বইমেলা প্রতিদিন

ভাষা আন্দোলনের মানসম্মত বইয়ের আকাল

প্রকাশ | ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০০:০০

এস এম মামুন হোসেন
আজ অমর একুশে গ্রন্থমেলা। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। ১৯৫২ সালের এ দিনেই বাংলা মায়ের সূর্য সন্তানরা মায়ের ভাষার সম্মান রক্ষায় নিজেদের জীবন দিয়েছিলেন। আর তাদের সেই আত্ম ত্যাগের ফলেই আজ আমরা পেয়েছি মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার। এ দিনটি পেয়েছে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও। অথচ যে ভাষা আন্দোলন আমাদের এত উঁচুতে এনে দিয়েছে সেই ভাষা আন্দোলন কেন্দ্রিক মানসম্মত সাহিত্য কর্মের বড়ই আকাল অমর একুশে গ্রন্থ মেলায়। বাংলা একাডেমির তথ্যমতে, গতকাল ২০তম দিন পর্যন্ত মেলায় মোট নতুন বই এসেছে ২ হাজার ৮৯৬টি। এর মধ্যে ভাষা আন্দোলন নিয়ে বই এসেছে মাত্র বারোটি। আবার যা এসেছে তারও মান নিয়ে রয়েছে বড় প্রশ্ন। প্রকাশকরা বলছেন, ১৯৭০ সালে জহির রায়হানের অমর সৃষ্টি 'একুশের গল্পে' এর তপু চরিত্রের পর এ আন্দোলন নিয়ে আর ওই মানের কোন মানসম্মত সাহিত্য সৃষ্টি হয়নি। তাদের ভাষায়, ভাষা আন্দোলন নিয়ে বই প্রকাশে তাদের বিপুল আগ্রহ থাকলেও পান্ডুলিপির অভাবে তারা তা পারছেন না। আবার যা দু'একটি লেখা আসছে তারও মান ভালো না হওয়ায় এসব লেখা জনসমাদৃত হচ্ছে না। এবারের বইমেলা ঘুরে নতুন যেসব বইয়ের সন্ধান পাওয়া গেছে তার মধ্যে রিয়া প্রকাশনী এনেছে মামুন তরফদারের 'বাংলার লোকসংস্কৃতিতে ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ', এশিয়া পাবলিকেশন্স এনেছে ড. গুলশান আরা 'ভাষা আন্দোলনের কথা', জোনাকী প্রকাশনী এনেছে সৌমিত্র শেখরের 'একুশের সংকলন পরিচিতি ও গুরুত্ব', আগামী প্রকাশনী এনেছে সৈয়দ জাহিদ হাসানের 'সিরাজগঞ্জে ভাষা আন্দোলন ও পাবনায় ভাষা আন্দোলন, ইত্যাদি এনেছে সুফিয়া বেগমের 'ভাষা সংগ্রামী নারীরা, প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত ভাষা সংগ্রামী আহমদ রফিকের 'ভাষা আন্দোলন: টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া' অধ্যয়ন থেকে রাদিন চৌধুরীর 'ভাষা আন্দোলনের সহজ পাঠ', নালন্দা এনেছে সোহেল মলিস্নক সম্পাদিত 'ভাষা আন্দোলনের নির্বাচিত ৫০ কিশোর গল্প', বটেশ্বর বর্ণন এনেছে সুমাইয়া খানমের 'ভাষা-আন্দোলন ও বাংলাদেশের কথাসাহিত্য, এশিয়া পাবলিকেশন্স এনেছে ইসমাইল হোসেন বকুলের রক্তের কারাগারে বন্দি ৮ই ফাল্গুন, ভাষা আন্দোলন ও রক্তঝরা একুশ' ও ড. গুলশান আরার 'ভাষা আন্দোলনের কথা, জাগৃতি প্রকাশনী থেকে সাইফুল হক সিরাজীর 'ভাষা আন্দোলনের তাৎপর্য'। মেলায় ভাষা আন্দোলনের উপর আগে একাধিক বই এনেছে অন্বেষা প্রকাশনা। এর প্রকাশক শাহাদাত হোসেন যায়যায়দিনকে বলেন, 'আমরা বরাবরই ভাষা আন্দোলন নিয়ে বই করে থাকি। এবারও আমাদের করার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও পান্ডুলিপির অভাবে করতে পারিনি। ভাষা আন্দোলন নিয়ে বই লেখার মতো ভালো গবেষকও বর্তমানে পাওয়া যাচ্ছে না। পান্ডুলিপি পেলে বই প্রকাশ করতে আমাদের কোনো আপত্তি নেই।' তাম্রলিপির এ কে এম তরিকুল ইসলাম রনি যায়যায়দিনকে বলেন, 'মুক্তিযুদ্ধের মতো ভাষা আন্দোলন নিয়েও নতুন প্রজন্মের আগ্রহ দিনে দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমাদের প্যাভিলিয়নে এসে অনেকেই ভাষার বই