নবীনগরে মেঘনা নদীতে বালু উত্তোলনের মহোৎসব
প্রকাশ | ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০০:০০
স্টাফ রিপোর্টার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলার বীরগাঁও ইউনিয়নের কেদেরখোলা গ্রামে মেঘনা নদীতে বালু মহালের নির্ধারিত সীমানার বাইরে থেকে ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলনের মহোৎসব চলছে। প্রায় ১৫ থেকে ২০টি ড্রেজার দিয়ে সেখান থেকে রাত-দিন বালু তোলা হচ্ছে।
এভাবে বালু উত্তোলন অব্যাহত থাকলে নদী তীরবর্তী গ্রামসহ ফসলি জমি যে কোনো মুহূর্তে নদীতে বিলীন হয়ে যেতে পারে।
এদিকে পশ্চিম কেদেরখোলা বালু মহালের সঠিক সীমানা নির্ধারণসহ অপরিকল্পিত ও নিয়মবহির্ভূত বালু উত্তোলন বন্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে গত ৭ আগস্ট নবীনগর উপজেলা সহকারী কমিশনারের (ভূমি) কাছে লিখিত আবেদন করেন উপজেলার বীরগাঁও ইউনিয়নের সাবেক ইউপি সদস্য শফিকুল ইসলাম।
অভিযোগে বলা হয়, কেদেরখোলা পশ্চিম বালু মহালের আয়তন ২০ একর। গত ১৫ জুলাই করা বিআইডবিস্নউটিএ'র হাইড্রোগ্র্যাফিক জরিপের নিয়মকে তোয়াক্কা না করে যেখানে দুই থেকে তিনটি ড্রেজার চালানোর অনুমতি আছে- সেখানে ১০০ থেকে ১২০ একর জায়গায় ৮০ থেকে ৯০ ফুট গভীর থেকে অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে।
প্রতিদিন ১৫ থেকে ২০টি ড্রেজার দিয়ে গড়ে ১৫ থেকে ২০ লাখ ঘনফুট বালু তোলা হচ্ছে। এভাবে
নিয়মবহির্ভূতভাবে বালু উত্তোলন অব্যাহত থাকলে নবীনগর উপজেলার শিবপুর, দাসকান্দি, নজরদৌলত, ছয়ঘরহাটি হয়ে কেদেরখোলা পর্যন্ত গ্রামগুলোর ফসলি জমি ও বাড়িঘর নদীতে বিলীন হয়ে যাবে।
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, সর্বোচ্চ দরদাতা হওয়ায় গত ১৩ জুলাই মো. বরকত উলস্নাহ সাগরের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স জাহানারা কনস্ট্রাকশন অ্যান্ড সাপস্নাইয়ার্সকে আড়াই কোটি টাকায় বাংলা সনের ৩০ চৈত্র পর্যন্ত কেদেরখোলা বালু মহাল ইজারা দেওয়া হয়। প্রতিদিন সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত কেদেরখোলা মৌজা থেকে বালু উত্তোলনে ইজারা পাওয়া ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে ১০টি ড্রেজার ব্যবহার করার শর্ত দেওয়া হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বালু উত্তোলনের সঙ্গে জড়িত এক ব্যক্তি জানান, বীরগাঁও ইউপি চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন ও আওয়ামী লীগ নেতা হোসেন সরকারের দু'টি, কেদেরখোলা গ্রামের একটি, নজরদৌলত (গাছতলা) গ্রাম থেকে আওয়ামী লীগ নেতা আফজাল হোসেনের একটি, ইজারাদার বরকত উলস্নাহ সাগর দু'টি এবং নরসিংদী জেলার চানপুর গ্রামের তিনটি ও আশুগঞ্জ উপজেলার লালপুর গ্রামের একটি ড্রেজার বালু উত্তোলনে ব্যবহার করা হচ্ছে। এর বাইরেও প্রভাবশালীদের কয়েকটি ড্রেজার রয়েছে।
তার ভাষ্যমতে, প্রতিদিন ৬০ থেকে ৭০টি বড় স্টিলের ইঞ্জিনের নৌকায় গড়ে প্রায় সাড়ে তিন লাখ থেকে চার লাখ ২০ হাজার ঘনফুট বালু উত্তোলন করা হচ্ছে।
