বইমেলা প্রতিদিন

ছুটির দিনে জনজোয়ার বিক্রিও খুব ভালো

প্রকাশ | ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০০:০০

এস এম মামুন হোসেন
শুক্রবার সোহরাওয়াদীর্ উদ্যানে একটি বইয়ের স্টলের সামনে ক্রেতাদের উপচেপড়া ভিড় Ñযাযাদি
পহেলা ফাল্গুন আর বিশ^ ভালোবাসা দিবসের পরের দিনই শুক্রবার। আগের দু’দিনে ভিড় একটু বেশি ছিল। ফলে অনেকেরই ধারণা ছিল, গতকাল লোক সমাগম তুলনামূলক কম হবে। কিন্তু সব জল্পনা দূরে ঠেলে শুক্রবার মানুষের ঢল নেমেছিল অমর একুশে বইমেলায়। বইও কিনেছেন দু’হাত ভরে। ফলে লেখক প্রকাশকদের মুখেও ছিল আনন্দের হাসি। গতকাল মেলা শুরু হয় বেলা ১১টা থেকে। মূলত শিশুপ্রহরের কল্যাণে শুক্র-শনি আগেভাগেই মেলার দ্বার খোলে। সকাল থেকেই ছিল লোক সমাগম। তবে তা জমে ওঠে পশ্চিমে সূযর্ হেলে পড়ার পর। বিকাল ৪টার আগেই মেলা প্রাঙ্গণজুড়ে লোকেলোকারণ্য হয়ে ওঠে। শাহবাগ এবং দোয়েল চত্বরÑ দু’পাশ থেকেই সারিবদ্ধভাবে বইপ্রেমীরা মেলায় প্রবেশ করেন। সন্ধ্যা ছয়টা নাগাদ শাহাবাগ থেকে দোয়েল চত্বর পযর্ন্ত পুরো সড়কও মানুষের ভিড়ে উপচে পড়তে থাকে। সবার গন্তব্য একটিই। আর তা হলো প্রাণের বইমেলা। সন্ধ্যানাগাদ সোহরাওয়াদীর্ উদ্যান এবং বাংলা একাডেমিতে মানুষের এতটাই ভিড় ছিল যে, সেখানে হঁাটাচলা করাটাই দায় হয়ে পড়ে। বইয়ের স্টলগুলোর কমীর্রাও বইপ্রেমীদের ভিড়ে রীতিমতো হঁাপিয়ে উঠতে থাকেন। বড় প্যাভিলিয়ন বা স্টলের পাশাপাশি ছোটছোট দোকানগুলোতেও বেচাকেনা হয়েছে প্রচুর বই। ফলে সবার মুখেও ছিল হাসির ছেঁায়া। বইয়ের জন্য মানুষের এ আকুতি, এ ভালোবাসাÑ একুশে চেতনা থেকেই পাওয়া। লেখক-প্রকাশকরা বলছেন, দিন দিন পাঠকের এ স্র্রোত যেন বাড়ছেই। মানুষের উপস্থিতির সঙ্গে বিক্রিও ছিল চোখে পড়ার মতো। এবারের মেলায় গতকালের উপস্থিতিই ছিল সবাির্ধক। বিক্রির সঠিক পরিসংখ্যান জানা না গেলেও কম-বেশি সবার হাতেই ছিল গন্ধ মাখা নতুন বইয়ের ব্যাগ। প্রকাশকদের সবাই জানিয়েছেন তারা শুক্রবারের বিক্রিবাট্টায় খুশি। ঐতিহ্য প্রকাশের কাজল যায়যায়দিনকে বলেন, ‘প্রচুর বই বিক্রি হচ্ছে। সকাল থেকেই অনেক লোক মেলায় এসেছে। তবে দুপুরের পর থেকে বিক্রি বেশি হচ্ছে। এমন বিক্রি মেলাজুড়ে ৫ থেকে ৭ দিন হলে সব প্রকাশকের মুখে হাসি ফুটবে। আমরা এমন দিনের অপেক্ষাতেই থাকি। আজ লক্ষ্যের চেয়ে অনেক বেশিই বিক্রিবাট্টা হয়েছে।’ মেলায় আগত আজহারুল হক যায়যায়দিনকে বলেন, ‘প্রথম মেলাতে এসেছি। প্রচুর লোক। খুবই ভালো লাগছে। মানুষের এ পদচারণা দেখে মনে হচ্ছে, আমরা সত্যিই ’৫২র চেতনাকে ধারণ করছি। আমাদের শহীদদের আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। তাদের সম্মানে আজকের এ বইমেলা। হাজার হাজার মানুষ তাদের সম্মান জানাতে এখানে এসেছে। আমিও এ মিছিলে আসতে পেরে গবের্বাধ করছি। নিজের জন্য এবং নিজের প্রিয়জনদের উপহার দিতে তিনটি বই কিনেছি। আরও কয়েকটি কিনবো। শিশুপ্রহরে শিশুদের কিচিরমিচির গতকাল শুক্রবার ছিল এবারের মেলার চতুথর্ শিশুপ্রহর। বেলা ১১টায় দ্বার খোলে মেলার। সে সময় থেকেই আসতে শুরু করে শিশু-কিশোররা। সাড়ে এগারোটা নাগাদ সহস্র্রাধিক শিশু-কিশোর তাদের অভিভাবকের হাত ধরে মেলা চত্বরে প্রবেশ করে। শিশুদের জন্য তৈরি শিশু চত্বরে এ সময় অসংখ্য শিশু লাফালাফি করতে থাকে। যারা একটু বড় তারা হাত ধরে গোল হয়ে নাচতে থাকে। কিন্তু যারা একেবারে ছোট তারা নিজের মতো করে আনন্দ করতে থাকে। তাদের কিচিরমিচরে এ সময় শিশু চত্বরে তৈরি হয় আলাদা এক পরিবেশ। কচিকঁাচাদের এ কিচির মিচিরের ছবি তুলতে এ সময় ভিড় করেন সাংবাদিক ও অভিভাবকরা। তবে কে ছবি তুলছে আর কেই বা কি ভাবছে তা নিয়ে ভাবার এতটুকু ফুসরত নেই এ সোনামণিদের। তাদের কোলাহল বড়দেরও মনে আনন্দের প্লাবন ছড়িয়ে দেয়। কলকাকলির পাশাপাশি ছোট্ট সোনামণিরা বইও কিনেছে। যারাই এসেছে তাদের প্রায় সবাই বই কিনে নিয়ে বাড়িতে ফিরেছে। নরসিংদী থেকে মেলায় আসা ছোট্ট সুমাইয়ার বাবা রাশেদ যায়যায়দিনকে বলেন, ‘অনেক সকালে রওনা হয়েছি। বাচ্চার জন্যই আসা। আর যেহেতু এসেছি সেহেতু বিকালেও একটি ঘুল্লি দিয়েই যাচ্ছি। অনেক লোক হয়েছে। বাচ্চার জন্য ১০টি বই কিনেছি। আমার স্ত্রী আমাকে দুইটি বই উপহার দিয়েছে। আমিও তাকে তার পছন্দ মতো একটি বই উপহার দিয়েছি।’ শিশুরাজ প্রকাশনার আবু তাহের যায়যায়দিনকে বলেন, ‘এবারের মেলার মধ্যে আজকের দিনটিই সবচেয়ে ভালো বিক্রি হয়েছে। অনেক বাচ্চাই এসেছে। আবার বড়রাও তাদের বাড়িতে থাকা ছোটদের জন্য বই কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। সব মিলে আজকের মেলাটি ভালোই কাটছে।’ শিশুদের জন্য এবারের মেলায় অনেক বই এসেছে। তবে অভিভাবকদের অনেকেই অভিযোগ করেছেন, সংখ্যার বিচারে বই বাড়লেও মানের বিচারে ভালো বইয়ের সংখ্যা নগণ্য। রাজধানীর উত্তরা থেকে মেলায় আসা একজন অভিভাবক ফিরোজ মোহল যায়যায়দিনকে বলেন, ‘আমাদের দেশের জনপ্রিয় লেখকরা শিশুদের জন্য বই লিখতে পছন্দ করেন না। কারণ, এ সব বইয়ের পাঠক কম। আর যে সব বইমেলায় এসেছে, তার বেশিরভাগেরই মান ভালো না। এ বিষয়ে প্রকাশকদের পাশাপাশি বাংলা একাডেমিকেও শক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।’ ছোটদের এ শিশু প্রহর চলে দুপুর একটা পযর্ন্ত। এরপর জুমার নামাজের বিরতি দিয়ে আবারও শুরু হয় মেলা। তবে তখন আর মেলা শুধু শিশুদের ছিল না। বরং বড়দেরই সমাগম বেশি ছিল তখন। নতুন বই গতকাল মেলায় ২৭২টি নতুন বই এসেছে বলে জানিয়েছে বাংলা একাডেমির জনসংযোগ অফিস। এর মধ্যে মধ্যে গল্প ৫৫টি, উপন্যাস ৪১টি, প্রবন্ধ ৯টি, কবিতা ৯৪টি, গবেষণা ৩টি, ছড়া ৮টি, শিশুসাহিত্য ১৩টি, জীবনী ১০টি, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক ৪টি, নাটক ৪টি, বিজ্ঞান বিষয়ক ৬টি, ভ্রমণ ৫টি, ইতিহাস বিষয়ক ৩টি, রম্য ১টি, ধমীর্য় ১টি, অনুবাদ ১টি, সায়েন্স ফিকশন ১টি, অন্যান্য ১১টিসহ মোট ২৭২টি নতুন বই এসেছে। উল্লেখযোগ্য বইগুলোর মধ্যে আহসান হাবীবের ‘উন্মাদীয় রম্য’ (অজর্ন প্রকাশ), বুলবুল সরওয়ারের ‘মমির দেশ মিশর’ (ঐতিহ্য), স্বকৃত নোমানের ‘বাঙালি মনীষীদের ছেলেবেলা’ (অনিন্দ্য প্রকাশ), সুমন্ত আসলামের ‘রাত একটা একুশ: পঁাচ গোয়েন্দা’ (কথা প্রকাশ), আনিসুল হকের ‘বঙ্গবন্ধুর জন্য ভালোবাসা’ (পালর্ পাবকিকেশন্স), লুৎফর হাসানের ‘দুপুর বাড়ি ছড়ার হঁাড়ি’ (পাললিক সৌরভ), ধ্রæব এষের ‘আমার বাঘ মামাই’ (ময়ূরপঙ্খি), মারুফুল ইসলামের দহগ্রাম (অন্য প্রকাশ), সঞ্জীব দ্রংয়ের ‘ইশ্বর সঁাওতালদের ভুলে গেছে’ (সূচীপত্র), আবুল হায়াতের ‘বিষফল’ (প্রিয় বাংলা প্রকাশন), মুস্তফা জামান আব্বাসীর ‘ঢাকা না কলকাতা’ (প্রিয় বাংলা প্রকাশন), সৌমেন সাহার ‘রসায়নের রহস্য’ (অক্ষর প্রকাশনী), মুহম্মদ জাফর ইকবালের ‘টুটনের ঘুম’ (দ্যা পপ-অপ ফ্যাক্টরি), হাসান হাফিজের ‘মুক্তিযুদ্ধের শ্রেষ্ঠ কবিতা’ (অক্ষর প্রকাশনী), আলম তালুকদারের ‘দশ ফালি রোদ’ (আদিগ্রন্থ), নিমের্লন্দু গুণের ‘কবিতাকুঞ্জ’ (বিভাস), শ্যামসুন্দর সিকদারের ‘দৃষ্টির ভেতর ঘুমের শরীর’ (জনপ্রিয় প্রকাশনী)। লেখক বলছি কণার্র এবারের বইমেলায় প্রথমবারের মতো ভালো মানের ৫ জন লেখককে ২০ মিনিট করে নিজের বই নিয়ে কথা বলার সুযোগ করে দিয়েছে মেলা আয়োজক কতৃর্পক্ষ। সোহরাওয়াদীর্ উদ্যানের লেক পাড়ে ‘লেখক বলছি’ কণাের্রর এ আয়োজনে শুক্রবার নিজেদের সাহিত্যকমর্ বিষয়ে আলাপনে অংশ কবি আসলাম সানী (পুরান ঢাকার জেল্লা লালবাগ কেল্লা), কবি গেলাম কিবরিয়া পিনু (ঝুলনপূণির্মা থেকে নেমে এলো), শিশুসাহিত্যিক পলাশ মাহবুব (বাবুদের বাজিমাত), কবি ও গল্পকার ফারুক আহমেদ (আজিজুল একটি গোপন নামতা), কথাসাহিত্যিক