খুঁজছে। একসময় তরুণরা যেমন গল্প, উপন্যাসের প্রতি বেশি আগ্রহী ছিল এখন তাদের রুচির পরিবর্তন হচ্ছে। ভালো পান্ডুলিপি ও গবেষণার অভাবেই ভাষা আন্দোলন নিয়ে বইয়ের সংখ্যা কম। আবার যা কিছু আসে তাও মানসম্মত নয়। যেমন ১৯৭০ সালে জহির রায়হানের অমর সৃষ্টি 'একুশের গল্প' এর তপু চরিত্রের মতো উন্নত সাহিত্যকর্ম ভাষা আন্দোলনের উপর আর আসেনি। আমরা চেষ্টা করছি এলাকা ভিত্তিক ইতিহাস তুলে আনতে। তবে প্রকৃত লেখকদের এ বিষয়ে সাহিত্য সৃষ্টির আগ্রহ নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে।' এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট ভাষা সংগ্রামী ও লেখক আহমদ রফিক বলেন, 'গল্প, কবিতা, উপন্যাস ইচ্ছে করলেই যে কেউ লিখতে পারে। কারণ সেসব কাল্পনিক। ভাষা আন্দোলন যেহেতু ইতিহাসভিত্তিক, তাই ইতিহাস না জানলে এ বিষয়ে লেখা যায় না। ভাষা আন্দোলন নিয়ে লিখতে গেলে প্রচুর গবেষণার দরকার। মূলত ভাষা আন্দোলন নিয়ে গবেষণার অভাবেই একুশের বইমেলায় ভাষা আন্দোলনের বই কম। আরেকটা কথা মনে রাখতে হবে এ বিষয়ে যেহেতু গবেষণা কম, তাই এ বিষয়ে বইয়ের সংখ্য কম হওয়াটাই স্বাভাবিক। নিজের কৃষ্টি-কালচার জানতে হলে দেশের ঐতিহ্যকে জানতে হলে ও শেকড়ের খোঁজে পেতে হলে ভাষা আন্দোলন নিয়ে তরুণ প্রজন্মকে অনেক বেশি পড়াশোনা করতে হবে। বইয়ের সংখ্যা যেহেতু কম, তাই যেগুলো আছে সেগুলো থেকেই ইতিহাস জানতে হবে। তাহলেই তরুণদের হাতে এ বিষয়ে ভালো সাহিত্য সৃষ্টি হবে।' নতুন বই: বুধবার ১৩৮টি নতুন বই মেলায় এসেছে বলে জানিয়েছে বাংলা একাডেমির জনসংযোগ অফিস। এর মধ্যে গল্প ২৪টি, উপন্যাস ১৮টি, প্রবন্ধ ৯টি, কবিতা ৪৭টি, গবেষণা ২টি, ছড়া ৪টি, শিশুসাহিত্য ১টি, জীবনী ৫টি, মুক্তযুদ্ধ বিষয়ক ৬টি, নাটক ১টি, ভ্রমণ বিষয়ক ৩টি, ইতিহাস বিষয়ক ২টি, রাজনীতি ২টি, স্বাস্থ্য বিষয়ক ১টি, সায়েন্স ফিকশন ১টি, ধর্মীয় ১টি, অভিধান ১টি, অনুবাদ ১টি এবং অন্যান্য ৯টি। উলেস্নখযোগ্য বইগুলোর মধ্যে অনুপম এনেছে সৌমেন সাহার অবিধান 'বিজ্ঞান অবিধান', অক্ষর এনেছে জান্নাতুল যূথীর গবেষণামূলক প্রবন্ধ 'দিলারা হাশেমের উপন্যাস বিষয় ও প্রকরণ', কামাল হোসেন টিপুর উপন্যাস 'এত কাছে তুমি তবু এত দূরে', নবরাগ এনেছে হাবিবুর রহমান স্বপনের গবেষণাগ্রন্থ 'বরীন্দ্র ছোট গল্পের রূপ অন্বেষণ', বেহুলা বাংলা এনেছে জুয়েল মাজহারের কবিতার বই 'কবিতার ট্রান্সট্রোমার' ও ইমাম মেহেদীর মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গ্রন্থ 'মুক্তিযুদ্ধে কুষ্টিয়ার নারী', একাত্তর এনেছে আসাদুলস্নাহ্‌র ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গ্রন্থ 'ছোটদের ভাষাবীর ও বীরশ্রেষ্ঠ', আসলাম সানীর ছড়া 'শিশুর সনে ফুলের বনে', অনার্য এনেছে তানভীর মোকাম্মেলের চলচিত্র বিষয়ক 'চলচিত্র নন্দনতত্ত্ব ও বারোজন ডিরেক্টর', এপিজে আব্দল কালামের অনুবাদগ্রন্থ 'ইগনাইটেড মাইন্ডস, য়ারোয়া থেকে হাবীবুলস্নাহ সিরাজীর কাব্যগ্রন্থ 'সুভাষিত'। লেখক বলছি: লেখক বলছি অনুষ্ঠানে নিজেদের নতুন প্রকাশিত গ্রন্থ বিষয়ে আলোচনায় অংশ নেন কবি মাসুদুজ্জামান, কবি মুজতবা আহমেদ মোরশেদ, কথাসাহিত্যিক প্রশান্ত মৃধা, প্রাবন্ধিক শীলা মোস্তফা এবং কবি প্রত্যয় জসিম। কবিকণ্ঠে কবিতাপাঠ করেন কবি আসাদ চৌধুরী, নাসির আহমেদ, মারুফুল ইসলাম এবং ওবায়েদ আকাশ। আবৃত্তি পরিবেশন করেন আবৃত্তিশিল্পী ডালিয়া আহমেদ এবং অলোক বসু।