মানুষের হাতে থাকা ডলার ব্যাংকে টানার উদ্যোগ
প্রকাশ | ০৭ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০
এম সাইফুল
নানা উদ্যোগের পরও ধারাবাহিকভাবে কমছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। পাশাপাশি বাড়ছে টাকার বিপরীতে ডলারের দরও। মূলত ডলার সংকটের কারণেই এমনটি হচ্ছে। ডলার সাধারণ মানুষের হাতে চলে গেছে বলে ধারণা করছেন নীতিনির্ধারকরা। তাই এবার সাধারণ মানুষের হাতে থাকা ডলার ব্যাংকিং চ্যানেলে আনার উদ্যোগ নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। যদিও এ উদ্যোগ কতটা সফল হবে সেটি নিয়ে সন্দেহ রয়েছে বিশেষজ্ঞদের।
পর্যাপ্ত রিজার্ভ থাকায় ডলারের দর নিয়ন্ত্রণে রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিয়মিত ডলার বিক্রি করেছে। ডলারের ঘাটতি মেটাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ২০২২-২৩ অর্থবছরে রিজার্ভ থেকে রেকর্ড ১৩ দশমিক ৫৮ বিলিয়ন ডলার ব্যাংকগুলোর কাছে বিক্রি করেছে। অথচ এখন ব্যাংকগুলোর কাছে পর্যাপ্ত ডলার নেই। তাহলে সে ডলার কোথায়? এসব ডলার মানুষের হাতে হাতে রয়েছে।
নানা প্রণোদনায় দিয়েও রপ্তানি আয় এবং বৈধ পথে রেমিট্যান্স আনতে পর্যাপ্ত সাড়া পাওয়া যচ্ছে না। তাই এখন সাধারণ মানুষের হাতে থাকা ডলার উচ্চ সুদে নেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
জানা গেছে, বিদেশ ভ্রমণ শেষে বা মানুষের হাতে থাকা ডলার বাজারমূল্য থেকেও উচ্চ সুদে ব্যাংকিং চ্যানেলে নিতে নতুন উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। মূলত বিদেশে চিকিৎসা, ভ্রমণ ও সন্তানের পড়াশোনার জন্য দেশ থেকে অনেকেই টাকা পাঠায়। খোলাবাজার থেকে এসব ডলার কিনে হুন্ডির মাধ্যমে পাঠায় বলে সন্দেহ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। তাই এসব ডলার উচ্চ সুদে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
জানা গেছে, অনেকেই ডলারের দর বাড়তে পারে এমন আশায় নিজেদের হাতে ডলার জমা রেখেছেন। এসব ডলার ব্যাংকিং চ্যানেলে আনতে পারলে রিজার্ভে কিছুটা হলেও প্রভাব পড়বে বলে মনে করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বিদেশ ভ্রমণ শেষে দেশে ফিরে খোলা রেসিডেন্ট ফরেন কারেন্সি ডিপোজিট (আরএফসিডি) হিসাবে জমার ওপর এখন থেকে ৭ শতাংশের বেশি সুদ দেবে ব্যাংক। এছাড়া এ ধরনের হিসাব থেকে দেশের বাইরে অর্থ পাঠানো, একাধিক কার্ড ইসু্যসহ বিভিন্ন সুবিধা পাওয়া যাবে। দেশের ডলার সংকট কাটাতে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