জুলফিয়া ইসলাম (গল্প সমারোহ)। মূল মঞ্চের আয়োজন শুক্রবার মেলা চলে বেলা ১১টা থেকে রাত ৯টা পযর্ন্ত। সকাল ১০টায় অমর একুশে গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয়ে শিশুকিশোর সংগীত প্রতিযোগিতার চ‚ড়ান্ত নিবার্চন। এতে ক-শাখায় ১৬ জন খ-শাখায় ১৫ জন প্রতিযোগী অংশগ্রহণ করে। প্রতিযোগিতায় বিচারক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সংগীত শিল্পী কল্যাণী ঘোষ, সুজিত মোস্তফা এবং চন্দনা মজুমদার। আগামী ২২ ফেব্রæয়ারি এ প্রতিযোগিতার চ‚ড়ান্ত ফলাফল ঘোষণা এবং পুরস্কার বিতরণ করা হবে। বিকাল ৪টায় গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবতীর্: শ্রদ্ধাঞ্জলি’ শীষর্ক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন অধ্যাপক বেগম আকতার কামাল। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন কবি মোহাম্মদ সাদিক এবং সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক সৈয়দ আকরম হোসেন। সন্ধ্যায় কবিকণ্ঠে কবিতাপাঠ করেন কবি ইকবাল আজিজ এবং হারিসুল হক। আবৃত্তি পরিবেশন করেন আবৃত্তিশিল্পী মাসকুর-এ-সাত্তার কল্লোল এবং রূপা চক্রবতীর্। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ছিল হাসান আব্দুল্লাহ’র পরিচালনায় সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘ঘাসফুল শিশুকিশোর সংগঠন’ এবং আতিকুর রহমান উজ্জ্বলের পরিচালনায় ‘ভোরের পাখি নৃত্যকলা কেন্দ্র’-এর নৃত্যশিল্পীবৃন্দের পরিবেশনা। আজকের অনুষ্ঠানসূচি আজ মেলা চলবে বেলা ১১টা থেকে রাত ৯টা পযর্ন্ত। গ্রন্থমেলায় শিশুপ্রহর আজও মেলায় থাকবে শিশুপ্রহর। বেলা ১১টা থেকে বেলা ১টা পযর্ন্ত শিশুপ্রহর ঘোষণা করা হয়েছে। সাধারণ জ্ঞান ও উপস্থিত বক্তৃতা প্রতিযোগিতার চ‚ড়ান্ত পবর্ আজ সকাল ১০টায় অমর একুশে গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে শিশু-কিশোর সাধারণ জ্ঞান ও উপস্থিত বক্তৃতা প্রতিযোগিতার চ‚ড়ান্ত নিবার্চন। বিকাল ৪টায় গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে চিত্রশিল্পী সৈয়দ জাহাঙ্গীর : শ্রদ্ধাঞ্জলি শীষর্ক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন মইনুদ্দীন খালেদ। আলোচনায় অংশগ্রহণ করবেন ফরিদা জামান, নিসার হোসেন এবং মলয় বালা। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন চিত্রশিল্পী হাশেম খান। সন্ধ্যায় রয়েছে কবিকণ্ঠে কবিতাপাঠ, কবিতা-আবৃত্তি ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।