটি বের হওয়ার পথ থাকবে। আচর্ওয়ে মেটাল ডিরেক্টর দিয়ে তল্লাশি করা হবে। প্রবেশপথে নারী ও পুরুষদের আলাদাভাবে তল্লাশি করা হবে।’ এক প্রশ্নের জবাবে ডিএমপি কমিশনার বলেন, ‘জঙ্গিদের সংঘবদ্ধ আক্রমণের সম্ভাবনা নেই। তবে বিচ্ছিন্নভাবে দু-একজন অপতৎপরতা চালাতে পারে। আমাদের উদ্যমী অফিসার, সদস্যরা সতকর্ রয়েছেন এবং অহনির্শ কাজ করে যাচ্ছেন। সংশ্লিষ্ট কোনো হুমকি নেই। লেখক, বøগারদের জন্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা রয়েছে। তারপরও যদি কেউ পুলিশকে জানান, তাহলে অতিরিক্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হবে।’ র‌্যাবের পক্ষ থেকে র‌্যাব-৩-এর অধিনায়ক লে. কনের্ল এমরানুল হাসান মেলার নিরাপত্তা ব্যবস্থা দেখতে আসেন। মেলার সাবির্ক নিরাপত্তা ব্যবস্থা পরিদশর্ন করে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কঠোর নজরদারি রাখা হয়েছে। গোয়েন্দা নজরদারিও রয়েছে। সবোর্চ্চ নিরাপত্তাবলয় তৈরি করা হয়েছে। অপতৎপরতা রুখে দেয়ার জন্য তারা সজাগ রয়েছেন।