গত ৪ ডিসেম্বর এ সংক্রান্ত একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, আরএফসিডি হিসাবে একজন ১০ হাজার ডলার জমা রাখতে পারেন। এখন থেকে এ জমার ওপর ব্যাংকগুলো বেঞ্চমার্ক রেটের সঙ্গে আরও অন্তত দেড় শতাংশ সুদ দেবে। এই হিসাবে জমার বিপরীতে দুটি সাপিস্নমেন্টারি কার্ড ইসু্য করা যাবে। সন্তান বা ভাই-বোনসহ তার ওপর নির্ভরশীল ব্যক্তি সেই কার্ড ব্যবহার করতে পারবেন। এই অ্যাকাউন্ট থেকে দেশের বাইরে শিক্ষার খরচ পাঠানো যাবে। আবার নিজের ওপর নির্ভরশীল তথা স্ত্রী বা স্বামী, সন্তান, ভাইবোন, পিতা-মাতার চিকিৎসার খরচও এখান থেকে বহন করা যাবে।
বাংলাদেশ ব্যাংক বেঞ্চমার্ক রেট বলতে এসওএফআর, লাইবর, ইউরিবরের মতো রেফারেন্স রেট বা সংশ্লিষ্ট দেশের মুদ্রার সুদহারের নির্দেশককে বোঝানো হয়। এর মাধ্যমে সেখানকার আমানত, ঋণ, আন্তঃব্যাংক লেনদেনে সুদহার কেমন তার একটি ধারণা পাওয়া যায়। বর্তমানে ডলার, ইউরোসহ অনেক মুদ্রার বেঞ্চমার্ক সুদহার সাড়ে ৫ শতাংশের বেশি। এর মানে, এ ধরনের জমার ওপর ৭ শতাংশের বেশি সুদ পাওয়া যাবে।
চলমান সংকট কাটাতে বেশি সুদে ডলার আনতে আগের সপ্তাহে অপর একটি নির্দেশনার মাধ্যমে প্রবাসী বাংলাদেশির পাঠানো রেমিট্যান্সের সুবিধাভোগীর নামেও বৈদেশিক মুদ্রায় হিসাব খোলার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। সুবিধাভোগীর নামে খোলা অ্যাকাউন্টে তিন মাস থেকে পাঁচ বছর মেয়াদে অর্থ রেখে ৭ থেকে ৯ শতাংশের বেশি সুদ পাওয়া যাবে; অন্যান্য দেশের তুলনায় যা বেশি। প্রবাসীর সুবিধাভোগী ছাড়া অন্য যারা বৈদেশিক মুদ্রায় হিসাব খুলতে পারেন, তারাও এ হারে সুদ পাবেন। দেশের বাইরে ধরে রাখা ডলার আনতে ওই নির্দেশনা দেওয়া হয়।
জানা গেছে, সাধারণত যারা দেশের বাইরে বেশি যান কিংবা যাদের ছেলে-মেয়ে বাইরে পড়ালেখা করেন, তারাই বাজার থেকে নগদ ডলার কিনে ঘরে রেখে থাকতে পারেন। এখন অনেকেই ডলার কিনে ধরে রাখায় বাজারে নগদ ডলারের চরম সংকট তৈরি হয়েছে। এ অবস্থায় ঘরে রাখা ডলার ব্যাংকে আনতে নতুন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কেউ যে কোনো প্রয়োজনে দেশের বাইরে গিয়ে ফেরার পর আরএফসিডি হিসাব খুলে ১০ হাজার ডলার পর্যন্ত জমা রাখতে পারেন। কেউ হয়তো যাওয়ার সময় ৫০০ ডলার সঙ্গে নিয়েছিলেন। ফেরার পর ১০ হাজার ডলার দিয়ে অ্যাকাউন্ট করলেও কোনো প্রশ্নের মুখে পড়তে হবে না। মূলত মানুষের হাতে থাকা ডলার ব্যাংকে আনতে এমন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
এদিকে গত সপ্তাহে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ১৯ দশমিক ৪০ বিলিয়ন ডলারে, যা গত ২২ নভেম্বর ছিল ১৯ দশমিক ৫২ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, এক সপ্তাহের ব্যবধানে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ প্রায় ১২০ মিলিয়ন ডলার কমেছে।