এ ব্যাপারে নবীনগর উপজেলার বীরগাঁও ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান কবির আহমেদ ও ইউনিয়ন যুবলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক হযরত আলী সরকার জানান, বীরগাঁও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি হোসেন সরকার, সাবেক সাধারণ সাধারণ সম্পাদক আফজাল হোসেন ও বীরগাঁও ইউপি চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন, সাবেক ইউপি সদস্য ইউসুফ মিয়া ও বিএনপির কর্মী হাবিব মিয়ার নেতত্বে চলছে এই বালু উত্তোলনের মহোৎসব। এসবের প্রতিবাদ করায় ইজারাদারের লোকজন স্থানীয় আলমগীর হোসেনকে প্রধান করে ১০ জনকে আসামি করে তহশিলদারকে দিয়ে একটি মামলা করিয়েছেন। তারা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এভাবে বালু উত্তোলন অব্যাহত থাকলে গ্রাম ও ফসলি জমি মেঘনার গর্ভে বিলীন হয়ে যাবে।
বীরগাঁও ইউনিয়নের দাসকান্দি গ্রামের নারায়ণ চন্দ্র দাস ও আশ্রাফ উদ্দিন বলেন, প্রতিদিন সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত কেদেরখোলা মৌজার বাইরে থেকে এবং রাত থেকে ভোর সকাল পর্যন্ত নদীর তীরের কাছাকাছি এলাকা থেকে তারা বালু উত্তোলন করছেন। তারা প্রতিদিন প্রায় চার লাখ থেকে সাড়ে চার লাখ ঘনফুট বালু উত্তোলন করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন।
এ ব্যাপারে বীরগাঁও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আফজাল হোসেন বলেন, আমরা নির্ধারিত সীমানা থেকে বালু উত্তোলন করছি। উপজেলা প্রশাসন বিষয়টি তদারকি করছে।
এ ব্যাপারে বীরগাঁও ইউপির চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন বলেন, আমি বালু উত্তোলনের সঙ্গে জড়িত নই। যারা এখন অভিযোগ করছেন, তারা নিজেদের লাভের জন্য এমন অভিযোগ করছেন।
এ ব্যাপারে ইজারাদার বরকত উলস্নাহ সাগরের সঙ্গে কথা বলার জন্য তার মোবাইল ফোনে এ প্রতিবেদক কয়েক দফা চেষ্টা করলেও তার ফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়।
এ ব্যাপারে বীরগাঁও ইউনিয়ন ভূমি উপ-সহকারী কর্মকর্তা সালেক আহমেদ বলেন, ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে বালু মহালের নির্ধারিত সীমানার প্রায় ১০০ থেকে ১৫০ ফুট বাইরে বালু উত্তোলন করতে দেখা গেছে। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন স্যারদেরও জানানো হয়েছে।
নবীনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তানভীর ফরহাদ সাংবাদিকদের বলেন, ইজারার নির্ধারিত জায়গার বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এর ব্যতিক্রম হলে আমরা ব্যবস্থা নেব। তারা ১০টির বেশি ড্রেজার ব্যবহার করতে পারবে না। ১০টি বেশি ড্রেজার ব্যবহার করলে আমরা সেগুলো জব্দ করব।
এ ব্যাপারে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মোহাম্মদ রুহুল আমিন বলেন, সূর্যোদয়ের পর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত বালু মহালের নির্ধারিত সীমানা থেকে বালু উত্তোলনের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। শুধু আশুগঞ্জ নৌবন্দর থেকে আখাউড়া স্থলবন্দর পর্যন্ত চারলেন রাস্তার কাজের কথা বিবেচনা করেই বালুমহাল ইজারা দেওয়া হয়েছে।