বইমেলা প্রতিদিন

প্রকৃত পাঠকের একদিন

প্রকাশ | ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০০:০০

এস এম মামুন হোসেন
শিশুর মন ভালো রাখতে বাবা-মায়ের আগ্রহের শেষ নেই। তাই অমর একুশে গ্রন্থমেলায় শিশুপ্রহরে শুক্রবার ছিল উপচেপড়া ভিড়। ছবিটি সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে তোলা -যাযাদি
অন্যান্য বার অমর একুশে বই মেলার পরের দুই-একদিন সাধারণত ভিড় একটু কম লক্ষ্য করা যায়; কিন্তু এবার একুশের পরের দিন অর্থাৎ শুক্রবারের চিত্রটি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। প্রচুর লোক সমাগমের পাশাপাশি বিক্রিবাট্টাও হয়েছে এবার মেলা শুরুর পর সর্বাধিক। এ কারণে লেখক প্রকাশকদের মুখেও ছিল আনন্দের হাসি। গতকাল ছুটির দিন থাকায় মেলার দ্বার খোলে সকাল ১১টায়। তখন থেকেই লোক সমাগম ঘটে। সকালে শিশুদের উপস্থিতিও ছিল ভালো। বাচ্চাদের বই বিক্রি হয় বেশ। শিশু চত্বরে ছোট সোনামণিদের কলকাকলিতে মুগ্ধ হয় আগত সকলেই। সকাল ১১টা থেকে জুমার নামাজের আগ পর্যন্ত মেলা চলে পুরোদমে। সকালের এ সময়ে বাচ্চাদের বই-ই বেশি বিক্রি হয়। তবে পাশাপাশি বড়দের বইও বিক্রি হয় এ সময়। দুপুর ৩টায় দ্বিতীয়বার মেলার দ্বার খুললে বদলে যায় পুরো মেলার চিত্র। টিএসসি এবং দোয়েল চত্বরের পাশাপাশি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ছোট প্রবেশ দ্বার দিয়েও মানুষের প্রবেশের ঢল নামে। লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে মেলায় প্রবেশ করতে দেখা যায় মানুষকে। স্টল ও প্যাভিলিয়নগুলোতেও ছিল মানুষের উপচে পড়া ভিড়। যারাই এসেছেন তারাই কিনেছেন বই। তবে নতুন বইয়ের চেয়ে পুরনো বইয়ের বিক্রি বেশি বলে জানান প্রকাশকরা। বই মেলায় আগতরা বইয়ের পাতা উল্টে উল্টে পছন্দ করেছেন মনের মতো বইটি। স্বাচ্ছদ্যে স্টল থেকে স্টল দর্শন করে কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধের বইগুলো থেকে বেছে নিয়েছেন নিজস্ব চাহিদার বই। দিনটি ছিল প্রকৃত বইপ্রেমীদের জন্য। সামনের দিনগুলোতেও বইপ্রেমীদের এ ভিড় থাকবে বলে মনে করেন আগতরা। অনেকেই জানিয়েছেন, ঘুরতে আসা পাঠকরা মূলত প্রথম দিনগুলোতেই আসে। কিন্তু মেলার শেষের দিকে যারাই আসেন তারা বই ক্রয় করেন বলে জানিয়েছেন তারা। এছাড়া এদিন শুক্রবার থাকায় একটু বেশি বিক্রি হয়েছে। যা বিক্রেতাদের মুখে যুগিয়েছে বাড়তি হাসি। মেলা হতে বের হওয়ার জন্য সোহরাওয়ার্দীতে দুটি এবং বাংলা একাডেমিতে একটি গেট রয়েছে। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা নাগাদ বের হওয়ার এ গেটগুলোতে দাঁড়িয়ে দেখা যায় যারাই বের হচ্ছেন তাদেরই দু'হাত ভরা বইয়ের ব্যাগ। এবার মেলা শুরুর পর এত বই নিয়ে আর কোনোদিন পাঠককে বের হতে দেখা যায়নি। এর সত্যতাও মিললো প্রকাশকদের সঙ্গে কথা বলে। রাবেয়া বুকস এর কর্ণধার জাবের হোসেন যায়যায়দিনকে বলেন, 'এবারের মেলায় আজই সবচেয়ে বেশি বিক্রিবাট্টা হয়েছে। শুক্রবার থাকায় লোক সমাগমও অনেক বেশি। এছাড়া শুক্রবার বিক্রি একটু বেশিই হয়। তবে এবারের মেলার মধ্যে আজকের শুক্রবারই সেরা বিক্রি হয়েছে। এখন থেকে ঘুরতে আসা পাঠকের চেয়ে প্রকৃত পাঠকের সংখ্যা বাড়বে। আর এ কারণে এখন থেকে বিক্রি বেশি হবে বলেই আমাদের ধারণা।' একজন পাঠক মোলস্না মোহাম্মদ আনোয়ার। তার দুই হাত ভর্তি নতুন কেনা বইয়ের ব্যাগ। বললেন, 'সাধারণত আমি একুশে ফেব্রম্নয়ারির আগে মেলায় আসলেও, বই কিনি না। কারণ এত মানুষের ভিড়ে পছন্দের বইগুলো দেখার সুযোগ পাওয়া যায় না। তাই প্রতি বছর বই কেনার জন্য এ সময়টাকেই আমি বেছে নিই। কারণ বইগুলো দেখে ও স্বস্তিতে স্টলে স্টলে ঘুরে কিনতে পারি। যদিও আজ ভিড় বেশি। তবে গতকালের তুলনায় বেশ কমই বলব। আজ কিনেছি। আরও একদিন আসবো কিনতে।' শুধু পাঠকের মধ্যে নয়, প্রকাশকদের মধ্যেও গতকাল ছিল চোখে পড়ার মতো উচ্ছ্বাস। কারণ দর্শনার্থীদের ভিড়ের সঙ্গে আছে প্রকৃত ক্রেতা। প্রকাশকদের ভাষায় তারা এমনই ভিড় এবং কেনাকাটার আশায় থাকেন। অবসর গ্রন্থ প্রকাশের মাসুদ রানা এ বিষয়ে বলেন, 'অনেক পাঠক এসেছেন। কিনছেনও প্রচুর বই। আমরাতো এমন দিনের আশাতেই থাকি। লোকও বেশি বিক্রিও বেশি। যারাই আসছেন তারাই বই নিয়ে ফিরছেন। এ অবস্থায় আমাদেরতো ভালো না থাকার কোনো কারণ নেই।' উপস্থিত বক্তৃতার পুরস্কার প্রদান : গতকাল সকাল সাড়ে ১০টায় অমর একুশের উদযাপনের অংশ হিসেবে শিশু-কিশোর চিত্রাঙ্কন, সংগীত প্রতিযোগিতা, সাধারণ জ্ঞান ও উপস্থিত বক্তৃতা প্রতিযোগিতায় বিজয়ী শিশু-কিশোরদের পুরস্কার প্রদান করা হয়। পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদ। শুভেচ্ছা বক্তব্য প্রদান করে বাংলা একাডেমির সচিব মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন। শিশু-কিশোর চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা : ক-শাখায় আনায়া জাকির হোসেন (প্রথম), এস এম নাহিয়ান (দ্বিতীয়) এবং তাহেরুননেসা রিচি (তৃতীয়) ; খ-শাখায় আল মুমিনুর (প্রথম), অর্নিলা ভৌমিক (২য়) এবং মেহেনাজ আক্তার নাদিয়া (তৃতীয়); গ-শাখায় আফরিদা ফারহানা খান (প্রথম) নবনীতা হালদার (দ্বিতীয়) এবং নাফিসা তাবাসসুম অথৈ (তৃতীয়) স্থান লাভ করে। শিশু-কিশোর সংগীত প্রতিযোগিতা : ক-শাখায় সুবরানা আলী সোহা ও তানজিম বিন তাজ প্রত্যয় (প্রথম), সহিষ্ণু আইচ ও সিদরাতুল মুনতাহার (দ্বিতীয়), আফরা আদিলা রিমঝিম ও জাহিন জারা তাবাসসুম (তৃতীয়)। খ-শাখায় গার্গী ঘোষ ও তানিশা জাহান নরিকা (প্রথম), মো. রেজওয়ানুল করিম তানভীর ও অধরা সরকার (দ্বিতীয়) এবং উম্মে তাসনিয়া বুশার ও মৈত্রেয়ী ঘোষ (তৃতীয়) স্থান লাভ করে। শিশু-কিশোর উপস্থিত বক্তৃতা প্রতিযোগিতা: নিসার বিন সাইফুলস্নাহ জাহিন (প্রথম), কাশফিয়া কাওসার