৩০ নভেম্বর ১৯ দশমিক ৪০ বিলিয়ন ডলারে, যা গত ২২ নভেম্বর ছিল ১৯ দশমিক ৫২ বিলিয়ন ডলার। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ফর্মুলার মেনে রিজার্ভের তথ্য জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এর আগে, ২০২১ সালের আগস্টে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছিল, যা ছিল দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। কিন্তু বৈদেশিক মুদ্রার আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হওয়ায় রিজার্ভ কমতে শুরু করে এবং তা অব্যাহত আছে। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঘাটতি মেটাতে ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রি করেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্র জানায়, গত ১ জুলাই থেকে ২৮ নভেম্বরের মধ্যে ব্যাংকগুলোর কাছে ৫ বিলিয়নের বেশি ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রতি কার্যদিবসে বাংলাদেশ ব্যাংক তার রিজার্ভ থেকে ব্যাংকগুলোর কাছে গড়ে প্রায় ৬০ মিলিয়ন ডলার বিক্রি করে।
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন, বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন এবং বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের মতো সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর আমদানি ব্যয় পরিশোধের জন্য বেশিরভাগ রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বিদেশি ঋণ বেড়ে যাওয়া এবং আমদানি ব্যয় মেটাতে গিয়ে সাধারণ মানুষের হাতের ডলার আনা কতটুকু সম্ভব হবে এটি নিয়েও সন্দেহ রয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ছয় বছরে ডলারের হিসাবে বিদেশি ঋণ বেড়েছে ৪২ দশমিক ৯৩ বিলিয়ন ডলার বা ৭৬ দশমিক ৬৫ শতাংশ। অথচ এ সময় টাকার হিসাবে বিদেশি ঋণ বেড়েছে পাঁচ লাখ ৭৯ হাজার ৮২০ কোটি ৩০ লাখ টাকা বা ১২৩ দশমিক ৬৪ শতাংশ।
তথ্যমতে, ২০২২-২৩ অর্থবছর বিদেশি ঋণের স্থিতি সামান্য বেড়ে দাঁড়ায় ৯৮ দশমিক ৯৪ বিলিয়ন ডলার। ওই সময় ডলারের বিনিময় হার দাঁড়ায় ১০৬ টাকা। এতে দেশীয় মুদ্রায় বিদেশি ঋণের স্থিতি দাঁড়ায় ১০ লাখ ৪৮ হাজার ৭৪৬ কোটি টাকা। ফলে গত অর্থবছর ডলারের হিসাবে বিদেশি ঋণ বেড়েছে মাত্র তিন দশমিক ৭ শতাংশ। তবে টাকার হিসাবে তা বেড়েছে ১৭ দশমিক ৬ শতাংশ। অন্যদিকে বৈদেশিক মুদ্রা সরবরাহের অন্যতম আরও একটি খাত রপ্তানি আয়ও গত দুই মাস ধরে ধারাবাহিক কমে যাচ্ছে। গত নভেম্বরে কমেছে ৬ শতাংশ। ফলে সাধারণ মানুষের হাতে থাকা ডলার কতটুকু আসবে এ নিয়ে সন্দেহ রয়েছে বিশেষজ্ঞদের।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সায়েন্স বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আল আমিন যায়যায়দিনকে বলেন, 'বর্তমানে সাধারণ মানুষের হাতে ডলার আছে এটি সত্য। বর্তমানে ঘুষের মতো জঘন্য কাজেও ডলার ব্যবহৃত হয়। এসব ডলার কেউ ব্যাংকিং চ্যানেলে আনবে না। সুতরাং সাধারণ মানুষ ডলার করে রাখলে খুব একটা প্রভাব পড়বে না। কালো টাকার মতোই ডলার রয়েছে। সেগুলো খুঁজে বের করতে হবে। তাহলে রিজার্ভে প্রভাব পড়বে। বাংলাদেশ ব্যাংক এত ডলার বিক্রি করছে সেগুলো কোথায় আছে এটি সবারই প্রশ্ন।'