সামরিক অভিযানের প্রস্তাব নাকচ মালিকপক্ষের

জলদসু্যরা খেয়ে ফেলছে এমভি আবদুলস্নাহর খাবার ও পানি

প্রকাশ | ১৯ মার্চ ২০২৪, ০০:০০

সনজীব নাথ, চট্টগ্রাম
ভারত মহাসাগর থেকে ছিনতাই হওয়া জাহাজ এমভি আবদুলস্নাহর মজুত খাবার ও পানি খেয়ে ফেলছে সোমালি জলদসু্যরা। এতে সংকটে পড়তে পারে জাহাজে জিম্মি থাকা ২৩ নাবিক ও ক্রু। এদিকে নাবিক ও ক্রুদের উদ্ধার অভিযানে আন্তর্জাতিক সামরিক অভিযানের প্রস্তাব পেয়েও সায় দেয়নি মালিকপক্ষ। সোমবার (১৮ মার্চ) বিকালে এ তথ্য জানান এমভি আবদুলস্নাহ জাহাজের চিফ অফিসার আতিকুলাহ খানের ভাই আসিফউলাহ খান। তিনি বলেন, শুক্রবার (১৫ মার্চ) বিকালে স্যাটেলাইট ফোনের মাধ্যমে আমার ভাইয়ের কল পেয়েছি। কথা বলেছি। আমার ভাই জানিয়েছেন, জাহাজে উনারা নাবিক আছেন ২৩ জন। অন্যদিকে জলদসু্যদের ৪০ থেকে ৪৫ জন সার্বক্ষণিক থাকছেন। জাহাজে খাবার ও পানির যে মজুত আছে, তা জলদসু্যরাও খেয়ে ফেলছে। পানিও দ্রম্নত শেষ হয়ে যাচ্ছে বললেন। এটা নিয়ে উনাদের একটু দুশ্চিন্তা হচ্ছে। এ ছাড়া জাহাজে কার্গো আছে কয়লা। এগুলো বেশিদিন ফেলে রাখা যায় না। এটা নিয়েও উনারা টেনশন করছেন। সব মিলিয়ে তাদের জীবন এখন সংকটাপন্ন। ভাই আমাদের ফ্যামিলির খোঁজখবর নিয়েছেন। যতদ্রম্নত সম্ভব তাদের যেন ফিরিয়ে আনা হয়, সেটা বলেছেন। ভাই আরও বলেছেন, পাইরেটসদের সঙ্গে এখনো তাদের কোনো কনফ্লিক্ট হয়নি। দিনে তাদের কেবিনে থাকার সুযোগ দিচ্ছে। রাতে ঘুমানোর সময় সবাইকে জাহাজের ব্রিজে (ডেকের ওপর কাচের ঘেরা অংশ) নিয়ে যাওয়া হয়। মাঝেমধ্যে জলদসু্যদের মুড খুব ভালো থাকে, মাঝেমধ্যে খারাপ থাকে। তবে তেমন কোনো খারাপ আচরণ করছে না বলেই জানিয়েছেন। এদিকে প্রায় একই কথা বলেছেন জাহাজের মালিকপক্ষ চট্টগ্রামের কবির গ্রম্নপের প্রতিষ্ঠান এসআর শিপিং লাইনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মেহেরুল করিম। তিনি বলেন, 'এমভি আবদুলস্নাহ জাহাজে জিম্মি থাকা ২৩ নাবিকের জন্য ২৫ দিনের খাবার ও পানি মজুত ছিল। জাহাজে সাধারণত হিমায়িত মাছ, মাংস, সবজি এবং ফল, চাল, ডাল ও বিস্কুট রাখা হয়। আমরা আশঙ্কা করছি জাহাজে থাকা পানি ও খাবার জলদসু্যরা খেয়ে ফেলছে। ফলে খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকট সৃষ্টি হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সুতরাং সুযোগ সৃষ্টি হলে ওই জাহাজে সবার আগে খাবার ও বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করা হবে বলে জানায় মালিকপক্ষ।' বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএমওএ) সাধারণ সম্পাদক মো. শাখাওয়াত হোসেনও। তিনি বলেন, জাহাজে থাকা খাবার ও পানি জলদসু্যরা ব্যবহার করছে। ফলে খাবার ও পানির সংকট তৈরি হবে। খাবারের সংকট হলে দুম্বা ও অন্য খাবার সরবরাহ করে জলদসু্যরা। কিন্তু বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের সুযোগ খুব কম। তিনি বলেন, ইইউ সামুদ্রিক নিরাপত্তা বাহিনী এমভি আবদুলস্নাহর নাবিক ও ক্রুদের উদ্ধারে সামরিক অভিযানের একটি প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু মালিকপক্ষ সেটাতে রাজি হয়নি। আমরাও বারবার বলছি, যে কোনো