চৌধুরী (দ্বিতীয়) এবং শাঁওলী সামরিজা (তৃতীয়) স্থান লাভ করে। সাধারণ জ্ঞান প্রতিযোগিতা : মো. মুনতাজিম রহমান সায়মন (প্রথম), নুসাইবা নাজমী খান ও তাইয়ে্যবা (দ্বিতীয়) এবং মো. শাহারিয়ার আহম্মেদ (তৃতীয়) স্থান লাভ করে। পুরস্কার বিতরণির প্রধান অতিথির বক্তব্যে চিত্রশিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদ বলেন, শিশুরা লেখাপড়া করে কেবল ডাক্তার-প্রকৌশলী হবে এমন নয়। সৃজনশীল প্রতিভার বিকাশ ঘটিয়ে তারা বিশ্ববিখ্যাত হতে পারে। আমি আশা করি আমাদের শিশুরা একদিন তাদের মেধা ও মনন দিয়ে আমাদের দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। মূল মঞ্চের আয়োজন : বিকেল ৪টায় গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকার শতবর্ষ : ফিরে দেখা শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ড. মাহবুবুল হক। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন সাইফুদ্দীন চৌধুরী, আলী হোসেন চৌধুরী এবং এম আবদুল আলীম। সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক আবুল আহসান চৌধুরী। লেখক বলছি অনুষ্ঠানে নিজেদের নতুন প্রকাশিত গ্রন্থ বিষয়ে আলোচনায় অংশ নেন আলমগীর রেজা চৌধুরী, মোস্তফা সেলিম, মোহাম্মদ সেলিম, সাধনা আহমেদ এবং খন্দকার স্বনন শাহরিয়ার। কবিকণ্ঠে কবিতাপাঠ করেন কবি কুমার চক্রবর্তী, জাহানারা পারভীন, মুস্তাফিজ শফি, মাহবুব আজীজ, তুষার কান্তি দাশ, মাজুল হাসান, প্রত্যয় জসীম এবং আয়শা ঝর্ণা। আবৃত্তি পরিবেশন করেন আবৃত্তিশিল্পী ফয়জুল আলম পাপ্পু এবং মো. মাহমুদুল হাকিম। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ছিল লায়লা হাসানের পরিচালনায় নৃত্য সংগঠন 'নটরাজ'; সাংস্কৃতিক সংগঠন 'ক্রান্তি শিল্পীগোষ্ঠী', নাঈম হাসান সুজার পরিচালনা নৃত্যসংগঠন 'নৃত্যজন' এবং ইমন চৌধুরীর পরিচালনায় নৃত্যসংগঠন 'ফাল্গুনী সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়ন সংস্থা'র শিল্পীবৃন্দের পরিবেশনা। আজকের কর্মসূচি : আজ মেলা চলবে সকাল ১১টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত। শিশু প্রহর: আজ সকাল ১১টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত মেলায় শিশুপ্রহর ঘোষণা করা হয়েছে। আলোচনা অনুষ্ঠান : বাংলাদেশের প্রকাশনা : অতীত ও বর্তমান বিকেল ৪টায় গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে বাংলাদেশের প্রকাশনা : অতীত ও বর্তমান শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন মাহরুখ মহিউদ্দিন। আলোচনায় অংশগ্রহণ করবেন ফরিদ আহমেদ, মোহাম্মদ ইশতাক হোসেন এবং এএফ এম হায়াতুলস্নাহ। সভাপতিত্ব করবেন অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান। সন্ধ্যায় রয়েছে কবিকণ্ঠে কবিতা পাঠ, কবিতা-আবৃত্তি ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।