কেরানীগঞ্জের রামেরকান্দা-রুহিতপুর গ্রামে লুঙ্গি তৈরিতে ব্যস্ত দুই কারিগর -যাযাদি
লুঙ্গি বাংলাদেশের মানুষের বহুল ব্যবহৃত এক আরামদায়ক পোশাক। বাঙালির ঐতিহ্য। এমন আরামদায়ক পোশাক সারা বিশ্বে আর দ্বিতীয়টি খুঁজে পাওয়া যাবে কিনা তা সন্দেহ। বাংলাদেশে বাস করেন, কিন্তু কখনো রুহিতপুরি লুঙ্গি পরেননি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া মনে হয় অসম্ভব। রাজধানীর কেরানীগঞ্জের রুহিতপুরি লুঙ্গি ঐতিহ্যের আদিকাল থেকে গ্রাম-বাংলার অবসর সময়ের আরামদায়ক পোশাক। সারা বাংলাদেশে এক নামেই পরিচিতি রয়েছে এই রুহিতপুরি লুঙ্গির। শুরুর কথা বলতে গেলে কেরানীগঞ্জের রামেরকান্দা ও রুহিতপুর এলাকা থেকেই এই লুঙ্গির উৎপত্তি হয়েছে। ধীরে ধীরে এই লুঙ্গি ছেয়ে গেছে দোহার-নবাবগঞ্জ, নরসিংদী, বাবুরহাট, পাবনাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। তবে উলেস্নখযোগ্য সরকারি সুযোগ-সুবিধা না থাকায় উদ্যোক্তারা এ শিল্প থেকে সরে দাঁড়াচ্ছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কেরানীগঞ্জের রামেরকান্দা-রুহিতপুর গ্রামের রুহিতপুরি লুঙ্গির তাঁতগুলোর খট খট শব্দ এক সময় আশপাশের কয়েক গ্রামে শোনা যেত। এই অঞ্চলে প্রায় সাড়ে তিন হাজার তাঁত ছিল। প্রায় লক্ষাধিক নারী-পুরুষের কর্মসংস্থান ছিল। কিন্তু কালের বিবর্তনে রুহিতপুরি লুঙ্গি শিল্প মৃত প্রায়।
এলাকাবাসী জানান, রুহিতপুর ইউনিয়নের উত্তর রামেরকান্দা, দক্ষিণ রামেরকান্দা, বাগরামের কান্দা, নারায়ণপট্টি, রুহিতপুর, কামারতা ও গোয়ালখালী গ্রামে প্রায় ১০ হাজারের বেশি হস্তচালিত তাঁত ছিল। প্রতিটি বাড়িতেই দুই থেকে তিনটি তাঁত ছিল। রঙ, সুতা ও বুনন শৈলীতে রুহিতপুরের লুঙ্গির কদর ছিল সবার কাছে। দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি করা হতো। কিন্তু রঙ, সুতাসহ অন্যান্য কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়ায় লুঙ্গির উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়। এতে বাজার মূল্যের চেয়ে উৎপাদন খরচ বেশি হওয়ায় লোকসানের মুখে পড়ে যান ব্যবসায়ীরা। এ কারণে ধীর ধীরে সিংহভাগ তাঁত বন্ধ হয়ে যায়। এই ঐতিহ্য ধরে রাখতে সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন এলাকাবাসী।
নারায়ণপট্টি এলাকার আব্দুল কাদের জানান, 'আমাদের বাড়িতে একসময় ১৫টি তাঁত ছিল। একটি তাঁতের পেছনে ১০ জন লোক কাজ করতেন। এখন কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়ায় তাঁত বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছি। এখন মাঠে কাজ করি। তিনি আরও জানান, এখানকার তাঁতে বোনা লুঙ্গি (রুহিতপুরি নামে পরিচিত) এখনো বাজারে ব্যাপক চাহিদা থাকলেও লোকসানের মুখে পড়ে এ শিল্প ধরে রাখতে হিমশিম খাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। গোয়ালখালী গ্রামে জব্বার আলী বলেন, আমাদের বাড়িতে একসময় পাঁচটা তাঁত ছিল। কিন্তু লোকসানের মুখে টিকতে না পেরে বন্ধ করে দিয়েছি। বাঁচার তাগিদে এখন চা-দোকান করছি। তিনি বলেন, রামেরকান্দা আর রুহিতপুরের তাঁতিরা সর্বপ্রথম শুরু করেন লুঙ্গি তৈরি। নিখুঁত হাতে বোনা এসব লুঙ্গি বরাবরই বাহারি, টেকসই আর মজবুত। পাকা রং হওয়ায় এর চাহিদাও বেশি।