ধরনের চাপ প্রয়োগ কিংবা সামরিক অভিযানের কারণে নাবিকদের ক্ষতি হতে পারে। এ ছাড়া এখন বাংলাদেশি জাহাজটিকে জলদসু্যরা যে অবস্থানে রেখেছে, সেখানে ইইউ কিংবা ভারতীয় রণতরীর সেটাকে অনুসরণের সুযোগ তেমন নেই। বিষয়টি স্বীকার করে মালিকপক্ষের মুখপাত্র মিজানুল ইসলাম বলেন, সমঝোতার মাধ্যমে নাবিকদের অক্ষত অবস্থায় দেশে ফিরিয়ে আনাটাই আমাদের লক্ষ্য। আমরা প্রথম থেকেই এটা বলে আসছি। নাবিকদের সঙ্গে আমাদের সর্বশেষ যোগাযোগের সময় আমরা তাদের এ বিষয়ে আশ্বস্ত করেছি। তাদের পরিবারকেও আশ্বস্ত করা হয়েছে। আমরা বিমা প্রতিষ্ঠান অর্থাৎ তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে জলদসু্যদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছি। কিন্তু জলদসু্যরা এখনো কোনো ধরনের সাড়া দেয়নি। মালিকপক্ষের তথ্যমতে, বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আবদুলস্নাহকে এখন সোমালিয়ার নুগাল প্রদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় জেলা শহর গদবজিরান থেকে আনুমানিক চার নটিক্যাল মাইল দূরে উপকূলে রাখা হয়েছে। গত শুক্রবার (১৫ মার্চ) দুপুর নাগাদ জাহাজটিকে সেখানে নিয়ে নোঙর করে জলদসু্যরা। ওইদিনই স্যাটেলাইট ফোনের মাধ্যমে নাবিকদের তাদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগের সুযোগ করে দেয় জলদসু্যরা। এরপর শনিবার (১৬ মার্চ) রাত ৮টার দিকে জাহাজের আরেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা স্যাটেলাইট ফোনের মাধ্যমে মালিকপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এ সময় গদবজিরানের কাছাকাছি নোঙরের পর জলদসু্যরা জাহাজে সশস্ত্র প্রহরা আরও বাড়িয়েছে। এ নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই নাবিকদের মধ্যে আতঙ্ক বেড়েছে। তবে এখন পর্যন্ত নাবিকদের ওপর তেমন কোনো চাপ তৈরি করছে না বলে জানিয়েছে মালিকপক্ষ। জলদসু্যদের পক্ষ থেকে মুক্তিপণ চেয়ে এখনো কোনো যোগাযোগও করা হয়নি। এর মধ্যেই মালিকপক্ষ ও সরকার তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে যোগাযোগের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। এদিকে ভারত মহাসাগরে বাংলাদেশি জাহাজটি জলদসু্যদের কবলে পড়ার পর ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) সামুদ্রিক নিরাপত্তা বাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, ওই অঞ্চলে জলদসু্যদের দৌরাত্ম্য রুখতে ও চলাচলকারী জাহাজগুলোর নিরাপত্তায় ইইউ পরিচালিত অপারেশন আটলান্টার আওতায় একটি জাহাজ জিম্মি জাহাজটিকে অনুসরণ শুরু করেছিল। এরপর ইইউ জাহাজের পক্ষ থেকে অভিযান চালিয়ে বাংলাদেশি নাবিকদের মুক্ত করার প্রস্তাব এসেছিল। অন্যদিকে জলদসু্যদের কবলে পড়া বাংলাদেশি জাহাজকে সহায়তায় রণতরী এবং একটি দূরবর্তী টহল জাহাজ মোতায়েনের কথা গত শুক্রবার জানায় ভারতের নৌবাহিনী। এরপর শনিবার (১৬ মার্চ) ভারতীয় নৌবাহিনী জানায়, ওই অঞ্চলে সামরিক অভিযান চালিয়ে সোমালিয়ার জলদসু্যদের কাছ থেকে এমভি রুয়েন নামে মাল্টার পতাকাবাহী একটি জাহাজ তারা উদ্ধার করেছে। ১৭ নাবিককে উদ্ধারের পাশাপাশি জাহাজে থাকা ৩৫ জলদসু্যর সবাইকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করেছে তারা। কিন্তু ভারতীয় বিভিন্ন গণমাধ্যম খবর ছড়িয়ে দেয়, ভারতীয় নৌবাহিনী সামরিক অভিযান চালিয়ে এমভি আবদুলস্নাহ জাহাজের নাবিকদের উদ্ধার করেছে। কিন্তু বাংলাদেশি জাহাজটির মালিকপক্ষ চট্টগ্রামের কেএসআরএম গ্রম্নপের মুখপাত্র মিজানুল ইসলাম এ খবরকে ভিত্তিহীন বলে উলেস্নখ করেন। এ ধরনের বিভ্রান্তিকর তথ্যের কারণে জিম্মি নাবিকদের ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া কঠিন হয়ে যেতে পারে বলে তিনি আশঙ্কা করছেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদও সর্বশেষ জানিয়েছেন, গণমাধ্যমে মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর সংবাদ পরিবেশনের কারণে জিম্মি নাবিকদের ফিরিয়ে আনা কঠিন হয়ে পড়ছে। গণমাধ্যকর্মীদের দায়িত্বশীল সাংবাদিকতার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, বিমা প্রদানকারী ও জাহাজ মালিকদের সমন্বয়ে গঠিত সংস্থা পিঅ্যান্ডআই ক্লাবের মাধ্যমে সমঝোতার মধ্য দিয়ে সোমালিয়ান জলদসু্যদের হাতে জিম্মি জাহাজ ও নাবিকদের মুক্ত করার প্রচেষ্টা চলছে। উলেস্নখ্য, মোজাম্বিক থেকে ৫০ হাজার টন কয়লা নিয়ে দুবাইয়ে যাওয়ার পথে ১২ মার্চ দুপুর দেড়টার দিকে জলদসু্যদের কবলে পড়ে ২৩ বাংলাদেশি নাবিকসহ বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজ এমভি আবদুলস্নাহ। জাহাজে থাকা নাবিকরা হলেন- জাহাজের মাস্টার মোহাম্মদ আবদুর রশিদ, চিফ অফিসার আতিকুলাহ খান, সেকেন্ড অফিসার মোজাহেরুল ইসলাম চৌধুরী, থার্ড অফিসার এন মোহাম্মদ তারেকুল ইসলাম, ডেক ক্যাডেট সাব্বির হোসাইন, চিফ ইঞ্জিনিয়ার এএসএম সাইদুজ্জামান, সেকেন্ড ইঞ্জিনিয়ার মো. তৌফিকুল ইসলাম, থার্ড ইঞ্জিনিয়ার মো. রোকন উদ্দিন, ফোর্থ ইঞ্জিনিয়ার তানভীর আহমেদ, ইঞ্জিন ক্যাডেট আইয়ুব খান, ইলেকট্রিশিয়ান ইব্রাহীম খলিল উলস্নাহ এবং ক্রু মো. আনোয়ারুল হক, মো. আসিফুর রহমান, মো. সাজ্জাদ হোসেন, জয় মাহমুদ, মো. নাজমুল হক, আইনুল হক, মোহাম্মদ শামসুদ্দিন, আলী হোসেন, মোশাররফ হোসেন শাকিল, মো. শরিফুল ইসলাম, মো. নুর উদ্দিন ও মো. সালেহ আহমদ। বিএমএমওএ জানিয়েছে, জিম্মি নাবিকদের মধ্যে ১১ জন চট্টগ্রামের ও দুজন নোয়াখালীর। বাকি ১০ জনের বাড়ি ফরিদপুর, টাঙ্গাইল, নওগাঁ, খুলনা, নেত্রকোনা, লক্ষ্ণীপুর, ফেনী, নাটোর, সিরাজগঞ্জ ও বরিশাল। আর এ নিয়ে দ্বিতীয়বার কোনো বাংলাদেশি জাহাজ জলদসু্যদের অপহরণের শিকার হলো। এর আগে ২০১০ সালের ৫ ডিসেম্বর ভারতের উপকূলে আরব সাগরে সোমালিয়ান জলদসু্যদের কবলে পড়েছিল একই প্রতিষ্ঠানের আরেকটি জাহাজ এমভি জাহান মণি। ওই জাহাজের ২৫ বাংলাদেশি নাবিকের পাশাপাশি এক ক্যাপ্টেনের স্ত্রীসহ ২৬ জনকে ১০০ দিন জিম্মি করে রাখা হয়েছিল। সরকারি উদ্যোগসহ নানা প্রক্রিয়ায় ২০১১ সালের ১৪ মার্চ জিম্মিদের মুক্তি দেওয়া হয়। ১৫ মার্চ তারা বাংলাদেশে ফিরে আসেন। সূত্রমতে, চট্টগ্রামের কবির গ্রম্নপের এসআর শিপিং লাইনের মোট ২৩টি জাহাজ আছে। যেগুলো বিভিন্ন আন্তর্জাতিক রুটে চলাচল করছে। গোল্ডেন হক নামে পরিচিত এমভি আবদুলস্নাহ গত বছর এই গ্রম্নপের মালিকানায় আসে।