ব্রিজ ভাঙা, তাই কাঠের পাটাতন দিয়ে পারাপার

১০ বছরে ব্রিজ থেকে নিচে পড়ে মারা গেছে ৩ জন, আহত হয়েছেন অনেকে, তবুও কর্তৃপক্ষ নীরব

প্রকাশ | ১১ আগস্ট ২০২৩, ০০:০০

তারেক মাহমুদ, ঝিনাইদহ
'আমাদের গ্রামের ব্রিজটি দীর্ঘ ১০ বছর ধরে ভেঙে পড়ে আছে। এ সময়ে ব্রিজটি পার হতে গিয়ে তিনজন মারা গেছে। আহত হয়েছে আরও অনেকে। আমি নিজেও ব্রিজ থেকে নিচে পড়ে আহত হয়েছিলাম। এরপর থেকে আর চলাফেরা বা ভারি কাজ করতে পারি না। এলাকার মানুষ টাকা উঠিয়ে আমাকে একটা চায়ের দোকান করে দিয়েছেন। সেই চায়ের দোকান দিয়ে এখন আমার সংসার চলছে, কিন্তু ব্রিজটা আজও হলো না।' এভাবেই আক্ষেপ নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন ঝিনাইদহ শৈলকুপা উপজেলার গোলকনগর গ্রামের মধ্যবয়সি মো. শামসুদ্দিন। গ্রামবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঝিনাইদহের শৈলকুপায় জিকে সেচ প্রকল্পের গোলকনগর খালের উপর ব্রিজটির অবস্থান। এটি হাটফাজিলপুর-নিত্যনন্দনপুর বাওড় এলাকায় যাতায়াতের একমাত্র রাস্তা। কিন্তু সেটি দীর্ঘ ১০ বছরের বেশি সময় ধরে ভেঙে পড়ে আছে। এতে খালের দুই পাড়ের প্রায় ২০ গ্রামের ৫০ হাজার মানুষ ভোগান্তিতে পড়েছেন। যাতায়াতের বিকল্প ব্যবস্থা না থাকায় এলাকাবাসী ভাঙা ব্রিজের উপর কাঠের পাটাতন দিয়ে কোনো রকমে পারাপারের ব্যবস্থা করেছেন। মানুষ বাধ্য হয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এ ব্রিজটির ওপর দিয়ে পার হচ্ছেন। এতে প্রায়ই দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে স্কুল ও মাদ্রাসাগামী শিক্ষার্থীসহ নারী ও শিশুরা। সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, ব্রিজের পশ্চিমপাশে উপজেলার ১২নং নিত্যনন্দনপুর ইউনিয়ন। পূর্বপাশে হাটফাজিলপুর বাজার। নিত্যনন্দনপুর ইউনিয়নের ১০ থেকে ১২ গ্রামের মানুষ ব্রিজটি পার হয়ে বেচাকেনাসহ প্রয়োজনীয় কাজে হাটফাজিলপুর বাজারে যান। ব্রিজটির পশ্চিম পাশ ঘেঁষে ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রাম থেকে মাত্র ১ থেকে ২ কিলোমিটার পাড়ি দিলেই হাটফাজিলপুর বাজার। কিন্তু ব্রিজটি ভাঙা থাকায় ৫ থেকে ৭ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে তাদের ভারী মালামাল নিয়ে ওই বাজারে যেতে হয়। খালের দুই পাশে পাকা রাস্তা থাকলেও ভাঙা ব্রিজটির কারণে গাড়ি চলাচল করতে পারে না। এছাড়া ব্রিজটির রেলিং ও মাঝখানে পাটাতন ভেঙে পড়েছে। ব্রিজের ভেঙে যাওয়া অংশে কাঠের পাটাতন দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ চলাচল করছে গ্রামবাসী। অনেকে ইজিবাইক বা চাষকাজে ব্যবহৃত পাওয়ার ট্রলি নিয়ে ভাঙা ব্রিজ দিয়েই পারাপার হন। শামসুদ্দিন দুঃখ প্রকাশ করে আরও বলেন, ব্রিজর কথা বলব কি আর। কত লোক এলোগেল। আমাদের আশ্বাস দিল, কিন্তু ১০ বছরেও ব্রিজ হলো না। আমাদের এমপি একটা অনুষ্ঠানে এই পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন, কিন্তু ব্রিজ ভাঙা দেখে গাড়ি ঘুরিয়ে অন্য গ্রাম দিয়ে গিয়ে অনুষ্ঠানে যোগ দিলেন। তবুও ব্রিজ করার জন্য কোনো উদ্যোগ নিলেন না। আমাদের গ্রামের মানুষ তাদের ফসল নিয়ে ব্রিজ পারাপার হতে পারে না। ঠেলাগাড়িতে মালামাল পরিবহণ করতে হয়। মো. রোকনুজ্জামান রোকন বলেন, 'এই ব্রিজটা আমাদের গ্রামসহ ১৫ থেকে ২০ গ্রামের মধ্যে যোগাযোগের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। এই ব্রিজ দিয়ে পারাপার হতে গিয়ে আমার বাবাও পড়ে গিয়েছিল। ব্রিজটি ভেঙে পড়ার কারণে আমরা আর্থিকভাবে যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। তেমনিভাবে নানা সমস্যার মোকাবিলা করতে হচ্ছে। অনেক সময় সোজা রাস্তা রেখে চার/পাঁচ গ্রাম ঘুরে বাজারে যেতে হয়। আমরা গ্রামের সবাই টাকা তুলে কাঠের পাটাতন তৈরি করে ঝুঁকিপূর্ণভাবেই চলাচলের একটা ব্যবস্থা করেছি ঠিক, কিন্তু দুর্ঘটনার আতংকে থাকতে হয়।' স্থানীয় বাসিন্দা মো. ফজলুর রহমান বলেন, 'আমাদের ব্রিজটা বহুদিন ধরে ভাঙা অবস্থায় পড়ে আছে। অনেকে মারা গেছেন, অনেকে আবার পড়ে আহত হয়েছেন। এ বিষয়ে আমরা এমপির কাছে গিয়েছি, কোনো কাজ হয়নি। সবাই বলে এটা ওয়াদার ব্রিজ, এটা তারা করবে। কার ব্রিজ কে করবে আমরা বুঝি না। আমরা চাই আমাদের ব্রিজটা যেন করে দেওয়া হয়। শিক্ষার্থী রাজিব হোসেন বলেন, 'এ ভাঙা ব্রিজের উপর দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে পারাপার হতে গিয়ে অনেক সময় ভ্যানসহ অন্যান্য যানবাহন নিচে পড়ে যায়। ছোট বাচ্চারা স্কুলে যাওয়ার সময় ব্রিজ থেকে পড়ে গিয়ে হাত ভাঙার ঘটনাও ঘটেছে।' ঝিনাইদহ বাপাউবো নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আবু রায়হান বলেন, আমাদের কোনো উন্নয়ন প্রকল্প নেই। যতটুকু বাজেট হয় সেগুলো দিয়েই আমরা মেরামত কাজ করি। এই ব্রিজের সমস্যার কথাটা আমি জানি। শুধুমাত্র এই ব্রিজ না আরো অনেক ব্রিজ খারাপ আছে। তবে এই ব্রিজের যে অবস্থা ওখানে নতুন ব্রিজ তৈরি করতে হবে। এজন্য আমরা এ বছর আলাদাভাবে প্রস্তাবনা দিয়েছি ব্রিজটির জন্য। এছাড়া অন্যান্য ব্রিজের জন্যও প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে, পাস হলে ব্রিজের কাজ করা হবে।'