ব্যারিস্টার রাজ্জাকের বিলম্বিত বোধোদয় নিয়ে প্রশ্ন

প্রকাশ | ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০০:০০

যাযাদি রিপোটর্
ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক
আন্তজাির্তক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দঁাড়িয়ে চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে যিনি আইনি লড়াই চালিয়েছেন, সেই আব্দুর রাজ্জাক একাত্তরে জামায়াতে ইসলামীর ভূমিকা নিয়ে আপত্তির কথা জানিয়ে দল ত্যাগের ঘোষণা দেয়ার পর দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে তৈরি হয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। জামায়াতের দীঘির্দনের জোটসঙ্গী বিএনপির পাশাপাশি আওয়ামী লীগের জোটসঙ্গী জাতীয় পাটির্ ও ওয়াকার্সর্ পাটির্র কয়েকজন নেতা বলেছেন, ব্যারিস্টার রাজ্জাকের এই বিলম্বিত বোধোদয়কে তারা ‘ইতিবাচক’ হিসেবেই দেখতে চান। তবে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল এবং দলটিকে নিষিদ্ধ করার দাবি নিয়ে আদালতে যাওয়া তরিকত ফেডারেশন বলছে, রাজ্জাকের এত দিনের অবস্থান থেকে তার জামায়াত ছাড়ার ঘোষণা ‘অবিশ্বাস্য’। অস্তিত্ব রক্ষার চেষ্টায় এটা জামায়াতের কোনো ক‚টকৌশল কি না, সেই প্রশ্নও এসেছে রাজনীতিবিদ ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের কাছ থেকে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ অবশ্য জামায়াতের একজন আইনজীবীর দল ছাড়ার খবরকে গুরুত্ব দিতে চাইছে না। আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী ওই দলের নিষিদ্ধ হওয়ার অপেক্ষায় আছেন তারা। জামায়াতের জ্যেষ্ঠ নেতাদের প্রধান আইনজীবী হিসেবে তিন বছর মামলা লড়ার পর ২০১৩ সালে হঠাৎ করেই দেশ ছাড়েন যুক্তরাজ্যের নাগরিকত্বধারী রাজ্জাক। সেখান থেকেই শুক্রবার দলের আমির মকবুল আহমদের কাছে পদত্যাগপত্র পাঠিয়েছেন তিনি। ইতিবাচক পদক্ষেপ: বিএনপির মাহবুব রাজ্জাকের পদত্যাগ ও এর কারণ নিয়ে জামায়াতের জোটসঙ্গী বিএনপির পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। তবে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য মাহবুবুর রহমান বলেছেন, “আমি এটাকে খুব পজিটিভলি দেখছি। আমি মনে করি রাজ্জাক সাহেব দেরিতে হলেও তার এ উপলব্ধি ও ক্ষমা চাওয়ার কথা বলেছেন- খুব ভালো দিক। আমি বিশ্বাস করব, জামায়াতে ইসলামীর সকলেই তা-ই করবে; দল হিসেবেও তারা তা-ই (ক্ষমা চাইবে) করবে।’ জামায়াত সত্যি সত্যি মানবতাবিরোধী মতবাদে বিশ্বাসী না হয়ে থাকলে অনেক আগেই তাদের ক্ষমা চাওয়া উচিত ছিল বলে মন্তব্য করেন এই বিএনপি নেতা। যদিও তার সহকমীের্দর অনেকে বরাবর জামায়াতের পক্ষে বলে এসেছেন। মাহবুব বলেন, ‘বিএনপি যখন জোটে জামায়াতকে রেখেছিল- আমি স্ট্যান্ডিং কমিটির মেম্বার হিসেবে সব সময় বলে আসছি- না, তারা স্বাধীনতাবিরোধী দল; তারা মুক্তিযুদ্ধে অনেক মানবতাবিরোধী কমর্কাÐ করেছে। তাদের কখনো আমরা ধানের শীষ প্রতীক দিতে পারি না। তাদের কখনো আমরা আমাদের ঐক্যফ্রন্টের মধ্যে নিতে পারি না।’ এই বিএনপি নেতার বিশ্বাস, জামায়াতকে জোট থেকে বের করে দিলে বিএনপিই উপৃকত হবে। আর তাতে জামায়াতেরও লাভ হতে পারে। নতুন মেরুকরণের পথ হলো: মেনন পদত্যাগের কারণ হিসেবে যে যুক্তি রাজ্জাক দেখিয়েছেন, তাতে মোটেও চমকিত নন ওয়াকার্সর্ পাটির্র সভাপতি রাশেদ খান মেনন। তিনি বলেন, ‘আমি তো মনে করি জামায়াতের নতুন প্রজন্মের নেতৃত্বের মধ্যে এ উপলব্ধি অনেক দিন ধরেই রয়েছে। যুদ্ধাপরাধের নেতৃত্বে যারা ছিল, মানবতাবিরোধী অপরাধে যারা ছিল, তারাই এটা হতে দেয়নি। এখনো হতে দিচ্ছে না।’ রাজ্জাকের পদত্যাগ জমায়াতের মধ্যে নতুন মেরুকরণের পথ তৈরি করবে, নতুন ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে বলেই মহাজোটের শরিক নেতা মেননের বিশ্বাস। তিনি বলেন, “সেটা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য ভালো হবে বলে আমি মনে করি। আমার মনে হয়, এটা তাদের কোনো কৌশল না। রাজ্জাক আগে থেকেই এটা ধারণ করতেন; এখন প্রকাশ্যে বললেন। তবে এটাকে দলের অবস্থান বলা যাচ্ছে না। রাজ্জাকের কথা এটুকু বলতে পারি, গণমাধ্যমে যা দেখছি- এটা পজিটিভ মুভ নিশ্চয়ই।’ এটা কূটকৌশল: নজিবুল বশর বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশনের রিট আবেদনেই হাইকোটর্ ছয় বছর আগে রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করে। দল হিসেবে জামায়াতকে নিষিদ্ধ ঘোষণার দাবি নিয়েও আদালতে গেছে তরিকত। আওয়ামী লীগের জোটসঙ্গী এ দলের চেয়ারম্যান নজিবুল বশর মাইজভাÐারী বলেন, ‘এ (রাজ্জাকের) উপলব্ধি নিয়ে মূল্যায়নের কিছু নেই। আমরা জামায়াত ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে চলমান আন্দোলন অব্যাহত রাখব।’ তিনি বলেন, ‘রাজ্জাক জামায়াত থেকে সরে গেছেন, এটা অবিশ্বাস্য। উনি নীতিনিধার্রণী পযাের্য় ভূমিকা রেখেছেন। দেশের বাইরে জামায়াতের যে যোগাযোগ, কোটি কোটি টাকার লেনদেন, তা রাজ্জাক সাহেবের মাধ্যমে হচ্ছে।’ নজিবুল বশরের দাবি, জামায়াতকে নিয়ে তাদের মামলা তোলার জন্য ‘শত শত কোটি টাকা’ সেধেছিলেন রাজ্জাক। ‘সেই রাজ্জাক সাহেব আবার দলের ক্ষমা চাওয়ার কথা বলছেন। এটা তাদের রাজনীতির জন্য একটা চাল। উনি দেশে ফিরে আসতে চাচ্ছেন। জামায়াতকে নতুনভাবে সংগঠিত করতে চাচ্ছেন। পুরনোগুলোকে বাদ দিয়ে নতুনদের নিয়ে সংগঠিত করবেন। এটাকে ভালো চোখে দেখার কোনো কারণ দেখি না।’ পরিস্থিতি কোথায় যায়, দেখার বিষয়: জি এম কাদের রাজ্জাকের পদত্যাগের খবরের প্রতিক্রিয়ায় সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পাটির্র কো-চেয়ারম্যান জি এম কাদের বলেন, ‘আমি যতটুকু জানি, যতটুকু পরিচয় আমার রয়েছে, দীঘির্দন ধরেই উনি একটা মতবাদ বিশ্বাস করতেন। একাত্তরে তাদের ভূমিকা ঠিক ছিল না। উনি আগেও এটা বলেছিলেন। যে কোনো কারণেই হোক আগে থেকে তিনি যেটা বিশ্বাস করতেন, তা থেকে পদত্যাগ করেছেন।’ এর পেছনে জামায়াতের কোনো কৌশল আছে কি না- সেই প্রশ্নে এখনই কোনো মন্তব্য করতে রাজি নন জি এম কাদের। ‘বাস্তবতাকে উনি উপলব্ধি করতে পেরেছেন; উনার সিদ্ধান্তের প্রভাব দলেও পড়বে। তবে এটা কৌশল কিনা আমি এ মুহূতের্ বলতে পারব না। দেশের মানুষের চাওয়া, বাস্তবতা, দলের অনেকের প্রত্যাশা- এসব বিষয় হয়তো উনি বিবেচনা করেছেন।’ জামায়াতের প্রথম সারিতে এখন যারা আছেন, তাদের বেশির ভাগই স্বাধীনতার পরের প্রজন্মের বলে মুক্তিযুদ্ধকালীন দলের অবস্থানের দায় নিতে চান না বলে জি এম কাদেরের ধারণা। রাজনীতি করার অধিকার জামায়াতের নেই: নাসিম আওয়ামী লীগের সভাপতিমÐলীর সদস্য ও ১৪ দলের মুখপাত্র মোহাম্মদ নাসিম বলেন, ‘জামায়াতের একজন ব্যক্তি স্টেটমেন্ট দিয়েছেন, তার কোনো পজিশন রয়েছে কি না জানি না। ব্যক্তির এ বক্তব্য- এটা ইম্পটের্ন্ট বিষয় নয়, যুদ্ধাপরাধীদের একজন আইনজীবী বলেই জানতাম।’ নিজেদের অবস্থান তুলে ধরে নাসিম বলেন, ‘আমরা স্পষ্ট বলছি- জামায়াতকে নিষিদ্ধ করতে হবে। ওদের ইন্ডিভিজুয়াল কোনো স্টেটমেন্টের গুরুত্ব নেই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন- মামলা চলমান রয়েছে। মামলা নিষ্পত্তি হয়ে গেলে নিষিদ্ধ হবে। তাদের রাজনীতি করার অধিকার নেই।’