তাঁত শ্রমিক লায়লা বেগম বলেন, 'ছোটবেলা থিকা এই কাজ করি। কোনদিনও কইতে পারুম না সরকার কোনো সাহায্য দিছে। তাঁতবোর্ড থেকে লোকজন আইসা খালি লেইখা নিয়া যায়। পরে কিছুই দেয় না। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করি লুঙ্গি বোনার।'
রামেরকান্দা এলাকায় তাঁতি আবুল কালাম বলেন, 'বাপ-দাদার পৈতৃক পেশা এখনো আঁকড়ে ধরে বেঁচে আছি। কারখানায় হস্তচালিত চারটি তাঁত রয়েছে। দু'জন নারী ও চারজন পুরুষকর্মী রয়েছেন। কেউ সানাভরা, কেউ তানামাঝা, কেউ তানা কাড়ানো এবং কেউ তাঁত বুননের কাজ করছেন।'
তাঁতের কারিগর মোহন দাস বলেন, প্রতি পিস লুঙ্গির মজুরি মাত্র ২০০ টাকা। দিনে দু'টির বেশি বুনতে পারি না। এই মজুরি দিয়ে সংসার চলে না।'
শরিফ কারখানার রুহিতপুর লুুঙ্গির প্রস্তুতকারক শরিফ হোসেন বলেন, 'রুহিতপুরি একথান লুঙ্গি (চার পিস) তৈরি করতে খরচ হয় তিন- সাড়ে চার হাজার টাকা আর তা বাজার বিক্রি করে পাওয়া যাচ্ছে দেড়-দুই হাজার টাকা। সুতাসহ আনুষঙ্গিক সব কিছুর দাম বেড়ে যাওয়ায় এ ব্যবসা ছেড়ে দিচ্ছেন অনেক তাঁতি। এছাড়াও ভারত থেকে কমদামে লুঙ্গি আসায় প্রভাব পড়েছে।'
বংশ পরম্পরায় এলাকার অনেকে আগলে রেখেছেন এ তাঁত শিল্পকে। তবে কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি, পুঁজির অভাব আর মজুরি না বাড়ায় অনেকে ঝুঁকছেন ভিন্ন পেশায় জানিয়ে বিলুপ্ত রুহিতপুর তাঁতি সমবায় সমিতির সাবেক সভাপতি আব্দুল খালেক বলেন, সরকার যদি হ্যান্ডলুম বোর্ডের মাধ্যমে তাঁতিদের সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করে এবং রঙ, সুতার দাম কমায় তাহলে আমাদের শতবর্ষের ঐতিহ্যবাহী এই রুহিতপুরি তাঁত শিল্পের হারানো গৌরবকে উদ্ধার সম্ভব হবে।
এ বিষয় রুহিতপুর ইউপি চেয়ারম্যান ও বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল আলী বলেন, আজ থেকে প্রায় ২০০ বছর আগে জীবন-জীবিকার তাগিদে খুব ভালোভাবেই গোড়া-পত্তন হয়েছিল এই শিল্পের। কেরানীগঞ্জের রামেরকান্দা-রুহিতপুর গ্রামের লোক সরাসরি এ পেশার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। দেশ স্বাধীনের আগে এ শিল্পের স্বর্ণযুগ ছিল। বিদেশি পোশাকের আগ্রাসন ও মেশিনের সাহায্যে দেশে লুঙ্গি উৎপাদন শুরু হলে '৮০-এর দশকে থেকে স্থানীয় লুঙ্গির চাহিদা কমতে থাকে। মেশিনের সাহায্যে তৈরি লুঙ্গি কম দাম হওয়ায় মানুষজন ওদিকেই ঝুঁকতে থাকে। কিন্তু গুণাগুণের দিক বিবেচনা করলে হাতের সাহায্যে বোনা লুঙ্গি সবদিক থেকেই উন্নত। যে কারণে রুচিশীল মানুষের কাছে প্রথম পছন্দ রুহিতপুরি তাঁতের সাহায্যে বুনানো লুঙ্গি।' তিনি বলেন, 'এখন ৮ থেকে ৯টা বাড়িতে তাঁতের কাজ চলছে। এ সম্প্রদায়ের লোকজন এ কাজ ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমানোর কারণে শ্রমিকের অভাবে মারাত্মক হুমকির মধ্যে পড়েছে এ শিল্পটি। এছাড়া উৎপাদিত লুঙ্গির নিয়মিত হাট বসত রামেরকান্দা-রুহিতপুর বাজারে। এখন সেই হাটও আগের মতো জমজমাট নেই।'
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোকলোর বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আব্দুলস্নাহ আল-মামুন বলেন, 'জামদানি থেকে শুরু করে লুঙ্গি বাঙালির সংস্কৃতির অংশ। এ শিল্প টিকিয়ে রাখতে হলে প্রয়োজন টেকসই উন্নয়ন ও সরকারের সহযোগিতা। প্রয়োজন নায্যমূল্যে শ্রমিকের সরবরাহ; সেই সঙ্গে স্থানীয়দের এ কাজে মনোনিবেশ করা। তাহলেই যুগ যুগ ধরে টিকে থাকবে ঐতিহ্যবাহী রুহিতপুর লুঙ্গি।'